বিগত কোনো এক অক্টোবরে লন্ডনে তখন রাত সোয়া একটা। আমি দুটো কম্পিউটার নিয়ে একটা দেখে দেখে আরেকটাতে লেখার বাজনা বাজাচ্ছি। যখন দু’হাতের দু’আঙ্গুল যখন কি বোর্ডের খোপ থেকে খোপে লাফায় তখন দু’হাতের তর্জনী আর নির্দেশিকা উঠে থাকে। খরগোশের কানের মতো। কি-বোর্ডের তরঙ্গে তিড়িং বিড়িং নড়ে।
একবার ঢাকায়, দিনের বেলাই ঈশিতার খাবার ঘরে বসে লিখছি। ঈশিতা ফ্রিজ খুলে জলের বোতল হাতে কতক্ষণ আমাকে দেখলো।
আমি লেখা থামিয়ে বলি, কিছু বলবি?
সে হেসে বলে, মা একি অদ্ভুতভাবে তুমি টাইপ করো! বলে জলের বোতলটা টেবিলে নামিয়ে পিঠে হাত রাখে। ওর মুখে কৌতুক।
- আমার মা'টা আসলেই অদ্ভুত!
- কেনো্রে মা?
- তুমি না টাইপ করো যেন পিয়ানো বাজাচ্ছো। কম্পিউটারের কি বোর্ডকে এভাবে পিয়ানোর মতো ব্যবহার করতে আমি জীবনেও কাউকে দেখি নাই।
তো কথাতো আসলে সত্য। এটাই আমার বাজনা। আমার গান। তবে সিমাস হেইনীর মতো মেশিন গান বা বন্দুক না। তিনি বলেছিলেন,
“Between my finger and my thumb,
The squat pen rests; snug as a gun.”
তো আমি আমার লেখার যন্ত্রে বাজনা বাজাই। সুর তুলি প্রতি রাতেই। গরমে, হীমে, দ্রোহে, বেদনায় কিংবা কামে। মূলত রাতই আমার পরম। এই যে দাঁড়িয়েছি দীর্ঘ সে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে কেবল রাতেই। সে আমার চল্লিশ বছরের নারী লেখক জীবন।
পুরুষ লেখকের প্রবৃদ্ধি হয় মূলত দিনে এবং রাতে। আর নারীর হয় রাতে (আমাদের বাংলাদেশী বিবাহিতা ও সন্তানবতী নারীদের)। তাদের কোনো 'বউ' নেই বলে সমস্ত বউগিরি ও মা’গিরি শেষে, স্বামী সঙ্গের দায়িত্ব শেষ করলে রাত নেমে এলে তার পৃথিবী তার কাছে আসে। নারী লেখক তার ভাগের রাস্তায়ই শুধু হেঁটে বা দৌড়ে বেড়ায়।
কৃষ্টি সুখে সেলাই করা মন ডাহুকের বন
বাঞ্ছা করি ঘর পালানো গৃহস্ত জীবন।(জিয়ল যখম, আগামী প্রকাশনী)
তাই কখনো তাদের শুধু ঘরই হয়। কখনো শুধু পালানোই হয়। কদাচিৎ দুটো হয়। তবে তার জন্ম, বিস্তার, বাঁধন, ফোঁড়ন, বরন সবই হয় পৃথিবীর আলো মুছে গেলে। যারা টিকে থাকে রাতকে দিন করে তারা কঠিন। জটিল। জালাময়ী ও জ্বালাময়ও। হতেই হবে। হওয়াই উচিত। পাবেন আর দু একটা গুঁতো খাবেন না তাতো হয় না। দ্যাট ইজ পার্ট অব দা ডিল। তাই না?
সেদিন আমি - রাতে টুকুস টাকুশ চাকুম চুকুম ফেইসবুক ব্রেকে ব্রেকে লিখে যাচ্ছি।
বাড়িতে বাবলীর আম্বিয়া দাদীর বিড়াল নেই যে পাশে বসে থাকবে। আমার স্নান ঘাটের নানীও নেই যে ভুত তাড়ানোর দোয়া পড়বেন,
"আয়তুল কুরশি বন বন কুরান
ঘরকা মুহাম্মদ বাহারকা সুবহান
সাত দরোজা সাত মুকাম
সাত নিগাহবান...
আতালে দাকুনী বন্ধ
পাতালে বাসুকী বন্ধ
ভুত বন্ধ প্রেত বন্ধ সুলেমানের তখ্ত বন্ধ
বল্লা যা দূর যাহ্"।
আমার নানীর বোন ছিলেন ঐ স্নানঘাট শহরে থাকা নানী। পরিনত বয়সে যতবার ঐ ছড়াটার কথা মনে হয়েছে। ততবার হেসেছি। ঐ বল্লারা কারা সেটা ভেবে। এক সময় মনে হয়েছে বল্লার রাজ্যে কি করে হল্লা করা যায়। পারিনি। নিরবে রাতে ঢুকে গেছি।
সেদিন ঘাড়ের পেছনের কাচ দিয়ে দেখি রাস্তার পিছলে পড়া আলোয় দেখা যাচ্ছিলো নুয়ে থাকা নাসপাতি গাছ। শীতের দেশের কাঁচের বাড়ির এমনই ইন্সুলেশন কিছু শোনা যায় না। আমার কি বোর্ড যেনো কঁকাচ্ছে না। আজাদ উঠে বাথরুম গেল। কার্পেট বলে ওর হাতের লাঠি বা সিলভার জিম্মার ফ্রেইমের শব্দ শোনা যায় না। তাছাড়া যৌবন থেকেই আজাদের মেকুর (বিড়াল) চলন। নিজের ঘরেই পা টিপ টিপ। আর অতি অভ্যস্ত সে আমার রাতের জীবনে। এখন আমি যখন শেষরাতের দিকে ঘুমোই তখনো ওর এই মেকুর চলার শব্দ পাই। শব্দ কাঙ্খিত সময় পেরুলে গিয়ে দেখি তার যাবতীয় পৃথিবী কোথাও আটকে গেল কিনা। তাহলে সেলূটেপ দিয়ে আঠা দেবো। দাঁত খুলে গেলে গ্লু দেবো। না উঠতে হয়নি। আমি আবার আমার পিয়ানো বাজানো শুরু করতেই বুঝি টং করে উঠেছে ম্যাসেঞ্জার।
জানি না টোরান্টোতে বোধ করি বিকেল ফিকেল। না হলে এখন রহিমার হাতে কফি থাকতো। সে বলতো গুড মর্নিং টোরান্টো।
- কি করো?
- ঝিমাই আর অনুবাদ করি।
- বল দেখি এত কাজ কর কেনো? ভেবে বল কি চাও? কষ্ট হয় না!
-বন্ধু পাগলেরতো বিষ নাই।
- হা হা হা হা। ভয়ানক পরিশ্রম করো। কেউ য্যান তোমারে থামায়।
- আরে না, থাইমা গেলেই তোমার বন্ধু শ্যাষ।
-ভয় দেখাও কেন। যাও লেখো গা।
মা থাকতে মা এসব বলতো। এখন বন্ধুরাই মা-বাপ!
চলমান…