আমার এক বন্ধু পঁচিশে মা হইসে। তারপর ছাব্বিশে আবার মা হইসে। তারপর আবার আঠাশে গিয়ে মা হইসে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় এক সাবজেক্ট থেকে মাস্টার্স পাশ দেয়া সেই মা গত এগারো বছর যাবৎ বাড়িতে বইসা আছে। সে এসএসসি আর এইচএসি দুইটাতেই বোর্ডে স্ট্যান্ড করছিলো।
তো আমি বিয়েই করছি পঁচিশের পর। বাচ্চা প্ল্যান করছি বিয়ের পাঁচ বছর পর এবং সব মিলায়ে আমার বিবাহের ছয় বৎসর পর আমার মেয়ে হইসে। কারণ আমার সময় ছিলো না বাচ্চা নেয়ার। আমি চাকরি করছি, প্রমোশন পাইসি, আয় করছি এবং নিজেরটা নিজে উপার্জন করছি।
তো এই দেরিতে মা হওয়া আমাকে আমার ছোটকালের সেই পঁচিশে প্রথম এবং পরে ক্রমাগত মা হওয়া বন্ধুটি প্রায়ই খোঁচা দিয়া বলতো যে, আমি বুড়িকালে মা হইসি। এই খোঁচা দেয়ার মুহুর্তে তার চোখেমুখে এক প্রবল আনন্দ দেখতে পাইতাম। আমি কিছু কইতাম না।
একদিন সে আবার খোঁচার অবতারনা করলে আমি নিরীহ মুখে কইলাম, তুই যখন বছর বছর ওটিতে শুইয়া বাচ্চা বিয়াচ্ছিলি, আমি তখন মাঠে ঘাটে ক্যামেরা নিয়া ছুটে বেড়াচ্ছিলাম আর সিরিজ রিপোর্ট বানাইতেসিলাম। কিংবা ধর, তোর তিন নম্বর বাচ্চাটা যখন হইলো তখন আমি অফিসে প্রাইম টাইম নিউজ বানাই। তো সেইসবের পরও আমি সুবিধাজনক সময়ে মা হইসি। এখন বুড়ি মা আর ছুড়ি মায়ের মধ্যে গৌরবগত যে পার্থক্য, সেই পার্থক্য কি বিজ্ঞানসম্মতভাবে আসে, নাকি পুরুষতন্ত্রের সুতীব্র ক্লেদই আমাকে তোকে শিখায়া দেয় যে, ছুড়িকালে মা হইয়া তুই ফাটায়া ফালাইছোস, আর আমি বুড়িকালে মা হয়া সংকুচিত থাকমু, এইটাই নিয়ম?
এরপর কী হইলো সেই ইতিহাস বয়ানে আর গেলাম না। তবে শুনতে পাই, আমার সেই বন্ধুটি এখন প্রাণপণে চাকরি খুঁজে, কিন্তু সব ফার্স্টক্লাসধারী সেই তারে কোনো চাকরিদাতা আর খুঁজে নাহ।
পিতৃতন্ত্রের নিয়ম হইলো, মেয়ে শিশুকালে বিবাহ করবে, তারপর দ্রুত বাচ্চা হবে। অল্পবয়সে পেট ফুলায়ে প্রেগনেন্ট হবার যে মোহনীয় সৌন্দর্য আমাদের মাথায় সেট করে দেয়া হইসে, সেই সৌন্দর্যতত্ত্ব পুরুষতন্ত্রের শেখানো। খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিতৃতন্ত্র আমাদের মাথায় ঢুকায়- মা হও, দ্রুত মা হও; যেন আমরা কোনোক্রমেই নিজের জীবনের দিকে ঠিকমত তাকাইতে না পারি।
ঠিক যেরকম পুরষতন্ত্র আরো শেখায় একাধিক সন্তান তত্ত্বটিও। একই সঙ্গে পুরুষতন্ত্র নারীকে পুত্র সন্তানের মা হবার গর্বে গর্বিত হবার দীক্ষাও দেয়। নারী সেই দীক্ষায় দীক্ষিত হয়, তারপর অনেকগুলা বাচ্চাসহ গর্বিত মাতৃত্ব নিয়া ঘুরে। পুত্রের মাতা হবার দেমাগ নিয়ে পাখা ঝাপটায়। এত ঘৃণ্য এই দীক্ষার প্রসেস যে নারী নিজেও জানে না সে নিজেকে কোন প্যাক কাদার ভিতরে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ক্লেদাক্ত করে ফেলেছে।
মাতৃত্বকে ওভাররেটেড করার কৌশলটিও পুরুষতন্ত্রের। মাতৃত্ব মহান, মাতৃত্ব সবকিছুর উপরে ইত্যাদি বইলা পিতৃতন্ত্র নারীর আত্মপ্রেমের বিষয়টা নারীর ভিতর থেকে টেনে হিচড়ে ছুঁড়ে দিতে চায়। পিতৃত্ব নিয়া পুরুষতন্ত্রের মাথাব্যাথা নাই। ‘পিতৃত্ব মহান, সব কিছুর উপ্রে’- এমন কোনো বাণী পুরুষতন্ত্রের নাই। নাই, কারণ বানী থাকলেই তো বিপদ। তখন সন্তানের জন্য বাপরে যদি বাড়িত বয়া থাকা লাগে? যদি একের পর এক ত্যাগ স্বীকার করা লাগে, তাইলে?
নাহ, পুরুষ সেটা করবে না। করবে না বলেই মাতৃত্ব মহান হইলেও পিতৃত্ব নিতান্ত সাধারণ পুরুষতন্ত্রের সমাজে। এই বটিকা নারীরেও গুলে খাওয়ানো হয়। গুলায়ে এমন খাওয়ানোটাই খাওয়ানো হয় যে নারী তার মাতৃত্বের মধ্যে যে গৌরব খুঁজে পায়, সেই গৌরবই হয় তার একমাত্র সম্বল। সেই গৌরব দিয়া সে অন্য নারীরে আঘাত কইরা হইলেও আরো উচ্চে উঠতে চায়। পুত্র জন্ম দিয়া, অল্প বয়সে জন্ম দিয়া, বেশি বাচ্চা জন্ম দিয়া এবং এমনকি নরমাল ডেলিভারি করে বাচ্চা জন্ম দেয়ার ব্যাপারটা নিয়াও নারী গর্বিত হইতে চায়। এই গর্ব সে প্রকাশ করে যে নারীর কন্যা সন্তান, যে নারীর সন্তান নাই, যে নারীর বেশি বয়সে সন্তান হইসে এবং যে নারী সিজারিয়ান অপারেশন করে বাচ্চা জন্ম দিসে, সেই নারীর কাছে। নারীরে নারীর বিরুদ্ধে লাগায়া রাখার আদিম পুরুষতান্ত্রিক কৌশল এক্ষেত্রেও খুব সুন্দর কাজ করে। নারী সন্তান জন্মদানের মতো একটি জৈবিক ব্যাপারকে নিজের একমাত্র কৃতিত্ব ধরে নিয়া তাই দিয়া গর্ব ফলাইতে চায়।
মাতৃত্বের টোপ দিয়া পুরুষতন্ত্র তাই ব্যবসা ফাদে। নারীরে সেই টোপ দিয়া ধইরা পুরুষ কয়, তুমি মা হইয়া মহান হইসো। কিন্তু কক্ষনো কয় না আমি বাপ হয়া মহান হইসি।
পুরুষতন্ত্রের কোলে চাপা ওই আদুরে বেলাইরূপী বোকা নারী এই টোপ খায়। পুরুষের ফাঁদ ধরতে পারে না। যেহেতু তার আর কিছুই নাই, না ক্যারিয়ার, না উপার্জন, না আত্মপ্রেম- সে এই জন্মদানের ক্ষমতারে বিরাট কিছু ধইরা নিয়া লাফাইতে থাকে আর অন্য নারীরে খুচাইতে থাকে।
এই খুঁচাখুচি দেইখা পুরুষতন্ত্র মগডালে বইসা দাঁত ক্যালাইয়া হাসে- হাসতেই থাকে...!