বেশ আগের কথা। গাড়ি চালানো শিখছিলাম। লন্ডনের রাস্তা। এমনিতে দূর্ঘট ঘটে না। আর ঘটলে তা হয় মারাত্মক। একজন মানুষের সামান্য অন্যমনষ্কতায় একেবারে যাতা ঘটে যায়।
আমার চালনা-প্রশিক্ষক আইরিশ। তখন হাফমুন থিয়েটারের জন্য র্যাফ্ট নামে তখন যে নাটক লিখছিলাম তার ড্রামাটার্গ লীন কখলিনও আইরিশ। বুঝি আইরিশদের সঙ্গে আমাদের অনেক মিল। তাই তারে আমার আত্মীয় আত্মীয় লাগে। গাড়ি চালনা শেখার ব্যাপারে বিলেতে একটা মজার আছে- শিক্ষানবিশী অবস্থায় আমি দূর্ঘটনা ঘটালেও দায় যাবে জনের উপর। পুলিশ বলবে এই ব্যাটা তুই না ছিলি? তোর হাতে না ডুয়েল কন্ট্রোল? তাইলে কেমনে কি?
তাই তার বাদামের খোসার মতো টয়োটাতে বসা মাত্র আমি ফূর্তিতে গাড়ি ছোটাই সাঁ। থামতে বল্লেও থামি না! প্রতিদিনই একটা না একটা ভুল করি। দূর্ঘটনা হয় না। তার আগেই মৃদু ভর্ৎসনাতে জন হয় ব্রেক নয় স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দেয়। আমি হাসি হাহ্ হা।
দিনটি ছিলো এক খন্ড এপ্রিল। ব্লুবেল কুড়ি ঘাড়ের খয়েরী মাটি ঠেলে উঠার চেষ্টা করছে। আবছা শীতে রোয়ানের গন্ধ। গাড়িতে বসেই মনে হলো আমি রাস্তার রাজা পাশে মন্ত্রী। হ্যাপা সামলাবার দায়িত্ব তার। যানের জন্য যৌথ রাস্তা। একদিকে আমার এগুবার, অন্যদিকে উল্টোদিক থেকে যান আসবে। মধ্যে হলুদ আঁক কাটা।
গাড়ি ছাড়ার আগে প্রতিদিন কিছু বয়ান শুনতে হয়। সেদিন বল্লো, তুমি শুধু তোমার ভাগের রাস্তায় থাকবে। অন্যের ও এই রাস্তায় সমান অধিকার। তারটা খেয়ে ফেলো না। আমি বাংলাদেশের মানুষ না। যেই দেখি উল্টোদিকে একদম গাড়ী নেই অম্নি চলে যাই মাঝ রাস্তায়। আবার ফিড়ে গাড়ি দেখলেই আবার ফিরে আসি। দুটো গাড়ি সাঁই করে পাশ দিয়ে গেল। দু’দুবার সে আমার স্টিয়ারিং ঘোরালো। তৃতীয় বার সে গাড়ি দাঁড় করাতে বললে দেখি জনের মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। সে তবু ঠান্ডা ভাবে বুঝালো তুমি পথচারি হলেও একই নিয়ম। গায়ের জোরে অন্যের বরাদ্দ জায়গায় যেতে হয় না। তুমি হাঁটবে সেও হাঁটবে। কারো গায়ে কেউ লাগবে? না। এবং লাগাবে ও না। এই পথ সবার। আমি লজ্জিত হলাম।
মনে পড়ে গেল বাংলাদেশের ফুটপাথহীন ফুটপাথ বা হাঁটার রাস্তার কথা। মনে পড়ে গেলো এক গ্রীষ্মে মোহাম্মদ পুর বাজারের সামনে খালামনির বাসার সামনের রাস্তাটার কথা। মনে পড়লো সাপ্তাহিক বিচিত্রায় থাকার সময়ে একদিন প্রেস ক্লাব থেকে নূরে আলম ভাইর সঙ্গে হেঁটে পরীবাগ ফেরার কথা। মনে পড়লো বিলেত থেকে খন্ড কালীন অধ্যাপনার জন্য দেশে গিয়ে থাকার কালে গুলশান থেকে হেঁটে যাবার ঘটনা গুলোর কথা। এর নানান সময়ে বয়স ছিলো ত্রিশ, তেতাল্লিশ ও শেষবার আটান্ন । প্রতি বারই আমার ভাগের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমি হেনস্থা হয়েছি। মোহাম্মদপুরের ঘটনাটা মজার।
তখন আমি দুই সন্তানের মা। আমি যথারীতি বাজারের পোশাক (হাতাওলা দৃষ্টি নান্দনিক নয় ‘সিরাম’ উর্ধ-জামা, প্রচুর বহরের চাদর সমতুল্য সূতীর ওড়না ও ঢোলা পাজামা) পড়ে ড্রাইভার রুস্তম সহ বাজারে গেছি। আমার বাঁধা মুরগীওলা, ডিমওলা ও মাছওলা সেরে এবার কিছু ডাল ও কালো জিরে কিনে কেনো যেনো মনে হলো কেউ আমাকে দেখছে। শত ভিড় হোক। নব্বুই হাজার বা নয়টা মানুষ হোক এ দেখাটা কেবল মেয়েরাই টের পায়। সঙ্গে সঙ্গে জন্মভ্যাসে ঢাকা গা আরো ঢেকে বুকের আকার নাই করে দিলাম। হাত ঘুরিয়ে পশ্চাৎ ও নাই করার চেষ্টা করলাম। হলো না। এবার চোখজোড়া কোন দিক থেকে আসছে তা সনাক্ত করে আমার সঙ্গে মোট বহনকারী ছেলেটাকে বললাম, বাবা আমার পিছে পিছে হাঁট্তো। চোখগুলো কাছে আসছে।
পিচ্ছিল পানি ভরা বাজারের ঐটুকুতে ভিড় বাড়ছে। ভাবলাম পালঙ আজ শাক নাই কিনলাম। চিঙড়িগুলো ফ্রিজে থাকা অর্ধেক কদু সর্ষের তেলে ফোঁড়ন দিয়ে হাল্কা মশলা সহ এক্টু থেতো করে ঘুঁটে ধনে পাতা দিয়ে রাঁধলেই হবে। আজ বাড়ি চলে যাই। কিন্তু লোকটা গেলো কোথায়? ভাবতে না ভাবতেই বুঝি কার একটি হাত আমার বাঁ’বুকে! পয়সার ব্যাগতো আগেই স্কুল ব্যাগের মতো গলায় ঝুলানো ছিলো। এবং আমিও সতর্ক ছিলাম। আমি সাঁ করে ঘুরে একহাতে লোকটার গালে ঠাস্ চড় মেরে অন্য বাঁহাতে তার হাত ধরে ফেললাম।
মূহুর্তে যেন পুরো বাজার থেমে গেলো। একটি মেয়ে একটি লোককে এমন চড়াবার দৃশ্য তারা আগে দেখেনি। আমাদের যে আত্মীয়তা নেই তা বোঝা যাচ্ছে। শ শ প্রশ্ন। জনতা আমাদের তিনজনকে ঘিরে জমে যাচ্ছে। আমি লোকটির হাত ধরে কাঁপ্ছি। এখন কি হবে? হঠাৎ মিন্মিনে গলায় বল্লো, আপনি আমার হাত ধরসেন ক্যান? কথাটা প্রশ্ন হলেও তা প্রশ্নের মতো ছিলো না। আমি সেভাবেই কাঁপতে কাঁপতে বললাম, বলবো কেনো? একথাও ছিলো না কোনো উত্তরের মতো। ততক্ষনে আমি বুঝেছি ঘটনা আমার আয়ত্বর বাইরে চলে যাচ্ছে।
জটলা যেরকম বড় হয়ে উঠেছে হয়তো পুলিশ আসছে, হয়তো কেউ ফটোও তুলে ফেলছে, হয়তো এখান থেকে আমার আর দুধের বাচ্চার কাছে দুধ খাওয়াবার সময় ফিরে যাওয়া হবে না। ঠিক তক্ষুনি দেখি ভিড় ঠেলে অন্যদিক থেকে এক আঠারো বা কুড়ির এক হাল্কা পাত্লা যুবক ঐ ছাচ্চোড়ের হাত আমার হাত থেকে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জোরে জনতাকে বল্লো, আমি দেখেছি কি হয়েছে। আপনি যান্তো! আমি তখন একটা বাইলা মাছের মতো ভিড় সাঁতরে কোনো ক্রমে টোকাইটাকে টাকা দিয়ে বসলাম। রুস্তমকে বললাম, বাড়ি চলেন। আজ আর খালামনির বাসায় যাবো না। উফ্!!
আমি এখন বাকি ঐ দু’বারের আমার ঢাকার রাস্তায় হাঁটার গল্পগুলো ও এভাবে স্ববিস্তারে বলতে পারি। কিন্তু বলছি না। অনুমান করে নিন। এদিকে ততদিনে আমার বয়স ষাট ছূঁই ছূঁই হয়ে গেছে। তবু কি আমার নিস্তার মিলেছে? দিনে দুপুরে প্রতিবারই এভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। যখনি কেউ আমার দেহে কোথাও না কোথাও হাত দিয়েছে। আমাদের কাল গেছে। এখন ঢাকায় বসবাসরত আমার কন্যারো বয়স চল্লিশ। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম তার জীবনে অনুরূপ ধারাবাহিক ঘটনার সর্বশেষটি নিয়ে স্টেটাস দিয়েছে। সে দেখতে অনেক ছোট খাঁট্টো এবং সব সময়েই শাড়ি মেয়ে। এখন ওর মেয়েও পনরো বছরের। ঈশিতা ইঙ্গিতে যা লিখেছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, আবারো ঘুরে জবাব দিলাম। এবার কি বুঝবে ওরা ছোট্ট হলেও আমরা অশক্ত নই!
ফিরে যাচ্ছি সেই আমাদের ভাগের রাস্তার কথাতে। তারপর এত বছর গেছে। আমি দেশে থাকি না, থাকে আমার পুত্র কন্যা দু’জনই। ঈশিতা আজাদের বর্তমান স্টেটাসে মনে হলো সত্যি, বাংলাদেশে কবে সেইদিন হবে যে মেয়েরা তাদের ভাগের রাস্তাটা পাবে? এসব পিটাপিটি ছাড়াই। আমরা সমান খাঁড়া হয়ে হয়ে হাঁটতে পারবো? রাস্তাটা কিন্তু সবার।