সারথি বিশ্বাস

প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, পশ্চিম বঙ্গ।

কীসে নেই পুরুষতন্ত্র?

আজকাল 'পুরুষতান্ত্রিক' শব্দটা ব্যবহার করলেও অনেক অ্যাড্রেনালিন খরচ হয়ে যাচ্ছে। খরচ-খরচার পরিমাণ বাড়ার ইঙ্গিতও আসছে কখনও কখনও। অ্যাড্রেনালিন খরচের পরিমাণ তো বাড়তেই পারে, এমনকি, সম্মান খরচ করতেও হতে পারে, রক্তও খরচ হয়ে যেতে পারে, প্রাণ খরচ করতে হলেও হতে পারে। কিছুই আশ্চর্য নয় আমাদের দেশে। তুচ্ছ কারণেই কাউকে হেনস্তা করার বাসনা জেগে ওঠে আমাদের মনে। বাসনা চরিতার্থ করতে সমবেতভাবে রাস্তায়ও নেমে পড়ি আকছার। অদ্ভুত এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এখন বাক্-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ আর সব স্বাধীনতা আমরা শুধু নিজের জন্যই চাই। অন্যের বেলায় হাতে খরচের খাতা ধরিয়ে দিই।

আমরা প্রত্যেকে আলাদা মানুষ। আমাদের চলন গমন অঙ্গভঙ্গির মতো দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের নীতি আলাদা হলে নীতিবোধ এবং নীতিবাক্যও আলাদা হবে সেইজন্য। ঐকমত্যে না-আসতে পারলে আমাদের মধ্যে মতবিরোধও থাকবে, থাকা উচিৎ আলোচনার পরিসরও। অসহিষ্ণুতাকে এড়িয়ে এভাবেই আমরা জড়িয়ে থাকি পরস্পর। এমনিতে পুরুষতান্ত্রিক শব্দটা কোনও গালাগাল নয়, কোনও অসম্মানজনক কথাও নয়। পুরুষতান্ত্রিক শব্দটা গালাগাল তো নয়ই, এমনকি, শুনতে পুরুষ পুরুষ হলেও এটা কোনও নির্দিষ্ট  লিঙ্গনির্দেশক শব্দও নয়। এটা আমাদের সমাজতান্ত্রিক মানসিকতার একটা প্রকাশ, আমাদের সামজিক দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। এটা পুরুষের মধ্যেও যেমন থাকতে পারে, নারীর মধ্যেও তেমন। অনেক নারীর মধ্যে পুরুষের থেকে কিছু বেশি পরিমাণেও থাকতে পারে। আবার অনেক পুরুষই পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে অনেকটাই মুক্ত। পুরোপুরিও হতে পারে।

আমাদের সমাজ মূলত পুরুষ কেন্দ্রিক এবং পুরুষ  পরিচালিত। সেই জন্য মেয়েদের একটু 'কম-মানুষ' ভাবার প্রবণতা আছে। সেই জন্য সমাজের আদি এবং প্রায় সব নিয়মকানুনই পুরুষদের প্রাধান্য, পছন্দ এবং সাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে তৈরি। একটা সমীক্ষা বলছে, পাবলিক টয়লেট থেকে গাড়ির সিট বেল্ট, সবই পুরুষের সুবিধামতো তৈরি হয়েছিলো। সমাজ মহিলা চালিত হলে এর উল্টোটা হতো নিশ্চয়ই। তখন আলোচনাটাও উল্টো পথে হাঁটত। আমাদের সমাজের প্রায় সব নিয়মকানুন, ন্যায়নীতি, আচার-আচরণের নির্মাণই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয়। অত দীর্ঘ আলোচনা এক সঙ্গে সম্ভব নয়, এখানে শুধু কিছু  সাজ-পোশাকের পুরুষতান্ত্রিক গড়ন নিয়ে কথা বলা হলো।

অনেকে মনে করতেই পারেন, আমি নিজে শাড়ি এবং  শাঁখাসিঁদুর পরি বলে এসবে পুরুষতন্ত্রের গন্ধ পাই না। ভালোই হলো, নিজেকে নিয়ে ক'টা কথা বলা যাবে এই অজুহাতে। শাড়ির প্রসঙ্গটা একটু আলাদা, তবে শাঁখাসিঁদুর পুরোপুরি পুরুষতন্ত্রের দান। আমাদের সমাজে আগে ছেলেরাও ধুতি পরতেন। সেটাও বারো হাত লম্বা  শাড়িকে  ম্যানেজ করে পরার মতোই সমান অসুবিধাজনক। সময় এবং সুবিধার  প্রয়োজনে ধুতি আর পাঞ্জাবি ছেড়ে কবেই প্যান্ট শার্ট ধরেছে পুরুষ। কিন্তু শাড়ি থেকে গেলো মেয়েদের জন্য। ধুতি পাঞ্জাবির সঙ্গে সুবিধা আর স্বাচ্ছন্দের প্রশ্ন ছিলো, তাই সহজেই তা ছেড়ে ফেলা গিয়েছে। কিন্তু শাড়ির আঁচলে বাঁধা ছিলো মেয়েদের ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি কারেক্টনেসের গল্প। শাড়ির সুতোয় বোনা ছিলো ভালোত্ব, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য। পুরুষের এসব বাড়তি বালাই নেই। এমনকি, আজও এই ভালোত্ব আর কারেক্টনেসের গাঁট, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ফাঁদ পুরোপুরি খোলা সম্ভব হয়নি। এইজন্য, এই যুগে দাঁড়িয়েও, যখন মেয়েরা ঘরে বাইরে কাজের জগতে সমান সক্রিয়, সুবিধা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজনে শিক্ষিকাকে বিদ্যালয়ে সালোয়ার-কামিজ পরে আসার অধিকার পেতে আইনের দারস্থ হতে হয়। ওই নির্দিষ্ট কেসের ভিত্তিতে আদালত আদেশ দেয়, যে-কোনো রুচিসম্মত পোশাক পরে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করা যাবে। এর পরেও কিন্তু আমরা শাড়ির পক্ষেই সওয়াল করি, 'স্কুলে শিক্ষিকাদের জন্য শাড়িই পারফেক্ট'! 

হ্যাঁ, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সময়ের প্রেক্ষিতে মেয়েদের পোশাকেও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু একটা বিরাট অংশের মানুষ শাড়িকেই সভ্য এবং সম্মানীয় পোশাক মনে করেন এখনও। ব্যক্তিগতভাবে শাড়ি আমারও পছন্দের। সালোয়ার-কামিজও আমার খুব পছন্দ। কিন্তু  আমি সালোয়ার-কামিজ পরি শুনলেও ভুরু কোঁচকান আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকার অনেকে। বাংলায় এমন এলাকা এবং এমন ব্যক্তির অভাব নেই বলেই আমার ধারণা। তাঁদের কাছে শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাক-পরা বউ মানেই বাগ না-মানা, কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল। শাঁখাসিঁদুর বিহীন সধবা তো আরও অকল্পনীয়, ব্যভিচারীর নামান্তর। তো, যাঁরা আমার মতো দুর্বলচিত্তের, যাঁরা নিজের চরিত্রে এমন অকারণ দাগ লাগাতে চান না, এবং নিজের সুবিধা আর সাচ্ছন্দ্যও ত্যাগ করতে পারেন না, তাঁরা আমার মতো সচরাচর শাড়িই পরেন, আর লুকিয়ে চুরিয়ে সময়-সুযোগ বুঝে সালোয়ার-কামিজ বা পছন্দের অন্য পোশাক পরেন। এমন নয় যে, সালোয়ার-কামিজ পরে শ্বশুর বাড়ি ঢুকলে ওখানকার লোকজন আমাকে যাচ্ছেতাই কিছু করবেন। হয়তো সামনে কিছুই বলবেন না। আবার এমনও নয় যে, ওখানে একজন বউও শাড়ির বাইরে অন্য পোশাক পরেন না। কিন্তু নিন্দার ঢেউ ওঠে তাতে, সমাজে ভালো বউয়ের তখমাটা হাতছাড়া হয়ে যায়। এই বস্তাপচা হাততালির জন্যই আমি শাড়ি পরি। শাঁখাসিঁদুর পরি। এমনও নয় যে, কেউ আমাকে শাঁখাসিঁদুর পরতে জোর করে। কিন্তু না-পরলেও সমাজ ভালোভাবে নেবে না, এ-বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই শাড়ি, হাতের শাঁখা, সিঁথির সিঁদুর, পায়ের আলতা পরা না-পরা নিয়ে মেয়েরাই বেশি মাথা ঘামান। তাঁরা নিজে ঘামেন এবং অন্যদেরও ঘাম ঝরিয়ে ছাড়েন। যাঁরা সমাজিক চাপের এই ফল্গুধারাকে চেপে দিতে পেরেছেন তাঁরা শাড়ি, শাঁখাসিঁদুরকে হয় অস্বীকার করছেন, আর না হয় নিজের পছন্দমতো সময় ও জায়গা বিশেষে স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসাবে ব্যবহার করছেন। কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় কে কোনটা পছন্দ করে স্বেচ্ছায় পরছে, আর কে সামাজিক চাপে। সত্যিই এই স্বেচ্ছা এবং চাপ বাইরে থেকে বোঝার কোনও সহজ উপায় নেই। সমাজের চাপ প্রায়শই অন্তঃসলিলা নদীর মতো, উপর থেকে অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। সামাজিক চাপ মানে কিন্তু সব সময় মাথায় লাঠি ধরা নয়, এই চাপ মানে গ্রহণযোগ্যাতা। যা করলে পরিবার বা সমাজের একটা বড় অংশের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবার আশঙ্কা থাকে, বা কমে যায়, তা করতে আমরা ভয় পাই। যতই শিক্ষিত আর স্বাবলম্বী হই না কেনো, আমরা অধিকাংশই কিন্তু  পরিবার, পতিষ্ঠান এবং সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েই বাঁচতে চাই। সেই জন্য অনেক চাপিয়ে দেওয়া বিষয়কেই আমাদের নিজের চয়েস বলে ভ্রম হয় অনেক সময়। কারণ, সমাজের কাছে  গ্রহনযোগ্য হয়ে বাঁচার ইচ্ছাটা তো আমাদের নিজের।

বিয়ের পর হিন্দু মেয়েদের শাঁখাসিঁদুর পরতে হয়, পুরুষদের এরকম কোনও সাইনবোর্ড টাঙাতে হয় না নিজের শরীরে। শাঁখাসিঁদুর, হাতের নোয়া বলে দেয় মেয়েটি এখন অন্য কারও সম্পত্তি। পুরুষদের কখনও সামাজিকভাবে অন্য কারও হয়ে যাবার এমন নোটিশ ঝোলাতে হয় না নিজের দেহে। স্ত্রীর মঙ্গলের জন্য, অথবা বিয়ের চিহ্নস্বরূপ বিবাহিত পুরুষের হাতে অন্তত একটা মস্তানি মার্কা বালা তো বাধ্যতামূলক করা যেত! কিন্তু না, তা হয়নি। এটাই পুরুষতন্ত্র। শুধু শাঁখাসিঁদুর কেনো, ছোট্ট নাকছাবিতেও পুরুষতন্ত্রের ছাপ প্রকট। আমাদের সমাজ বলে, বিবাহিত মেয়ের নাকে নাকছাবি না থাকলে নিঃশ্বাস দূষিত হয়, তাতে স্বামীর অমঙ্গল হয়। হিন্দু সধবাদের তাই নাকছাবি একরকম বাধ্যতামূলক গহনা ছিলো এক সময়। এখন অবশ্য অনেক সধবা নারীই নাকছাবি পরেন না। আবার অনেক বিধবারাও পরছেন, অবিবাহিতারা তো পরতে পারেন বরাবরই । অনেকে পছন্দ করেও পরেন। তবে যতই পছন্দের দোহাই দেওয়া হোক, অনেক এলাকাতেই স্বামী মারা যাওয়ার পর নাকছাবি পরতে দেওয়া হয় না। স্ত্রী মারা গেলে স্বামীকে এরকম কোনও জিনিস ত্যাগ করতে হয়েছে কোনদিন? কেনো? স্বামীরা কি স্ত্রীদের ভালোবাসেন না তাহলে? সেই জন্যই কি ধর্মীয় কাহিনীতে বেহুলা, সাবিত্রী মৃত স্বামীর প্রাণ ছিনিয়ে আনেন যমের হাত থেকে, আর সামাজিক বাস্তবতায় স্বামী মারা গেলে জীবন্ত স্ত্রীকে তোলা হতো স্বামীর চিতায়? আমরা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে শিখেছিলাম বলেই না মেয়েদের জীবনে এই ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক দাপট বন্ধ হয়েছে আজ। এরকম অনেক নিয়মনীতিই উঠে গিয়েছে, অথবা শিথিল হয়েছে। সাজপোশাকের ক্ষেত্রেও তাই, বাধানিষেধের গন্ডি অনেক ছোট হয়েছে, হচ্ছে দিনে দিনে। 

এখন যদি কোনও বিশেষ কারণে শাড়ি-পরা মেয়ের সংখ্যা পঞ্চাশ বছর আগের অনুপাতে বেড়ে যায়, তাহলে শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাক-পরা মেয়েদের গ্রহণযোগ্যতা আরও কমে যাবে সমাজে। তাঁরা নানারকম 'ন্যায়সঙ্গত' আক্রমণের শিকার হবেন। ইদানীং, শাড়ির বাইরে বেশি বেশি সংখ্যায় মেয়েরা বেরিয়ে আসছেন বলেই সমাজে অন্য পোশাক পরা বিবাহিত মেয়েদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে ক্রমশ। এবং যেখানে যত সংখ্যা বাড়ছে সেখানে তার তত গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এই গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপারটা অনেকাংশেই সংখ্যাতত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ একটা অন্য প্রসঙ্গ, যেমন, রাজনৈতিক হিংসা, ক্ষমতার আস্ফালন, দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতা, খুনখারাপি দেখে আমরা আর আগের মতো অবাক হই না। বিষয়গুলো আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, এগুলোর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে আগের তুলনায়। শিক্ষার হাত ধরেই আসুক, বা ফ্যাশনের, শাঁখা না-পরা এবং শাড়ির বাইরে অন্য পোশাকের বিবাহিত মেয়েদের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে অনুরূপভাবে, সংখ্যাতত্ত্বের নিয়মে। 

আজকাল অনেকেই শাঁখাকে শাঁখ বাজিয়ে বিদেয় করছেন। দিব্যি খালি হাতে ঘুরছেন তাঁরা । অনেকে আবার হাত খালি রাখলেও, দেবো না দেবো না করেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে মাথার মধ্যিখানে চুলের ফাঁকে এককুচি সিঁদুর লুকিয়ে রাখেন। বাইরে থেকে যা সহজে বোঝার উপায় থাকে না। শাঁখাসিঁদুর শুধু ধর্মীয় প্রতীকই নয়, পুরুষতন্ত্রের চলমান রক্ষণশীলতারও প্রতীক। স্ত্রীর হাতের শাঁখা, সিঁথির সিঁদুর নাকি স্বামীর আয়ু বাড়িয়ে দেয়! স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুর যত লম্বা হবে, স্বামীর আয়ু তত দীর্ঘ। অনেকেই তাই গভীর বিশ্বাসে কপাল থেকে শুরু করে মাথার শেষ পর্যন্ত সিঁদুরের মোরাম রাস্তা বানিয়ে রাখেন। সিঁদুর ছোট হোক বা বড়, কিংবা চুলে লুকানো, তাদের উৎপত্তি কিন্তু অভিন্ন এবং উদ্দেশ্যও মোটামুটি এক... হয় অলৌকিক মাহাত্ম্য, না হয় সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। এই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকেই আমরা বৃহত্তর দৃষ্টিকোণে সংস্কার বলে থাকি। সব ক'টার সঙ্গেই পুরুষতন্ত্রের গভীর যোগ। শুধু সৌন্দর্যের খাতিরে নয়, মেয়েরা এসব পরে পুরুষের মঙ্গলের জন্য। পুরুষকে কিন্তু স্ত্রীর মঙ্গলের জন্য কিছুই ধারণ করতে হয় না। তবুও  যে-স্ত্রী এসব অস্বীকার করেন, স্বামীর অমঙ্গলের দায়ে তাঁর মাথায় বজ্রপাত ঘটায় সমাজ। যদিও কালের নিয়মে মঙ্গল অমঙ্গলের ধুনো নিভু নিভু হচ্ছে ক্রমশ, কিন্তু কিছুটা হালকা হলেও একই রকম ভারিক্কি চালে চলছে স্বাধীনতার প্রশ্ন। সমাজের বেঁধে দেওয়া এইসব গ্রহণযোগ্যতাকে অস্বীকার করা মানেই স্বাধীনতার  উদযাপন। সমাজ মেয়েদের এই স্বাধীন মনের পায়েই বেড়ি পড়ায়। অথচ, পুরুষের সব রকম স্বাধীনতা, স্বাচ্ছন্দ্য, সুবিধা এবং সুযোগকে বরাবরই ছাড়পত্র দিয়ে আসছে সমাজ। এটাই পুরুষতন্ত্র। পুরুষের সাত খুন মাফ। পুরুষরা সাত ঘাটের জল খেয়ে এক ঘাটে উঠতে পারে। তাতে পুরুষের পেট খারাপও হয় না, চরিত্রও নষ্ট হয় না। ভেবে দেখুন, আমাদের মননের, যাপনের কোনখানে না ঘাপটি মেরে আছে পুরুষতন্ত্র!  

একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমার পরিচিত এক স্কুল-শিক্ষিকার নাকে নাকছাবি পরার ছিদ্র ছিলো না। অপছন্দ বলে তিনি ইচ্ছা করেই করেননি ছিদ্র। তাঁর বাড়ি থেকেও নিশ্চয়ই তাঁকে সে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু বিয়ের দিন ছাঁদনাতলায় তাকে নাকে ছিদ্র করে নাকছাবি পরানো হয়। হয়তো হবু স্বামীটির মঙ্গলের জন্য। আশ্চর্য, আমেরিকায় কর্মরত স্বামীরও মঙ্গল সাধিত হয় স্ত্রীর নাকছাবিতে! তবে সব সময় হয়তো মঙ্গল অমঙ্গলের প্রশ্নও থাকে না। তুমি আর যা-ই হও, তুমি মেয়ে, সমাজে তোমার জন্য গড়ে দেওয়া সব নিয়ম মানতে হবে তোমাকে... এই দমনমূলক নীতিও কাজ করে অনেক ক্ষেত্রে। উক্ত শিক্ষিকার ক্ষেত্রেও হয়তো এই নীতি প্রযোজ্য হয়েছিলো। বিয়ের পর তাঁকে যে সবসময় নাকছাবি পরতে বাধ্য করা হয়েছে এমন নয়। তবে বিয়ের দিন অন্তত তাঁর পছন্দের প্রশ্নচিহ্নটা মুছে দেওয়া গেলো। কিন্তু কী করতে পারতেন ওই শিক্ষিকা? কিছুতেই নাকছাবি পরবো না বলে বিদ্রোহ করতেন বিয়ের রাতে? তা পারলে হয়তো একটা দৃষ্টান্ত হতে পারতো। তবে, এতটাও সহজ নয় সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকে অস্বীকার করা! আমি তো বিশ বছরেও পারিনি। এটা পুরুষতন্ত্র। এই তন্ত্রের গাঁট এতই শক্ত যে শিক্ষিতরাও সহজে ছাড়াতে পারেন না তা। মুষ্টিমেয় কেউ কেউ পারেন। যেমন বিয়েতে কনকাঞ্জলি, কন্যাদান, পণপ্রথা, বিয়ের পর মেয়েদের পদবিতে পরিবর্তনের টান, সবই পুরুষতন্ত্রের দান। এবং আমরা অপরিমেয় ভাবে জড়িয়ে আছি এসবের সঙ্গে। 

আমি যে এত কথা বলছি, আপনারা বলবেন, তাহলে আমি এসব পরি কেনো? পরি, কারণ এই পুরুষতন্ত্র থেকে রেহাই নেই আমাদের নিজেদেরও। মেয়েদেরও রক্তে শিরায় মিশে আছে এই পুরুষতন্ত্র। যাঁরা এই পুরুষতন্ত্রকে চেনেন, বোঝেন, তাঁরাও সমাজের হাততালির লোভ সামলাতে পারেন না, পুরুষতন্ত্রের ফাঁদেই ডানা ঝাপটান। যেমন, আমি। স্বামীর তরফ থেকে আমার উপর কিন্তু কোনও বাধানিষেধ নেই। আমি শাঁখাসিঁদুর না-পরলে একটা প্রশ্নও  তিনি কোনদিন করবেন না। তবুও আমি পরে থাকি। পরে থাকি বিতর্ক চাই না বলে, সমাজের চাপ সহ্য করতে পারবো না বলে, সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ভয়ে। এটাই পুরুষতন্ত্র। এর জন্য সব পুরুষ দায়ি নন, এবং শুরুটা করলেও এখন আর শুধু পুরুষ দায়ি নন। সব পুরুষ পুরুষতন্ত্রকে নিজের গায়ে মাখেনও না। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, জেনে-বুঝে বা না-বুঝেই মেয়রাও, এবং মেয়েরাই বোধহয় বেশি, পুরুষতন্ত্রকে বয়ে বেড়ান। এখানেই স্বেচ্ছা আর চাপ গুলিয়ে যায়। বাইরে থেকে অচেনা লাগে সব। অধিকাংশ মেয়েরা তাই নিজেরাই বুঝে উঠতে পারেন না, কোনটা তাঁদের বেছে নেওয়া আর কোনটা তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া।  

মেয়েদের সৌন্দর্যচর্চায়ও পুরুষতন্ত্রের কলকাঠি নড়ে। কেনো মেয়েদের সুন্দর হতেই হয়? সৌন্দর্য ছাড়া মেয়েদের অন্য গুণের খুব একটা কদর করেছি কি আমরা? আমাদের মধ্যে ক'জন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রীর রূপ না-দেখে তার মেধার দিকে তাকাই? কেনো মেয়েরা নিজেদের শরীরে ছিদ্র করে গহনা পরে? কারণ, তাকে যেনতেন প্রকারে আর একটু সুন্দর দেখাতেই হয়। তা না হলে, ভালোবাসা তো দূরে থাক, সংসারই জুটবে না তার সহজে! আর জুটে গেলেও টিকে থাকতে টানাটানি হবে। 'আগে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী', মেয়েদের সম্পর্কে সমাজের বহুল প্রচলিত প্রবাদ এটি। কালো মেয়েকে নিয়ে বাপ-মাকে দুশ্চিন্তা করতে কে শেখালো? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কারণ, কালো মেয়ে কোনও পুরুষেরই উপযুক্ত নয়। বিয়ের পরেও টানটান চেহারাই অধিকাংশ স্বামীর কাছে স্ত্রীর কদর ধরে রাখে। অন্য নারীর সৌন্দর্যের প্রতি স্বামীর আকৃষ্ট হয়ে পড়ার আতঙ্কে ভোগেন অনেক নারী। মেয়েদের রুপচর্চার বাতিক নিয়ে মশকরা করার আগে বুঝতে হবে, কোন মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিতে মেয়েদের সুন্দর হবার এত আকূতি, কেনো মেয়েরা সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর পরিপাটি পুতুল বানিয়ে রাখে নিজেকে! সমাজের প্রতি জোড়া চোখে নিজেকে সুন্দর দেখানোর শিক্ষাই কি আমরা মেয়েদের দিই বা জন্মাবধি? 

সঙ্গীকে ভোলানোর প্রবণতা মানুষের সহজাত। শুধু মানুষ কেনো, প্রাণীজগতেও এটা লক্ষ্য করা যায়। সিংহ তার কেশর ফুলিয়ে ভোলায় সিংহীকে। ময়ূর পেখম মেলে, আর মোরগ ঝুঁটি নাড়িয়ে। হরিণ সুদৃশ্য শিং দেখিয়ে হরিনীকে কাছে ডাকে। মানুষের সমাজে সচরাচর এর উল্টোটা ঘটে। এখানে মেয়েদেরই রূপে ভুলিয়ে রাখতে হয় পুরুষকে। এই কারণে মেয়েরা এমন মরিয়া হয়ে মেতে ওঠে রূপচর্চায়। এই জন্যই চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে-ওঠা এত বিউটি পার্লার, কসমেটিকসের এত রমরমা বাজার। আগার মাগারের কোনও জায়গা নেই, এর মধ্যে বাজারতন্ত্র আছে, পুরুষতন্ত্র আছে। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই আছে অবশ্যই। এমন নয় যে, কোনও পুরুষ কালো মেয়েকে বিয়ে করেন না, বা সব স্বামীই চেহারা নষ্ট হয়ে গেলে স্ত্রীকে অবহেলা করেন, বা অন্য কোথাও আকৃষ্ট হন (অনেক নারীও অন্য কোথাও আকৃষ্ট হন অবশ্যই, সেটা অন্য প্রসঙ্গ, তাই বাদ দিলাম এখানে) । আবার, কোনও মেয়েই নাকছাবি, শাড়ি বা শাঁখাসিঁদুর নিজের পছন্দে পরেন না তা-ও নয় নিশ্চয়ই।এগুলো বা এর মধ্যে দু'একটা অনেকেরই ভীষণ প্রিয়।  কিন্তু ব্যতিক্রম দিয়ে কি আর সত্যকে ঢেকে রাখা যায়! শাঁখাসিঁদুর যেমন, শখ করে, স্বেচ্ছায়, অথবা অলৌকিক মাহাত্ম্যে বিশ্বাস করে পরলেও এদের গা থেকে পুরুষতন্ত্রের ছাপ মুছে ফেলা যায় না কিন্তু।

1911 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।