লেখক, কবি, শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে নোংরামি করার সবেচেয়ে বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। নোংরামি আবার যে সে ধরণের নোংরামি না। নোংরামো করতে করতে সেটাকে ভয়ংকর পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া হয়। তার উদাহরণ হুমায়ুন আজাদ, তার উদাহরণ অভিজিৎ রায়, তার উদাহরণ ফয়সল আরেফীন দীপন, তার উদাহরণ হত্যাকাণ্ডের শিকার অসংখ্য ব্লগার, দেশত্যাগী লেখকেরা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকে আগাচ্ছে। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, মানবিক দিকে দেশের উন্নয়ন বলে কিছুই নাই। বরং দিনের পর দিন মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সহিংসতার নিত্যনতুন ধরণ আমাদের যেভাবে চমকে দেয়, দিনশেষে আমাদের অর্জন মূল্যহীন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হইলেই জাতি সভ্য হয় না। এর জন্য যে আধুনিক শিক্ষা, প্রগতিশীল চেতনা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন জরুরি- এই অতি সাধারণ কথাটাও দেশ চালকদের মাথায় আছে বলে মনে হয় না। তাই যে মাধ্যম আয়ের দেশ নিয়ে তারা গলা ফাটান, সেই দেশে রাজন রাকিব আর বিশ্বজিৎকে বীভৎস বর্বরতায় জনসম্মুখে খুন করা হয়, পড়ালেখা করতে চাইলে হাত কেটে ফেলা হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর, ধর্ষণ করে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয়া হয় রূপাকে আর জঙ্গি হামলার পর জঙ্গির প্রেমে পড়ে উঠতি বয়সের তরুণীরা। কী বীভৎসতা আমাদের চারদিকে।
কেন এরকম হয়?
হয়, কারণ, জাতিগতভাবে সুস্থ মননশীলতা তৈরির ব্যাপারটা আর সুস্থ নাই। আমাদের সংস্কৃতি আর শিল্পরে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ক্ষমতাবান অযোগ্য লোকেরা আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যকে দখল করে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে লেখকের ওপর, শিল্পীর ওপর, কবির ওপর, সাংবাদিকের ওপর, শিক্ষাবিদের ওপর। তারা তাদের কিনতে চায়, বানতে চায়, কড়াকড়ি করতে চায়। শুধু বৃহৎ পরিসরেই না, যেকোনো মাধ্যমে যেসব অযোগ্য লোকেরা গদি দখল করে ক্ষমতা প্র্যাকটিস করে, তারা নিজেদের কুরুচি, মানসিকতা আর চিন্তাচেতনা দিয়া মননশীলতার চর্চা করা মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং করে।
পরিস্থিতি এমন বলেই মানুষ আর মননশীলতা চর্চায় আগ্রহ পায় না, পেলেও স্বীকৃতি আর নিরাপত্তার তাগিদে মননশীলতা কম, বরং তেলবাজির চর্চাটা জোরেশোরে করা শুরু করে। তারপর তেলবাজেরা পায় বড় বড় পুরস্কার, বড় পদ, স্বীকৃতি আর ফলশ্রুতিতে জাতি পায় কুসংস্কৃতি, কুসাহিত্য, কুশিল্প এবং সবশেষে কুসমাজ। আর এ সমস্তের মাঝখানে চিপায় পড়ে ত্রাহি ওঠে তাদের, যারা আপোষ করে না, যারা প্রগতির পথে হাঁটে- তাদের।
লেখক, চিত্রকর, কবি, শিল্পীকে আপনি আর দশটা মানুষের মতো এক কাতারে ফেললে ব্যাপারটা সুন্দর হয় না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা ও তারে দিয়া নিজের মতো করে কাজ করায়ে নেয়ার অপচেষ্টা কোনোদিন ভালো দিকে যায় না। আপনি যতই দড়ি দিয়া বান্ধেন, তারা তাদের মতো করেই নিজের কাজ করে যাবে। যখন আপনি কবিকে বলে দেবেন- এমতে কবিতা লেখো, চিত্রকরকে কইবেন- ছবি অমনে আঁক, শিল্পীরে কইবেন- অমনে না, অ্যামনে নাচ; তখন সেটা কুৎসিত। আপনিও কুৎসিত।
শিল্পের রসস্বাদন করবেন কি করবেন না, সেটা আপনের ইচ্ছা। আপনি চাইলে লেখকের লেখা পড়বেন, না চাইলে পড়বেন না, চাইলে কবির কবিতা পড়বেন, না চাইলে পড়বেন না, চাইলে তার গান শুনবেন, নাচ দেখবেন, ছবি দেখবেন, না ভাল্লাগলে দেখবেন না, শুনবেন না। আপনারে কেউ যাতা দিয়া ধইরা বাইন্ধা এগুলি দেখতে শুনতে পড়তে কয় নাই। সব প্রকাশক সব লেখা ধারণ করতে পারবে না। সব প্রকাশকের সব ক্ষমতা থাকে না। রক্ষণশীলতাকে ভেঙ্গেচূড়ে অচলায়তনের মূলে আঘাত করে যে লেখা, তা প্রকাশ করার যোগ্যতা ও মেধা সব প্রকাশকের থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। যদি থাকতো, তবে বাংলাদেশে রেঁনেসা ঘইটা যাইতো। তা যায় নাই, ঘটছে উগ্রবাদ, জন্মাইছে জঙ্গি এবং ছুপা জঙ্গি।
আপনি প্রকাশ করতে পারবেন না, ভালো কথা। কিন্তু আপনার কোনো অধিকার নাই লেখকরে আটকানোর, তারে নিয়ন্ত্রণের। নিয়ন্ত্রণে কিছু হয় না। পৃথিবীতে লেখকরে নিয়ন্ত্রণের এই কুৎসিত উদাহরণ যারাই তৈরি করসে, তারাই ফাঁন্দে পড়সে। আপনি প্রগতি, নতুন চিন্তা, প্রথা ভাঙ্গার চলকে আটকাইতে পারবেন না, যতই আপনে লেখকের হাতে বেড়ি, কলমে শিকল পরান।
কথা হইতেসে, আপনি লেখকরে বানতে পারেন না। না পোষাইলে পড়বেন না, গায়ে বেশি লাগলে ছাপবেন না। কিন্তু আপনি কইতে পারেন না, এই লেখা অশ্লীল, ওই শব্দ খারাপ, ওই বাক্য বিশ্রী। অশ্লীল আর খারাপের সংজ্ঞা দেয়ার আপনে কে? হইতে তো পারে আপনেই বিশ্রী আর খারাপ। হইতে পারে আপনি ধান্ধাবাজ। হইতে পারে আপনি রক্ষণশীল জঙ্গি মনোভাবসমৃদ্ধ পুরুষতান্ত্রিক। এই কারণে জ্বালা ধরে। যাই হউক, আপনে কখনোই লেখকের কলমকে চালিত করতে পারেন না। সব লেখকের নির্দিষ্ট স্টাইল আছে। আপনে তারে লেখা শিখাইতে আসবেন ক্যান?
এই সমাজে লেখক, শিল্পীর হাত থাকে বান্ধা, তার কলম আর তুলির ওপর থাকে কড়া দৃষ্টি, হুমকি, ধমকি, এমা ছি ছি, জঘন্য সমালোচনা। এই দেশে তাই সালমান রুশদি জন্মায় না। বরং তসলিমা নাসরিন দেশত্যাগী হয়, হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ, দীপন, নিলয়ের রক্তাত্ত মৃত্যু হয়। নানামুখী চিন্তা, লেখালেখি ও শিল্পের নতুন স্টাইল ও চর্চা আমরা মেনে নিতে পারি না। সমাজকে রুদ্ধ করে রাখার অসৎ প্রয়াস চাপিয়ে দেয় ক্ষমতায় থাকা কুরুচিবানেরা। এদের প্রতিরোধের সময় এখনই।
কোনো আপোষ নয়, কোনো সমঝোতা নয়। এদের অশিক্ষা ও রুচিহীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবার এখনই সময়। তাতে যত বাঁধাই আসুক, তা মোকবেলা করতেই হবে।