দিলশানা পারুল

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পড়াশোনার পাশাপাশি লম্বা সময় ধরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে যুক্ত ছিলেন দিলশানা পারুল। দশ বছর বামপন্থি রাজনীতির সাথে ‍যুক্ত ছিলেন, তারপর দশ বছর এনজিওতে শিক্ষা গবেষনা এবং বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় এডুকেশন সেক্টরে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি অনলাইনে লিখালিখি করেন।

সাজগোজ নারীর পরাধীন চিন্তার ইন্ডিকেটর বা চিহ্ন

আমরা মেয়েরা যখন সাজি দুইটা কথা খুব বলি। এক -আমার ভালো লাগে তাই সাজি। আমিতো কোনো পুরুষের জন্য সাজছি না। পুরুষের জন্য সাজায় সমস্যা আছে নিজের জন্য সাজায় কোনো সমস্যা নাই। দুই -আমি সাজবো কি সাজবো না এইটা আমার সিদ্ধান্ত এইটা আমার অধিকার। ফুটবল খেলতে আমার ভালো লাগে না। দাবা খেলতে আমার ভালো লাগে না। নাচলে আমার ভালো লাগবে এই রকমও না। অংক করতে আমার ভালো লাগে এইটাও না। মেয়ে হিসেবে সব মেয়ে গান গাইলে ভালো বোধ করে এরকমও না কিন্তু। কিন্তু সাজলে আমার ভালো লাগে।

শতকরা ৯৯.৯ ভাগ মেয়ে (আমার ধরনা এবং অবজারভেশন) সাজলে নিজেকে সুন্দর মনে করে এবং ভালো বোধ করে। যে যত কড়া সাজি সে নিজেকে ততখানি সুন্দর লাগছে ভাবি। ধরেন এই যে সাজলে আমার ভালো লাগে এই বোধটা তৈরি হলো কোথা থেকে?

আধুনিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা শত শত বছর ধরে নারী সৌন্দর্যের একটা সংজ্ঞা দাড় করিয়েছে। সেই সংজ্ঞায় মেয়েরা নিজেকে ঠিক কি ভাবে উপস্থাপন করলে সুন্দর দেখায় বা দেখাবে তা সুর্নিদিষ্ট করা আছে। আপনি কামাসূত্রের মতো প্রাচীন পুথিতে যে চৌষট্টি কলার উল্লেখ পাবেন সেইখানেও নারীর সাজগোজের উল্লেখ পাবেন।

প্রাচীন ভারতীয় পুথিতে পুরুষকে আকষর্ণ করতে গেলে নারীর কি কি করতে হবে এই জাতীয় যা লিখা পাবেন সমস্ত কিছুতে নারীর সৌন্দর্য কে ফুটিয়ে তোলার বিষয়টা পাবেন। সাজ সজ্জা নারীর দৈহিক সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলার বাইরে কি আসলে আর কিছূ? প্রচীন পুথি থেকে শুরু করে বর্তমানে লরিয়ালের মতো প্রডাক্ট সবাই চেয়েছে এবং চায় নারী তার দৈহিক সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলে আকর্ষনীয়া হোক।

নারী সাজসজ্জা করুক। এই যে আমার ভালো লাগার বোধ এইটা কি আসলে আমার স্বাধীন চিন্তা? না পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শর্তারোপিত চিন্তা হচ্ছে সাজলে নারী নিজেকে সুন্দর মনে করবে, ভালো বোধ করবে! ঠিক কি কি ভাবে সাজলে নারীকে ভালো লাগবে সেইটাও পুরুষের চাহিদা অনুযায়ীই সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়ে এসছে। সাজলে নারীর ভালো লাগার যে বোধ/চিন্তা সেইটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিন্তার উপাদান ছাড়া আর কিছু না।

আমি যখন বলছি আমি নারিবাদী, নারী হিসেবে আমি আমার স্বাধীন বক্তব্য উপস্থাপন করছি তখন সেই আমিই যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে ঠিক যেভাবে দেখতে চায় সেইভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করছি সেটা স্ব বিরোধী অবস্থান। নারিবাদী কথা বলা যত সহজ চর্চা করা ঠিক ততখানিই কঠিন। এমনকি আমি নিজেও যখন সাজি তখন নিজের বক্তব্যের বিরুদ্ধে যেয়েই সাজি।

এবার আসেন অধিকার শব্দটায়। নারীর সাজসজ্জা আসলে নারীর অধিকার চর্চার অংশ কি না? পৃথিবীতে আমাকে একটা পুরুষ দেখান যে নারী সেই ব্যাক্তি পুরুষের রুচি মতো সাজলে অখুশি হয়। আমাকে প্রচলিত সমাজের বাবা মা বা সমাজের একটা চরিত্র দেখান যে নারীর সাজগোজ নিয়ে অখুশি। নাই পাবেন না। তার মানে সাজগোজ করা নারীর কোনো অধিকার সচেতন অবস্থান না। এইটা নারীর পরাধীন চিন্তার অন্যতম ইন্ডিকেটর বা চিহ্ন। এই কথাগুলায় অনেকেই নাখোশ হবে তাতে ফ্যাক্টস পাল্টাবে না। এমন কি ভিন্ন মতও নিয়ে হাজির হতে পারেন তাতও ফ্যাক্টস পাল্টাবে না। ঐতিহাসিক ফ্যাক্টস পাল্টানো যায় না। বিকৃত করা যায় হয়তো। আমরা ততটুকুই চর্চা করি যতটুকু চর্চা করতে আমার সুবিধা।

2422 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।