শামীম আহমেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করা শামীম আহমেদ লেখালেখি পছন্দ করেন।

নারী মুক্তির আন্দোলনের ক্ষেত্রটা আরো বড় হওয়া চাই! চাই ভাবনারও বিস্তার!

“Sapiens: A Brief History of Humankind” ইউভাল হারারির লেখা অবশ্যপাঠ্য একটি বই। বইটির একটি অধ্যায়ে চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্বের চুম্বক অংশ “Survival the fittest” (পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারা জীবেরাই বেঁচে থাকে) নিয়ে আলোচনা করেছেন। আসলে কিঞ্চিৎ সমালোচনা করেছেন বলা যায়। তিনি সেখানে দেখাতে চেয়েছেন সব সময় “Survival the fittest” কথাটি সত্য নয়। এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি আমেরিকা ও ইউরোপের প্রিয় খাবার বিফ স্টেইকের কথা বলেছেন।      

বিফ স্টেইকের ফিলে বা মাংসের টুকরো সাধারণ গরুর মাংস দিয়ে তৈরি  হয় না। স্টেইকের মাংস উৎপাদনে গরুকে আলাদাভাবে বড় করা হয়  ফার্মে। ধরা যাক, একটি গরু যদি লম্বায় ৮ ফুট আর প্রস্থে ৪ ফুট হয় তাহলে গরুকে রাখার বাক্সটি তারচেয়ে কিছুটা বড় সাইজের হয়। যেখানে গরু শুধু দাঁড়িয়ে আর বসে থাকতে পারে। কিন্তু কোথাও ছোটাছুটি বা নড়াচড়া করতে পারে না। গরুটি তার জন্ম থেকে পূর্ণ বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ঐ একটি কাঠের বাক্সেই সারা জীবন কাটায়। সেখানেই তার খাওয়া দাওয়া, প্রকৃতির  ডাকে সাড়া দেওয়া। সে যখন বাক্স থেকে মুক্তি পায় তখন আসলে মৃত্যুর জন্যে মুক্তি পায়। অর্থাৎ তাকে যখন জবাই বা ইলেকট্রিক শক দেয়া হবে ঠিক তখনই সে ঐ বাক্সের খাঁচা থেকে বের হতে পারে। কথা হলো  এমনটা কেনো করে? এর কারণ, সারাজীবন একটি বাক্সে বড় হবার ফলে তার মাংসপেশী শক্ত হবার সুযোগ পায় না। মাংস হয় নরম মোলায়েম। স্টেইকের আসল স্বাদ যে নরম ও মোলায়েম মাংসের মাঝেই।    

এই উদাহরণের মাধ্যমে ইউভাল হারারি দেখিয়েছেন গরুটিতো অনেকদিন বেঁচে থাকলো, কিন্তু কিভাবে বেঁচে থাকলো, কি জীবন নিয়ে বেঁচে থাকলো, এই জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা  আর মারা যাওয়ার মধ্যে আসলে পার্থক্য কোথায়? আর তার বেঁচে থাকায় তার ভূমিকা কতটুকু?  তিনি এমন আরো উদাহরণের কথা বলেছেন।  এ আলোচনায় এ উদাহরণটি প্রয়োজনীয় মনে করলাম। এখন আপনারা ভাবতে থাকুন আমাদের সমাজে এমন কোনো উদাহরণ চোখে পড়ে কিনা?

নারীর অধিকার বা সমতা বা স্বাধীনতা নিয়ে অনেকেই কথা বলতে চান কিন্তু নিজেকে নারীবাদী বলতে চান না। তার কাছে নারীবাদী শব্দটা একটা গালির মতো নাকি লাগে। আমাদের দেশে  এমন হয় কেনো? স্রোতের বিপরীতের মতবাদগুলো গালিতে পরিণত হয়ে যায় কেনো? এখানে নারীবাদী, নাস্তিক, বামপন্থী সবই একটা গালির মতোই শোনায়। স্রোতের বিপরীতে থাকা মানুষদের আসলে স্রোতে গা ভাসানো মানুষরা পছন্দ করে না। এই জন্যে কি এমন? নাকি স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষদের কর্মকান্ডই তাদের গালির পাত্র করে তোলে? আমি আমার অনেক পরিচিত জনকে বলতে শুনেছি, “আমি আসলে নারীর সমান অধিকার চাই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তবে আমি নারীবাদী না।“ নারীবাদী হলেই কি সমস্যা আমি জানি না। বরং নারীবাদী না হয়ে সমাজে মানবিক হওয়ার পূর্ণতা কোথায়? নারীবাদী শব্দটা কাঁধে নিতে খারাপ লাগে অথচ এর উদ্দে্শ্য সমর্থন করে, এর মধ্যে অবশ্যই একটা কিন্তু আছে। এই কিন্তুটা আসলে কি, তা  নারীবাদীদেরকেই বের করতে হবে নিজেদের সমালোচনার মধ্য দিয়ে। আন্দোলন যাদের, তাদেরই দায়িত্ব আন্দোলন সফল করার। যাহোক এ কথা আসলে বলতে চাইনি। তবুও এসে গেলো সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার জের ধরে।

বাসে বসে আছি। হঠাৎ করে তীব্র কন্ঠস্বর কানে আসলো। এমন কণ্ঠস্বর বাসে সাধারণত শোনা যায় না। অন্তত ২০ জন বাস যাত্রী একসাথে ঘুরে তাকালো। তাদের মধ্যে আমিও একজন। কৌতুহল, এমন গলাতো পাবলিক প্লেসে শোনা যায় না। আমাদের সবার কৌতুহলের প্রধান কারণ কন্ঠটা একজন মেয়ের। যা সাধারণত বাসে অপ্রত্যাশিত। মেয়েটি যতো না জোরে কথা বলেছে তার চেয়ে তীব্র হয়ে আমাদের কানে লেগেছে কারণ কন্ঠটা একজন মেয়ের। সে কৌতুহলী মানুষের মধ্যে আসলে পুরুষ নারী তরুণ তরুণী সবাই ছিলো।  আসলে আমাদের সবার কাছেই মেয়েদের বিশেষ করে তরুণীদের গলার উচু  স্বর পাবলিক প্লেসে কিংবা ঘরে কোথাওই গ্রহণযোগ্য না। তবে বিছানায় হলে ভিন্ন কথা।  এমন হাজারো অসঙ্গতি নিয়েই বড় হচ্ছে এদেশের নারীরা। সে সবের কথা প্রায়ই লেখায় আসে। তবে এই ছোট্ট গল্প করার আসল উদ্দেশ্য অন্য জায়গায়।

বেগম রোকেয়া নারীদের যে মুক্তি চেয়েছিলেন তা হুমায়ূন আজাদের যুগেও আসেনি। যা এসেছে তা অনেক আগেই বেগম রোকেয়া, ইউরোপের নারীদের তথাকথিত মুক্তিকে  দেখে আক্ষেপ করেছিলেন। আমাদেরও এখন আক্ষেপ করতে হয় আমাদের মেয়েদের তথাকথিত স্বাধীনতা দেখে। আমি অনেকক্ষেত্রে দেখেছি আসলে অনেকেই স্বাধীনতায় তেমনটা আগ্রহী না। আবার অনেকের আগ্রহ একটা সময় মরে যায়। দুইটা ঘটনারই নিজস্ব যুক্তি আছে। অনেকেই ভাবতে পারেন সেটা ধর্ম। আসলে ধর্ম এখানে অনেক পরের বিষয়। সেটা কেনো পরে বলছি।

আসল বিষয়টা ক্ষেত্র। নারীরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে মুক্তির স্বাদ নিবে। নিজের কল্পনা আঁকবে। নিজের জীবন গড়ে তুলবে সে জায়গাটা নিরাপদ না। কে না চায় মুক্তির স্বাদ? মার্টিন লুথার কিং যে গ্রেটার ফ্রিডমের কথা বলেছেন সেটা আসলে ব্যাক্তি স্বাধীনতার কথাই বলেছিলেন। একজন মানুষ তার মুক্তির জন্যে কখনোই না বলবে না। কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েরা না করেছে করছে এবং করবে (ব্যতিক্রম আছে তবে তারাও একটা সময় পরে নীরব হয়ে যায়)। কারণ তার দাঁড়ানোর জায়গাটা নিরাপদ না। সে ঘরকেই নিরাপদ ভাবে। নিজে  প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত স্বামীর স্বপ্ন দেখে।

অথচ দেখবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা, বুদ্ধীজীবীরা বার বার বলতে  থাকবে মেয়েদের ঘর থেকে বের হতে হবে, বের হতে হবে। আচ্ছা ঘর থেকে তনু বের হয়েছে, রুপা বের হয়েছে আরো হাজারো নারী তাদের কথায় বের হয়। কিন্তু ঘরে ফিরে লাশ হয়ে, ধর্ষিতা হয়ে। বের হবার কথা বলেন অথচ বের হবার জন্যে নিরাপদ জায়গাটার কথা বলেন না কেনো? এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিরাপদ জায়গা তাহলে কে করে দিবে? আসলে কেউ করে দিবে না। সবাই করে দেয়ার নামে রাজনীতি করবে, বুদ্ধীজীবীরা কলাম লিখে সংসার চালাবে। কেউই করে দিবে না। এটা আদায় করতে হবে। সেই আদায়টা আসলে আন্দোলন। এখন সে আন্দোলনকারীরা যদি একে অপরে নিজেরাই লেগে থাকে তাহলে মুক্তি কোথায়? যে উদ্দেশ্যে এতো লেখালেখি সেখান থেকে সরে অন্য কিছু নিয়ে পড়ে থাকলে আর কতটুকু আগানো যাবে?

কয়েকটা ম্যাগাজিন, ওয়েবসাইট, ব্লগ আন্দোলনের অংশ হতে পারে। পুরো আন্দোলন না। অফিসের কাজের ফাঁকে অথবা ঘরের এসিতে বসে দুটো ব্লগ পোস্ট লিখে দেয়া, মাঝে মাঝে  নারী সংগঠনে পিকনিক করা শহুরে আন্দোলনের অংশ। কিন্তু গ্রামে? আন্দোলনটা সামগ্রিক হওয়া চাই। এখনতো আন্দোলন আরো বেগবান শক্তিশালী হবার কথা। কিভাবে?

শফি হুজুর কথায় কথায় ১৩ দফার হুংকার দেয়। সরকারও নতজানু। সরকার এমন এক বস্তু যা শক্তের ভক্ত নরমের যম। শফি হুজুর মতিঝিলে যা দেখিয়েছে তাতেই সরকার কাবু। এখন শুধু উদ্দেশ্য আদায় করে নেয়ার পালা এবং তারা উদ্দেশ্যে হাসিল করেছেও।

নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এ চাপটা কই?  বরং এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে থেকেও, বাল্যবিবাহ বৈধ হয়ে যায়। বলতে পারেন চাপ দেয়ার ক্ষমতাটা কই? বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এর মাধ্যমেই দেশ সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। আর এই বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠিত নারীদের হাতে। শুধুমাত্র ধর্ষন বন্ধের আন্দোলনে যদি কাল থেকে নারীরা গার্মেন্টসে যাওয়া বন্ধ করে দেয় অন্য কাজ খোঁজা শুরু করে অবস্থাটা কি হবে বুঝতে পারছেন? দেশের প্রবৃদ্ধির কোথায় নেমে যাবে বুঝতে পারছেন? সরকারের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। শফি হুজুর ১৩ দফার চাপ দিলে নারীবাদীরা কেনো আরো বিশেষ দফায় সংগঠিত হচ্ছে না। যে দফাগুলো হবে এদেশে নারীর অধিকার আদায়ের ম্যাগনাকার্টা। প্রয়োজন শুধু অধিকার আদায়ে, সমতার আন্দোলনের মানুষগুলো শহর ও গ্রামে দুই পাশ থেকেই সামগ্রিকভাবে সংগঠিত হওয়া। এখানে সহিংস আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে না, অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকার কথা বলা হচ্ছে। এতোগুলো ধর্ষণ হলো বিচার হয়েছে কয়টার?  সরকার নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। কেউ একজন ধর্ষিতা হলে তার বিচার না করে ধর্ষিতার ভাই বোনকে চাকরি দিয়ে দিচ্ছে। কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিচ্ছে। বিচার আর করছে না। করছে না কারণ কেউ সরকারকে চাপ দিচ্ছে না। যেহেতু নারীবাদী মানুষগুলো নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলে লেখালেখি করে তাই তাদেরই আসলে এগিয়ে আসা উচিত। তারা এগিয়ে এসে কয়েকটি ঘটনার বিচারে সমর্থ হলে এদেশের নারীরা আশার আলো দেখতে পাবে। তখন তাদের তত্ত্বকথাও তারা আমলে নিবে। কোনো দৃষ্টান্ত না দিয়ে শুধু তত্বকথায় আসলে কেউ আস্থা রাখবে না। সরকার যদি শক্তের ভক্ত নরমের যম হয় ঔষধটা ঐরকম হওয়া চাই। ক্ষেত্রটা নিরাপদ হলে, মুক্তির হলে আপনি নিজেই পরখ করতে পারবেন নারী মুক্তিতে ধর্মীয় বাঁধার ক্ষমতা কতটুকু?

এখন আসি উপরের সেই স্টেইকের গল্পে। এতোক্ষণে অনেকেই ধরে ফেলেছেন আমাদের সমাজে এমন স্টেইকের মাংসের গরু হিসেবে কারা বড় হচ্ছেন? কথাটা শুনতে কটু শোনা গেলেও, আপনাকে যারা নরম, কোমল, ভদ্র, বিনয়ী, সংযমী হবার নামে সব কিছু মুখে বুজে সহ্য করতে বলে, মেনে নিতে বলে তারা আপনাকে কারো স্টেইকের নরম মোলায়েম স্বাদের মাংস হিসেবেই বড় করছে। মানুষ হিসেবে নয়। এখন বুঝে নেয়ার দায়িত্ব আপনার, আপনি কিভাবে বড় হবেন। দিনশেষে জীবনটা আপনার!

1647 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।