আচ্ছা, একবার ভাবুন তো– আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে নারীরা ইমামতি করছেন। তার পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন এলাকার মুসল্লিরা! দৃশ্যপট কেমন হবে? আদতে এ দৃশ্যটি কল্পনা করতেই ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে এর চিত্রায়ন করা কঠিন। কেননা এ সমাজে একজন নারীর ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে মুসল্লিদের আত্মসম্মানবোধে লাগবে। তবে এই আত্মসম্মানবোধ কেবল মাত্র জাগ্রত হবে– নারী ইমামের পেছনে নামাজ পড়া থেকে শুরু করে সমাজে কোনো নারীর এগিয়ে যাওয়া দেখলেই। অথচ, মসজিদের কোনো পুরুষ ইমাম চোর, লম্পট, লুচ্চা হলেও তার পেছনে দাঁড়াতে কারো কোনো আপত্তি নেই। স্বয়ং দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিও ওই চোর, লম্পট, লুচ্চা ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে সম্মানবোধ করবেন- কেননা তিনি পুরুষ। ওই যে কথায় আছে না– 'সোনার আংটি বাঁকা হলেও সোনা-ই!'
১. এই তো, বছরখানেক আগেই 'নারী কাজী' নিয়ে দেশে বেশ সরগরম অবস্থা ছিলো। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৪ সালে। দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ার পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হিসেবে তিনজন নারীর নাম প্রস্তাব করা হয়। তিন সদস্যের ওই প্যানেলের বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় একই বছরের ১৬ জুন। তবে আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ মর্মে চিঠি দিয়ে তিন সদস্যের প্যানেল বাতিল করে দেয়। এর প্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) প্যানেলের এক নম্বর প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা।
তবে হতাশাজনক বিষয় এ রিটের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে রায় জানানো হয়– 'নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফিকেশনে থাকেন। যেহেতু বিয়ে একটি ধর্মীয় ও পবিত্র বিষয় সেহেতু নারীরা এ কাজ করতে পারবেন না!'
অথচ নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হওয়ার জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপনে তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে, ক. সরকার স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসাবোর্ডের নিবন্ধিত কোনো মাদ্রাসা থেকে কমপক্ষে আলিম সার্টিফিকেটধারী হতে হবে, খ. বয়স কমপক্ষে ২১ এবং সর্বোচ্চ ৪৫ বছর হতে হবে, খ. সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হতে হবে। তাহলে একজন নারী কেনো নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হতে পারবে না?
ঋতুস্রাব বা মাসিকের কারণে? এটা অপবিত্র বিষয়! মাসিক হলে নারীরা অপবিত্র হয়ে যায়, শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যায়? এর প্রেক্ষিতে অবশ্য আদালতের যুক্তি- যেহেতু বিবাহ একটি পবিত্র কাজ এবং ইসলাম ধর্মের বেশিরভাগ বিয়ে মসজিদে হয়(!) সে কারণে নারীরা যেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফাইড থাকে বা অপবিত্র থাকে মাসিকের কারণে সেহেতু তারা নিকাহ রেজিস্টার হতে পারবে না! অথচ আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এই যে, নিকাহ রেজিস্টার বা কাজী কখনো মসজিদে বিয়ে পড়ান না। এমনকি আমাদের দেশে বিয়ের কাজ মসজিদে হয়-ই না৷ ফলে আদালতের এ ভাওতাবাজি আদতে কাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া? পুরুষতন্ত্রের! তবে কি আদালত পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী? মেনে নিতেই পারি– যেখানে পুরুষতন্ত্র দ্বারা সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সেখানে আদালত-ই বা রক্ষা পাবে ভাবা যায় কি করে!
২. একবিংশ শতাব্দিতে এসে এসব মেনে নেয়া যায়? দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী, অমুক নারী তমুক এসব কথা শোনা যায় মাঝে মধ্যেই৷ কিন্তু মননের কুসংস্কার, পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী আচরণ যা যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে প্রজন্ম, তা শতাব্দী এগিয়ে গেলেও– গুটি কয়েক নারী মন্ত্রী বা অমুক-তমুক কাজে জড়িত হলেও ধুয়ে মুছে মিশে যাবে না৷ 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি' নামক কলকাতার একটি সিনেমায় সংলাপ রয়েছে এমন– 'শুধু ন্যাপকিন বিতরণ করে কিছু হবে না- মানুষের ভেতরগুলো যদি বদলাতে না পারি! মনের ভেতর গেঁথে থাকা অচলায়তন, এত কুসংস্কার– শুষে নিতে অনেকগুলো ন্যাপকিন লাগবে।' ন্যাপকিন; এই ন্যাপকিন মেয়েদের হাতে সপ্তাহান্তে পৌঁছে দেয়া ন্যাপকিন নয় কিংবা ন্যাপকিনের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে হরেক রকমের ক্যাপশন জুড়ে হৈ-হল্লা তৈরি করা সে ন্যাপকিনও ন। এ ন্যাপকিন শিক্ষার ন্যাপকিন। যেটার বড় অভাব আমাদের সমাজে। এই যে মাঝে মাঝেই দেখা যায় কিশোরী, তরুণীদের জমায়েত করে তাদের হাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন তুলে দিতে, ফেসবুকে তার ছবি তুলে শেয়ার করতে৷ তা এই মানুষগুলো এর পাশাপাশি ওই কিশোরী-তরুণীর মা-বাবাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন, মেয়ের ঋতুস্রাব বা মাসিকের ব্যাপারে বুঝিয়েছেন বা বুঝাবার চেষ্টা করেছেন? যে সমাজে এখনো মেয়েদের মাসিককে অচ্ছুৎ ভেবে নাক ছিঁটকানো হয়, স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে বন্ধুদের মাঝে খোলা আলোচনা হলে পাশ থেকে কেউ বলে বসেন– 'সব জায়গায় টয়লেট নিয়ে আসলে থাকবোটা কোথায়!' সেখানে হাতে হাতে ন্যাপকিন বিতরণ করা গেলেও এর বিরুদ্ধে নাক ছিঁটকানোর কুসংস্কার মগজে বিঁধেই থাকবে।
ফলে ন্যাপকিন বিতরণের পাশাপাশি পরিবারের সবাইকে ঋতুস্রাব বা মাসিক এবং ন্যাপকিনের বিষয়ে সচেতন করার কাজটাও গুরুত্ব সহকারে করতে হবে। অর্থাৎ এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার বিস্তার ব্যাপকভাবে জরুরি।
৩. সাম্যের লড়াই, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার লড়াই। হিন্দু বিয়েতে ছেলে যেমন মেয়ের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেন তেমনই মেয়েটিও ছেলের কপালে সিঁদুরের তিলক এঁকে দিয়ে সাম্যের একটি পথ খুলে দিতে পারেন। এমনই এক দৃশ্যপট অঙ্কিত হয়ে 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি' নামক সিনেমায়৷ এ নিয়ে একটি চমৎকার ব্যাখ্যাও রয়েছে সিনেমাটিতে৷ শাঁখা-পলা, সিঁদুর এসবের সঙ্গে মিশে আছে ভালোবাসা– চাইলেই তা অমান্য করা যায় না। তবে এই যে নিজের সিঁথি থেকে মেয়েটি ছেলের কপালে তিলক এঁকে দিলো– এতে সাম্যের পথ কিছুটা হলেও মসৃণ হলো৷ আসলেই তাই, আপনি যখন একটি গাছ কাটবেন সেটাকে একটু একটু করে সাইজ করে কাটতে হবে। আপনি এক কোপেই আস্ত একটা গাছকে কেটে ফেলতে পারবেন না এবং এক কোপেই সেটা সাইজ মোতাবেক হয়ে যাবে না৷ ফলে আজকে হিন্দু-মুসলিম বিয়ের রীতি অনুসারে মেয়েকে ছেলের হাতে তুলে দেয়া বা কন্যাদান নামক রীতিকে অমান্য করুন৷ কালকে আরেকটি, পরেরবার আরেকটি– এভাবে একটি একটি করে অমান্য করতে করতে দেখা যাবে কুসংস্কারের বালাই নেই৷ তবে এসব অমান্যের ক্ষেত্রে পরিবারের কারো না কারো সাপোর্ট খুবই জরুরি৷ বিশেষ করে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম বাক্যটি যখন কোনো নারী উচ্চারণ করেন এবং দ্বিতীয় বাক্যটি যখন কোনো পুরুষ– সে যদি ওই নারীর ভাই, বাবা, স্বামী কিংবা কোনো বন্ধু হয় তবে ওই নারী পরের কথাগুলো বলার এক দারুণ সাহস পাবে৷ ফলে আমাদের সমাজে নারীর অধিকার, সাম্যের কথা, পুরুষতন্ত্র ভাঙার কথা নারী শুরু করার পরপরই পুরুষকে বলতে হবে– 'আমরাও আছি সাম্যের পথে, পুরুষতন্ত্র ভাঙার লড়াইয়ে।'
ইতি টানার আগে শুরুর কথাতে ফিরে যাই। কর্তৃত্ব– পুরুষতন্ত্র কেবল কর্তৃত্ববাদ টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্মের কাঁধে ভর করেছে এবং এখনো টিকে আছে৷ নানা ধরনের কুসংস্কারকে মানুষের মগজে সেঁদিয়ে দিয়েছে নানা রকম ছল ছুতায়; সেটাকে ভাঙতে হবে৷ ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফাইড, অপবিত্র; হেনতেন কু-যুক্তির অন্তরালে পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী চেহারা, নারীকে ভোগ করার মতলব, তাদেরকে দাবিয়ে রেখে চলাটাই লক্ষ্য৷ আর এটা বুঝতে হলে সামাজিক ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে লৈঙ্গিক বৈষম্য মুক্ত শিক্ষা৷ যা মানুষের মনন থেকে শুষে নিবে যুগ যুগ ধরে লালিত কুসংস্কার– স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো।