আমার অসম্ভব পছন্দের একটা গান হচ্ছে ‘সেই চম্পা নদীর তীরে, দেখা হবে আবার, যদি ফাগুন আসেগো ফিরে’। এই গানটার সুরকার হচ্ছেন আবু বকর খান। গানটির প্রথম গায়কও তিনি। পরবর্তীতে এই গানটা খালিদ হোসেন গেয়েছেন। বেশিরভাগ শ্রোতা খালিদ হোসেনের গাওয়া গানটার কথাই জানেন, আবু বকর খানের গাওয়া গানটা হারিয়ে গেছে কালের অতল গর্ভে।
‘সেই চম্পা নদীর তীরে’- এই মিষ্টি গীতিসমৃদ্ধ রোম্যান্টিক গানটার গীতিকার হচ্ছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। শুধু এই গান নয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা রোম্যান্টিক গান ‘তুমি যে আমার কবিতা’ গানেরও গীতিকার তিনি। এই দুটো গানই নয়, সেই ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরিণত বয়স পর্যন্ত, অসংখ্য গান লিখেছেন তিনি বেতার, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য। তাঁর গানে সুর দিয়েছেন আব্দুল আহাদ, খোন্দকার নুরুল আলম, সুবল দাস, সমর দাসদের মতো প্রখ্যাত সুরকাররা।
শুধু গীতিকারই ছিলেন না তিনি, ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার একজন মানুষ। কবি ছিলেন, প্রাবন্ধিক ছিলেন, ছিলেন সমালোচক এবং শিক্ষাবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসাবেও কাজ করেছেন।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলতে পারতেন। সেই আশির দশকে টেলিভিশনের অনেক অনুষ্ঠানেরই উপস্থাপনা করতেন তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এলে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর গানের অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেছিলেন তিনি। সেটাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ অনুষ্ঠান। ঢাকা থেকে কোলকাতায় ফিরে যাবার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মারা যান তিনি। কাকতালীয়ভাবে এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালও আকস্মিকভাবে হার্টফেল করে মারা যান। এই ঘটনা সেই সময় আমাদের অপরিসীম দুঃখ দিয়েছিলো। দু’জন গুণী মানুষ, যাঁরা মাত্র কিছুদিন আগে এক সাথে অনুষ্ঠান করেছেন, তাঁরা মারা গেলেন এমন অল্প সময়ের ব্যবধানে।
মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে একটা প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে আমার মৃত্যু আসন্ন। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আজ মধ্য রাতেই কাউকে না জানিয়ে চলে যেতে পারি।’ তিনি কি অনুমান করেছিলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন? খুব সম্ভবত। সে কারণেই হয়তো তাঁর জীবনের খুব লজ্জাজনক একটা কাজের জন্য অনুশোচনা করে গেছেন তিনি, সেই কাজটা না করলে কী-ই বা ক্ষতি হতো, সেই আক্ষেপ করে গেছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে একটু পরে আসবো আমরা।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর স্মৃতিহীন, বোধহীন ও ভালবাসাহীন’ প্রবন্ধে একাত্তরের স্মৃতিচারণ করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সেই অবরুদ্ধ স্বদেশের কথা কি আমাদের মনে পড়ে? মধ্যরাতে গুলির ধাতব গর্জনে বিদীর্ণ লোকালয়, মাঠ-প্রান্তরে স্তূপীকৃত নামহীন সহোদরদের মৃতদেহ কিংবা গঞ্জে-নগরে ভীত=সন্ত্রস্ত পলায়নপর মানুষের অন্তহীন শোভাযাত্রা? বারো বছর আগে এক অভিশপ্ত মার্চের উপান্তে যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের ঈগল ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ঘুমন্ত রাজশাহীর ওপরে - তার শোণিত-পিপাসা সহজে মেটেনি। জননীর সম্মুখে সন্তান, জায়ার সম্মুখে স্বামী, বোনের সম্মুখে ভাই সেই দুঃশাসনের তীব্র নখরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এক অবিশ্বাস্য অপ্রতিরোধ্য মড়কে উজাড় হয়ে গেছে বাংলাদেশের গ্রাম-শহর-বন্দর। শোকের লোবান জ্বলেনি কোনো ঘরে। পবিত্র শ্লোকের সুমধুর উচ্চারণে উচ্ছ্বসিত হয়নি লোকান্তরিতের জন্য কল্যাণ কামনা। এতো মৃত্যু বাংলাদেশ কখনো দ্যাখেনি।’
শুধু প্রবন্ধেই না। তিনি তাঁর ‘ছবি’ কবিতায় লিখেছেন,
“খাঁটি আর্যবংশ সম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ ন’টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা -কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যান গগ -যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন -কখনো শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দ্যাখেন নি।’
তাঁর এই প্রবন্ধের এবং কবিতার অংশ পড়লে, একাত্তরের প্রতি তাঁর ভালোবাসাটা টের পাওয়া যায়। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে, একাত্তরে তাঁর কর্মকাণ্ড তাঁর এই ভালোবাসার সাথে মেলে না। যে দুঃশাসনের তীব্র নখরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ, যার কারণে মৃতের স্তূপ গড়ে উঠেছে, যে মৃত্যু বাংলাদেশ আগে আর কখনো দেখেনি, সেই দুঃশাসনের হয়ে বেতারে কাজ করেছেন তিনি। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অনেক মানুষকেই প্রাণের তাগিদে, সংসার চালানোর তাগিদে পাকিস্তান সরকারের চাকরি করতে হয়েছে। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন। এতে সমস্যা নেই, দোষেরও কিছু নেই। যুদ্ধে সবাইকেই যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু, পাকিস্তানের প্রোপাগান্ডা মেশিন রেডিওতে কাজ করাটাকে ঠিক সহজভাবে মেনে নেওয়া যায় না। একাত্তর সালে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে তিপ্পান্ন জন শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক বিবৃতি দিয়েছিলেন। আবু হেনা মোস্তফা কামালও তাঁদেরই একজন ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে একটা তদন্ত কমিটি হয়েছিলো। সেই কমিটির নির্দেশে বেতার এবং টেলিভিশনে আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা অনেককেই নিষিদ্ধ করা হয়। অধ্যাপক আবুল ফজলের অনুরোধে পঁচাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঐ নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু, তারপরেও এই নিষিদ্ধ শিল্পীদের জায়গা ছিলো না বেতার এবং টেলিভিশনে। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসের পরে গিয়ে পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় এঁরা বেতার এবং টেলিভিশনে কাজ করার সুযোগ পান।
একাত্তরে বেতারে কাজ করার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেছেন যে, তাঁকে বাধ্য হয়ে এই কাজ করতে হয়েছিলো। মে মাসের ১৫ তারিখে সন্ধ্যায় একজন পাকিস্তানি অফিসারের নেতৃত্বে চারজন সৈনিক তাঁকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধরে নিয়ে যায়। চব্বিশ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে তাঁকে ছেড়ে দেয় তাঁরা। কিন্তু এর দুইদিন পরেই সেনাবাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার আসে। হাসতে হাসতে তাঁকে বলে, ‘If you want to remain safe and alive, you will have to do some radio programmes for us.’
এই হুমকিতে তিনি বেতারে কাজ করতে রাজি হয়ে যান। তাঁর ভাষাতেই বলি, ‘কেবল বেঁচে থাকার জন্যেই সেদিন পাকিস্তানী রেডিওতে অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু, আমি কি সত্যি বেঁচেছিলাম সেদিন? স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে প্রতিদিন দুর্বিষহ আত্মগ্লানিতে আমি কি রক্তাক্ত হইনি? অস্ত্র হাতে নেয়ার সামর্থ্য না থাকুক আমার কলম তো তাই বলে কখনো অক্ষম অপটু ছিলো না। সেই কলমে অসত্যের দাসখতে সই করেছি, কেন? আমার বেঁচে থাকা কি সত্যি এতো জরুরি ছিলো?’
কাপুরুষের গ্লানিময় শত বছর বাঁচার চেয়ে বীরের স্বল্পকালীন জীবন যে অনেক মহিমান্বিত, সেটা বুঝেছিলেন তিনি। কিন্তু, সেই বুঝ বুঝতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। ইতিহাস এবং সময় খুবই নিষ্ঠুর। একবার কেউ ভুল করলে, ভুল হিসাবের পথে পা বাড়ালে, সেই ভুল শোধরানোর আর সুযোগ দেয় না তাকে। আত্মবিলাপ, আত্ম-ধিক্কার আর আত্মগ্লানি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তখন। যেমন ছিলো না আবু হেনা মোস্তফা কামালেরও। সেই অনুশোচনা এবং আত্মধিক্কার আমরা খুঁজে পাই তাঁর মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগের এক লেখায়। সেখানে তিনি লিখেছেন-
“এই প্রশ্ন, এই ধিক্কার এখনো আমাকে নিয়ত ছিঁড়ে খুড়ে খায়। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে আমার বুক গৌরবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের মুখের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। কতো অল্প তাদের বয়স, কিন্তু কী ‘সাহস বিস্তৃত’ তাদের বুক। কথার ফুলঝুরি ফোটাতে জানে না এরা, অথচ কী গভীর ও সত্য তাদের দেশ প্রেম। এই সেদিন জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়ে আমার চোখের পাতা বার বার ভিজে উঠেছে অহংকারে আনন্দে, বেদনায়। রুমীর মতো বাচ্চা ছেলে যা পেরেছিলো আমি কেনো তা পারিনি? কিংবা জাহানারা ইমাম নিজে ভালবাসায় ব্যাকুল হয়ে স্বামী ও সন্তান বিলিয়ে দিলেন দেশের পায়ে, তার এক কণা আগুন আমার বুকে কেনো জ্বলে উঠলো না?
সেই তো মৃত্যু এসে দরজায় টোকা দিলো। এখন আর কোনো অজুহাতই টিকবে না। ব্যাধির ব্যাদিত মুখে আমি জয়ের উল্লাস দেখেছি হাসপাতালে। যেতে হবেই। অথচ কী কীটপতঙ্গের মতো এই যাওয়া। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৮; এই অতিরিক্ত সতেরো বছর বেঁচে থেকে যা পেয়েছি, এখন মনে হয়, একাত্তরের মৃত্যু তার চেয়ে অনেক-অনেক বেশি সম্মানজনক ছিলো।”