কানাডার টরন্টো এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে রয়েছি বেশ কিছুক্ষন হলো। নিউইয়র্ক থেকে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ভেতরে লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট থেকে প্লেন ছেড়ে একঘন্টা চল্লিশ মিনিটেই পৌঁছে গেছি ভালোভাবে। এয়ারপোর্টের মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে নিউইয়র্ক থেকে আগত ফ্লাইট এর যাত্রীদের চেকইন করা লাগেজ এয়ারপোর্টের আট নাম্বার বেল্টে আসছে। সকল যাত্রী আট নাম্বার বেল্ট ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার কোনো সুটকেস চেক ইন করিনি, ফলে হাতে একটি ক্যারিঅন কেবল, সেটা নিয়ে সোজা হেটে বেরিয়ে যাবার শেষ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। টরন্টোতে বাইরে ঝড়ের মতো তুষারপাত হচ্ছে। ঠান্ডার ঝাপ্টা তীব্র সাপের ফনা তুলে ছোবল মারছে।
আমাকে নিতে আসবেন হাসান মাহমুদ ভাই। তাঁর অপেক্ষায় থেকে থেকে, কয়েন নিয়ে এয়ারপোর্ট এর পাবলিক টেলিফোন থেকে কল করে বাসা থেকে জানলাম উনি বেরিয়ে গেছেন অনেক আগেই। যাত্রী তুলে নিয়ে একটি একটি করে গাড়ী পিল পিল করে চলে যাচ্ছে। হাসান ভাইয়ের দেখা নেই। ঠান্ডায় জমে হাত পা হীম। একবার বাইরে বেরিয়ে একটু হেঁটে ওনাকে খুঁজি আবার ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে এসে কাঁচের দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে গাড়ী গুনি। অবশেষে দূর থেকে সাদা বরফের পোটলার মতো হাসান ভাইকে দেখা গেলো। ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে কোনোমতে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে।
আমার এবারের আসার পেছনে বন্ধু বড় বোন সংবাদ পাঠক দিলরূবা আপা আর দীপা। পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরের আগমনী রাতে একসাথে আড্ডা দেবার একান্ত ইচ্ছেয় ওরা নিমন্ত্রণ করেছে আমাকে। কিছুদিন আগেই একবার এসে গেছি নৃত্যশিল্পী অরূনা হায়দারের নাচের স্কুল সুকন্যা নৃত্যাঙ্গনের বার্ষিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণে। কিন্তু বুকের তলায় এবার আসার আরো একটি গোপন অদম্য আকাঙ্খাই প্রধান। আসার একদিন পরে সেই ইচ্ছের প্রাবল্য পরিকল্পনা মাফিক আমাকে টেনে নিয়ে গেলো অটোয়ায় ডঃ মীজান রহমানের কাছে। এই দীর্ঘ পথে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে গেলেন বড়ভাই, জামাত ও শারীয়া আইনের বিরুদ্ধে লড়াইকারী এক অকুতভয় যোদ্ধা হাসান মাহমুদ। আজ এই মুহুর্তে, আপাতত আমার গন্তব্য টরন্টোর মারখাম শহরে দিলরূবা আপার বাসা। আগামী কাল দীপার বাসায় অনুষ্ঠান শেষে পরশু রওনা হবো অটোয়াতে। এবছর তুষার পাতের মাত্রাধিক্য এতো বেশী যে তুষারের ভারে গাছ পালা ভেঙে পড়ে দিন চারেক অধিকাংশ এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না। কাঁচের পুতুলের মতো সারি সারি বাড়ীঘর, স্বর্গের কাননে কৃস্টাল ট্রিজ! টরন্টোর সেই কৃস্টাল ট্রী'জ আমার ক্যামেরা বন্দী হতে থাকলো দিলরূবা আপার বাসায় যেতে যেতে।
২০১৩ শেষ হবে আর ক'দিন পরেই। আমার ছেলে সিদ্ধার্থের সাথে অনেক আলাপ আলোচনার পরে অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটি পারিবারিক জীবন গড়ে তুলবার ইচ্ছেয় মার্কের দেয়া প্রোপোজাল ভেবে দেখবো বলে জানালাম। আমার জীবন আর পাঁচ জনের মতো সহজ ছিলো না কোনোদিন, সে আমাকে পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরে বেদনার ধারাজলে সিক্ত করেছে। প্রায় পনের বছর ধরে আমরা একা। সিদ্ধার্থ আর আমার একার সেই জীবনে কেবল বেঁচে থাকা টুকু ছাড়া আর কিছু ছিলো না। একদিন দেশ ছেড়ে এসেছিলাম আমার আত্মসম্মানের মুকুটটি সগৌরবে সমুন্নত রাখবো বলে।
ধীরে ধীরে কত শত না পাওয়া আর বঞ্চনার অভিমানে ভরা ছিলো সেই বিদায়। সব ফেলে এই অজানায় একা একা পাড়ি দিয়েছিলো যে, সে কি আমার অবচেতন মনের ভেতরের এক প্রতিবাদী আমি, এক নীরব যোদ্ধা। আসলে দীর্ঘদিনের তিল তিল অবমাননা, ভালোবাসাহীন প্রতারণার পুঞ্জীভূত অভিমান, মানুষের সুন্দর মুখের তলায় এক কুৎসিত কঙ্কাল দেখে দেখে মনে হলো, কতদিন আমি মানুষ হিসেবে বাঁচিনি! একবার, শুধু একবার মানুষ হিসেবে বেঁচে উঠবার জন্য জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে পথে পা বাড়ালাম। সাথে পাঁচ বছরের সিদ্ধার্থ।
দেশ ছেড়ে এসে আমেরিকার পথে পথে চোখের জল ঝরে পড়েছে বেদনায় অভিমানে। দূর্ভাগ্যকে হাসি মুখে জয় করার যে লড়াই, সে লড়াইয়ে আমি বার বার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এই বোধ হয় শেষ হয়ে গেলাম, আর হয়তো পারলাম না। তবু কেমন করে যেনো মাথাটি ঠিকই রয়ে গেছে উঁচু, আর সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে জীবনের এই দীর্ঘ পথ চলা। বারে বারে জীবনের এই রাফ জার্নিতে কেবল মনে হয়েছে বাবার কথা, মায়ের কথা। একটি মায়াময় ছায়ার কথা। সবসময়েই আমার অন্তর খুঁজে ফিরেছে যে শ্যামল ছায়া।
সেবার ২০১১ তে মন্ট্রীয়লে মনিকা'র বাসায় যখন দেখা হলো তখন বসন্তের মন্দমধুর হাওয়া লেগেছে বনে বনান্তরে। আমি মন্ট্রীয়লে একটা অনুষ্ঠান করতে আসবো জেনে, টরন্টো থেকে ড্রাইভ করে গিয়ে অটোয়া থেকে ডঃ মীজানকে নিয়ে এসেছেন টরেন্টোর মনিরুল ইসলাম ভাই। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ওয়াশিংটন থেকে এসেছেন ইকবাল বাহার চৌধূরী। নিউইয়র্ক থেকে গেছি আমি। আয়োজক শহিদুল ইসলামের আমন্ত্রণে মন্ট্রীয়লের আলোকিত মানুষেরা হয়েছেন সমবেত। চমৎকার সেই অনুষ্ঠানের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিলো দেশপ্রেম। ইকবাল বাহার চৌধূরীর স্মৃতিতে স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু, ডঃ মীজান রহমানের বক্তৃতায় দেশ, আমার কন্ঠে 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি'। সে অনুষ্ঠানের সবটুকু জুড়ে রইলো ১৯৭১, বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রাম।
রাতে বাসায় ফিরে গল্প গুজব শেষে মনিকার গান যেন সুরের মায়াজাল বিছিয়ে দিলো আমাদের সবার ভেজা চোখে। মনিকার বাসার দোতলায় মুখোমুখি ঘরে আমাদের শোবার ব্যাবস্থা হলো। অনেক রাতে শুতে গেছি স্বভাবতই আমাদের ঘুম ভেঙ্গেছে দেরীতে। তিনি কিন্তু ঠিকই উঠে সুন্দর কাপড়চোপড় পরে নীচতলায় বসার ঘরে সকালের কফি আর দিনের সংবাদপত্র নিয়ে বসেছেন। রাজা আমাদের হোষ্ট, সে তাঁর আশে পাশেই ঘুরছে সকালের নাস্তার আয়োজনে। ঠিক হলো সবাইকে নিয়ে অটোয়াতে যাওয়া হবে। এ ব্যাপারে কবি বন্ধু শিরিন সাজি ও তার স্বামী টিপু ভাইয়ের প্রাণ উজাড় করা আমন্ত্রণ স্মরণ যোগ্য। আমরা সবাই চলেছি একসাথে। মনিকা, রাজা ওদের মেয়ে ঋত্বিকা। মনি ভাই, ডঃ মীজান ও আমি। আমরা আনন্দে চলেছি অটোয়ায়।
ডঃ মীজানের বাড়ীতে গিয়ে হৈ চৈ করে, হাসি আনন্দ, রান্না খাওয়া, গল্প গানে, রাত প্রায় শেষ হতে চললো। কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে উঠে, পরদিন সকালে নাস্তা সেরে শিরিন সাজির ডাকে অটোয়ার বিখ্যাত টিউলিপ সো দেখতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখা হলো ছড়াকার বন্ধু লুৎফর রহমান রিটনের সাথে। গনজাগরণ মঞ্চের কর্মী টিপু, সঙ্গীত শিল্পী অং এবং তাঁর সঙ্গীরাও ছিলো সেখানে। রাতে শিরিনের বাসায় সবাইকে নিয়ে বসলো গানের আসর। কবিতা গানে গল্পে কেটে গেলো অনেকটা রাত। অসাধারন আড্ডার সেই স্মৃতি এক জীবনে ভোলা যাবে না। সেবার নিউইয়র্কে ফিরে এসেছিলাম বুকের ভেতর সেই খুঁজে ফেরা শ্যামল ছায়ার পরশ নিয়ে।
কিছুদিন পরে তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিনের কাছে কোস্টারিকা যাবার পথে নিউইয়র্ক এসেছিলেন তিনি। সব সময়ের মতো ছিলেন ওনার আরো এক আত্মার আত্মীয় সাবিনা হাই উর্বির বাসায়। সেবার আমার বাসায় একটি সন্ধ্যা ছিলেন। কবি শহিদ কাদরী ছিলেন ওনার দীর্ঘ দিনের বন্ধু, নিউইয়র্ক এলেই যেতেন কবিকে দেখতে। সেদিনও ছিলেন শহিদ ভাইয়ের বাসায়। সেখান থেকে বন্ধু বড় ভাই আর্কিটেক্ট ইকবাল হোসেন নিয়ে এলেন আমার বাসায়। খুব সাদামাটা বাঙ্গালী খাবার রান্না করেছি তাঁর জন্যে, উনি তাইই পছন্দ করতেন। রাতের খাবারের পরে সামনে বসে তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে শোনাতে গিয়ে চোখে জল এলো। মনে হলো এইতো আমার পরম পিতা, যার আবির্ভাবই আমার আনন্দ।
আজ আবার চলেছি তাঁর কাছে। গাড়ীতে বসে আছি। ধু ধু সাদা চারিদিক। গাছে গাছে বরফ জমে কৃস্টাল হয়ে গেছে। বাড়ী ঘর, গাছপালা, পথ ঘাট সব কৃস্টাল। যেন পুরো দেশটাই একটি কৃস্টাল বোল। হাসান মাহমুদ ভাই অতি ধীরে গাড়ী চালাচ্ছেন, তিনি সাবধানী ড্রাইভার। ক'দিন আগেই সারা কানাডায় তুষার ঝড়ে গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে ইলেক্ট্রিক পাওয়ার আউটেজ হয়ে গেলো। বেশ ক'দিন অন্ধকারে বিদ্যুৎহীন কাটাল দেশের জনগন। আজ থেকে তা ঠিক হয়েছে। আজ আমরাও চলেছি সেই শ্যামল ছায়ার কাছে। যেখানে গেলে সব ঠিক হয়ে যায়!
আমি কেনো যাচ্ছি তা কেউ জানে না। খুব কাছে বসে যে হাসান মাহমুদ ভাই গাড়ী চালিয়ে আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন তিনিও না। আমার জীবনে খুব গভীর গহন একটি সিদ্ধান্ত নেবার আজ সময় এসেছে। তাঁর কাছে যেতেই হবে আমাকে, উজাড় করে সব কথা বলতে চাই আমি। নিজের বাবাকে হারিয়েছি সেই কৈশোরে তারপর থেকে জীবনের সব বড় বড় সিদ্ধান্ত গুলো নেবার সময় বড় একা মনে হয়েছে নিজেকে। কি করব, কি করা উচিত, কি করলে ভালো হবে, কি ভালো হবে না, এই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি একা। একদম একা। কখনো তা ঠিক আবার কখনো হয়েছে ভুল, আর সেই অনিচ্ছাকৃত ভুল, রথের চাকার মতো নির্মমভাবে পিষ্ট করে গেছে আমার আহত হৃদয়, আমার বন্যাধারার মতো জীবন। বারে বারে রুদ্ধ করতে চেয়েছে আমার চলা। কিন্তু আমাকে থামাতে পারে নি জীবনের কোনো পিছুটান। ভুলকে আমি ফুল করে ফুটিয়ে তুলেছি। ফুলে ফুলে সাজিয়েছি চারিপাশ। ফুল ঝরেছে তবু হাসিটুকু ঝরাতে পারে নি কেউ।
বরফ ঢাকা পথ। যেতে হচ্ছে অতি ধীরে ধীরে খুব সাবধানে। দু’বার পথে থেমে চা কফি খেয়ে আবার গল্প করতে করতে চলেছি। সারাদিন পরে সন্ধ্যার মুখে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম। আমাদের যাবার কথা আগে থেকেই বলা ছিলো। কাছাকাছি গিয়ে কল করে আবারো জানালাম। গিয়ে দেখি বরফ পড়েছে এত যে ওনার বাড়ীর সামনের সেই বরফের প্রাচীর ঠেলে দরজা খোলার আর উপায় নেই, তা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে বাড়ীর পিছন থেকে ঢুকে হাসান ভাই বরফ পরিষ্কার করার শাবল তাবোল এনে সামনের দরজা খুলতে পেরেছিলেন। তো এইভাবে ভিতরে গিয়ে দেখি আমাদের জন্যে প্রচুর রান্না করে রেখেছেন রাতে খাবার জন্যে। খাওয়া দাওয়া শেষে অনেক রাত অবধি গল্প গুজোব করে ঘুমাতে গেলাম। খুব ভোরে উঠে বাবাকে পেলাম নিচে কিচেন টেবিলে তাঁর কম্পিউটারে বসা। দু'কাপ চা বানিয়ে মুখোমুখি বসলাম। আমরা একা। প্রাণ খুলে কথা বলছি। আমার যেন মনে হচ্ছে তেত্রিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আমার বাবার কাছে আজ বলতে এসেছি আমার সকল বেদনার কথা। যিনি বয়সে, শিক্ষায়, অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ। যাকে সব কথা খুলে বলতে হয় না। জীবনের বিস্তীর্ণ জমিন কেবল ছোট্ট একখানি ঝিলিমিলি চাঁদোয়ায় তুলে ধরা যায় তাঁর কাছে।
আমার দু'চোখ বেয়ে নামছে বঙ্গপোসাগরের নোনা জল। বাবা উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন 'জীবন তোমাকে শিখিয়েছে শত প্রতিকুলতার মধ্যেও প্রাণে আনন্দ নিয়ে বাঁচতে আর তুমি তাইই করবে। আনন্দ নিয়ে বাঁচবে। অন্যদেরকেও বাঁচাবে। জীবনে এমন সময় আসে যখন তুমি দেখবে, তোমার সকল বন্ধ দরজা হঠাৎ ঝনঝনিয়ে খুলে যাবে তুমি কেবল সেই খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডানা মেলে দেবে। সেটাই হওয়া উচিত।
সিদ্ধার্থকে নিয়ে আমার দীর্ঘ একাকী জীবনে মার্ককে সাথে নিয়ে একটি পারিবারিক জীবন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো অটোয়ার ১০৯ নাম্বার হোমস্টীডের বাড়ীর রান্নাঘরে বসে। আমার আত্মার আত্মীয় ডঃ মীজান রহমান যিনি আমার আত্মার পিতা বলে আবির্ভূত হলেন তাঁর হাত ধরে রচিত হলো আমার সিদ্ধান্তের সিঁড়ি। ভোর বেলাকার সারা আকাশ জুড়ে এই শান্ত সমাহিত প্রকৃতির বেনুকায় আহির ভৈরব বেজে বেজে থামলো। যখন তখন বাবার হাত ধরে বসে থেকেই দেখলাম সকালের সূর্য্য উঠেছে। সেদিন ২০১৩ 'র ২৯ শে ডিসেম্বর। সেদিন আমার আর একবার নবজন্ম হলো। দোতলায় তখনো ঘুমুচ্ছেন হাসান মাহমুদ ভাই, যিনি আজো জানেন না সেই সকালের আহির ভৈরবের সুরে থেমে যাওয়া ভোরের কথা। ঘুম থেকে হাসান ভাই উঠে এলে সকালের নাস্তা করে তিনজন বসে বারে বারে চা কফি আর আড্ডা দিয়ে কিচেন টেবিলেই সময় কাটালাম। এরপর বেরুলাম বাজার করতে, ফিরে এসে হৈ হৈ করে রান্না করছি এমন সময় এলেন আমাদের আরো এক বন্ধু ও বড় ভাই প্রফেসর সেলিম শের। তাঁকে নিয়ে একসাথে তুমুল গল্পের পাল উড়িয়ে কাটালাম দুপুর ও সন্ধ্যা।
দু’দিন ধরে এক নাগাড়ে চলছে আড্ডা, খাওয়া, গল্প, আবার আড্ডা, আবার খাওয়া আর তাঁর বই নিয়ে আলোচনা। কুমিল্লায় তাঁর গ্রাম, সেই গ্রামের কথা, মা বাবার কথা, শৈশব কৈশোরের কথা। তাঁর বিয়ের গল্প। দীর্ঘ সময় ধরে কানাডাতে বসবাসের অভিজ্ঞতার কথা। সঙ্গীত, গনিত, বিজ্ঞান, দর্শন কিছুই বাদ গেলো না সে আড্ডায়। হাসান ভাই তার অসামান্য স্মৃতি থেকে আবৃতি করে, পাঠ করে, গল্প বলে, কথা বলে আমাদের মুগ্ধ করলেন। বাবা বারে বারে হাসান ভাইকে ধন্যবাদ দিলেন এই দূর্যোগের দিনে মেয়েকে তাঁর বাবার সাথে দেখা করিয়ে দেবার জন্যে। আসবার আগে আমাকে দিলেন তাঁর অসামান্য বই "শূণ্য"।
বিদায়ের সকাল। গাড়ীতে উঠে বসলাম একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তুষারে ঢাকা সাদা বাড়ীটাকে পিছনে ফেলে ফিরে আসতে আসতে এক অজানা দর্শন আমার সকল ভাবনাকে অন্যসুতোয় গেঁথে দিলো। মনে মনে ভাবলাম আসলে এই গহীন গোপন বন্ধন ডোর কোন অজানা ইঙ্গিত দিয়ে যায়। এই সারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কোন সে মায়ার বাধনে বাঁধা, মানুষের প্রতি মানুষের, প্রাণের প্রতি প্রাণের! আর কেনোই বা এই হুতাশন, এই দীর্ঘশাস, রোদন। এই ময়াভরা স্বর্গীয় অনুভবের নাম কি! এই বিস্ময়ের নাম কি ভালোবাসা। মহাবিশ্বের কী গোপন রহস্যে ঢাকা পড়ে থাকে এর উত্তর জানি না।
গাড়ী চলছে টরন্টো অভিমূখে, কোলের উপর তাঁর বই ‘শূন্য’। এই বই পড়তে পড়তে চোখে আলোক মালা জ্বলে উঠে। ভাবনার গহনে নিয়ে যায়। খুলে যেতে থাকে মরচে পড়া সকল কপাট। আলো এসে সরিয়ে নিয়ে যায় অজ্ঞতার অন্ধকার। আনমনা হয়ে চেয়ে থাকি তুষার সাদা প্রান্তরের দিকে। সেখানে দেখতে পাই জ্বলজ্বলে একটি সিলভার লাইনিং।
২০১৪'র জুলাইতে আমার বিশেষ অনুরোধে অটোয়া থেকে নিউইয়র্ক এলেন আমার বিবাহ পরবর্তী রিসেপশানে। আমার বাবা হয়ে আমাকে সম্প্রদান করলেন মার্কের হাতে। মাঝরাত অবধি রইলেন অনুষ্ঠানে। জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন যাবার আগে, যেন আমি তাঁর আত্মার সন্তান, যাকে সম্প্রদান করে কাঁদছেন তিনি। সেই শেষ দেখা। পরদিন আমরা চলে গেলাম হানিমুন উপলক্ষ্যে সুইজারল্যান্ড হয়ে প্যারিস। বাবা আরো দু’দিন পরে ফিরে গেলেন অটোয়াতে। আর দেখা হলো না। মাসখানেক পরে আমি ফিরে এলে, কল করে বললেন মার্ককে নিয়ে তাঁর কাছে ঘুরে আসতে। আশা করে ছিলাম শীত কাটিয়ে স্প্রীং এলেই যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে বনতল তখন যাবো। কথাও দিয়েছিলাম তাঁকে।
ডিসেম্বরের শুরুতে তোলপাড় করে আমাকে খুঁজছেন বাবা। বেশ কয়েকবার কল করে পান নি। ইমেইল করেছেন তার জবাব না পেয়ে, ফোনের জবাব না পেয়ে, একে তাকে জিজ্ঞেস করেছেন আমার কথা। অনেকদিন পরে আমি যখন ফোন করেছি, ঝরঝরিয়ে কত কথা বলে গেলেন। কত কি দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন আমার খোঁজ না পেয়ে সেইসব। অনেক কথা বললাম, ইমেইল করে ছবি পাঠালাম। রাতে মার্ক অফিস থেকে বাড়ী ফিরলে আবার ফোন করলাম আবার দু’জনে মিলে কথা বললাম। কত যে খুশী হলেন। খুশী হলে প্রতিটি কথায় আনন্দ ঝরে ঝরে পড়তো তাঁর। আনন্দ ঝরে পড়া কথার মানুষ তিনি, তাঁর সাথে সেই আমার শেষ কথা।
আজ জানুয়ারীর পাঁচ, সোমবার। সন্ধ্যা নাগাদ মনিকার ফোন এসে আমার দুয়ারগুলি ঝড়ে ভেঙে দিয়ে গেলো। বাবা লাইফ সাপোর্টে। কিছুক্ষনের মধ্যে কথা হলো শিরিন সাজি, ফেরদৌস নাহার, সেলিম শের ভাই ও আরো অনেকের সাথে ততোক্ষনে ওনার ছেলেরা বাবু ও রাজা এসে পৌঁছে গেছে, লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়েছে…… আমি যেন কেমন গহন অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে আমার জন্মদাতা বাবাকে দেখতে পাচ্ছি। একটি টানেলের শেষ মাথায় এক অবর্ণনীয় আলো দেখতে পাচ্ছি আর মনে পড়ছে সেই রাতের কথা……আমার জন্মদাতা বাবা যে রাতে চলে গেলেন সেইরাতে আমাদের সারা বাড়ীর গাছপালায়, গেটে মাধবীলতার ডালে ডালে সেকি উতল হাওয়ার দোল! সেদিন ছিলো পয়লা ফাল্গুন। ঝরা পাতারা দুরন্ত সেই হাওয়ায় গেলো গেলো গেলো করতে করতে, ঝরঝরিয়ে সরসরিয়ে উড়ে গেলো। বাবা আমার দক্ষিন হাতে রাখলেন তাঁর দক্ষিন হাত, তারপর আস্তে আস্তে চোখ বুজলেন যেন তাঁর সমুখে শান্তি পারাবার। সেদিন আঁধার নয়, ফাগুন এসে নিয়ে গেলো আমার আলোকবর্তীকা, আমার শ্যামল ছায়া।
আজ আমার জীবনে তেমনি এক অজানা অপার্থিব আলো মাখা মুগ্ধ বেদনার রাত! আমার বাবার ছায়া মাখা মানুষটি, আমার মতো অনেকের জীবনেই এক আলোকবর্তিকা ডঃ মীজান রহমান, যাকে দেখেছিলেম আমার অন্তরলোকে যার আলোয় নিজেকে পরিস্কার কাঁচের স্বচ্ছতায় দেখতে পেয়েছিলাম, আজ তিনি চলে গেলেন। আজ তিনি শান্ত সমাহিত, তাঁর সমুখে শান্তি পারাবার। আজ তাঁর মহান যাত্রা সেই অগমপারে! পার্থিব কোনো কিছু যাকে টানে নি কখনো সেই নির্মোহ জ্ঞান তাপস, আজ একাকী চলেছেন সেই অনন্তধামে। আজ সেই গভীর গোপন অজানা রহস্যে ঘেরা জীবন ও জগতের গোপন লেনদেন। আমার অন্তর আর্তনাদ করতে করতে থেমে যায় স্তব্ধতায়। আমার কেবলি মনে হয় আকাশের মতো তাঁর বিশালতার কথা। জন্মদাতা পিতা নন তবু তার মনের আলোয় নবজন্ম হয়েছিলো আমার। যিনি সত্যিই আমার পরম পিতা। আজ এই শান্তির পারাবারে তাঁকে বিদায় দেবো কেমন করে! আমার যে আরো আলো চাই পিতা!
হে দেব, ঐরেশ! আমাকে শক্তি দাও! আমার চেতনায় আলোকসম্পাত কর। ছায়া দাও। মায়া দাও। দাও শেকড়ের স্থৈর্য। এই বিবশ স্থবির আঁধার ঘুচাও পিতা! হে আমার মনোময়, আলো দাও জল দাও আমার খোঁপা থেকে খুলে নাও এই মায়াকাতর সন্ধ্যামালতী। তোমার মৃত্যু নেই পিতা, জানি তুমি জেগে উঠবেই সারা আকাশ ভরে আবার শূন্য থেকে, জানি যত দূরেই যাও তবু তুমিই আমার শ্যামল ছায়া!