সারথি বিশ্বাস

প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, পশ্চিম বঙ্গ।

পোশাকের স্বাধীনতা প্রশ্নে দরকার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি

স্বাধীনতা বড়ো ভারি জিনিস! নিজের বেলায় এক কথা, অন্যের ক্ষেত্রে অনেকেরই এটা তেমন হজম হয় না। সেটা বাক-স্বাধীনতাই হোক বা ধর্মীয় স্বাধীনতা। তাই তো যে মেয়েটা বলে হিজাব ইজ মাই চয়েজ, সে-ই আবার টি-শার্ট পরার অপধাধে চলন্ত বাসে হেনস্তা করে আর একটি মেয়েকে। এবং বাকিরা উপভোগ করে চয়েজের এই উদযাপন। কেউ এগিয়ে আসে না হিজাবির হাত থেকে টি-শার্টকে রক্ষা করতে। টি-শার্ট ইজ হার চয়েজ, এক্ষেত্রে  এটা ভাবতে পারলাম না কেনো আমরা? 

উল্লিখিত ঘটনা বাংলাদেশের। ভারতও ব্যতিক্রম নয়। বোরখা-হিজাব প্রসঙ্গে তোলপাড় হচ্ছে ভারতও। কর্ণাটকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরে প্রবেশের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। সেই সময়কালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোরখা-পরা একটি মেয়েকে একদল ছেলের হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। ঘটনা তৎক্ষনাৎ আল্লা-হু-আকবর বনাম জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে পরিণত হয়..... ভাইরাল ভিডিও এইটুকু। কর্ণাটকের এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বিচারককে প্রাণ নাশের হুমকিও দেয়া হচ্ছে। আমরা কি বাক-স্বাধীনতাসহ আর সব স্বাধীনতা কেবল নিজের জন্যই চাইবো তাহলে? নাকি কালে কালে দেশে দেশে সব স্বাধীনতা শুধু সংখ্যাগুরুর সম্পত্তি হয়ে থাকবে? সংখ্যার লঘু গুরু বিচার তো কেবল ধর্মের নিরিখে হয় না, মানুষের চিন্তা চেতনার জগতেও সংখ্যার লঘু গুরুর জন্ম হয় যে! 

মূল ইস্যু পোশাক হলেও দুই দেশের এই দুই ঘটনার প্রসঙ্গ এবং গুরুত্ব আলাদা অবশ্যই। আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নিজস্ব ইউনিফর্ম আছে, কিছু কিছু পেশাতেও নির্দিষ্ট পোশাকবিধি থাকে। সেই প্রতিষ্ঠান এবং পেশা গ্রহণ করলে সেখানকার বিধিও মেনে চলাই সৌজন্য এবং সেটাই আমাদের শিক্ষা। এই ক্ষেত্রগুলিকে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক কি! কর্ণাটকের ঘটনাটা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না হয়ে কোনও ব্যক্তিগত পরিসরে ঘটতো, তাহলে আলোচনা অন্যরকম হতো। সেক্ষেত্রে পোশাক-বিদ্বেষ ছাড়া পুরো ঘটনাটির পিছনে আর কোনো প্রাসঙ্গিকতাই ছিলো বলে মনে হতো না। কিন্তু প্রসঙ্গ যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাই আলোচনার কিছু পরিসর থেকে যাচ্ছে।  

এই ঘটনার পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আধুনিক পোশাক পরিহিতা এক মেয়ের একাধিক ছবি প্রকাশিত হয়, যেগুলোকে কর্ণাটকের সেই বোরখা-পরা লড়াকু মেয়েটির ছবি বলে দাবি করা হয়। এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তোলে, যে মেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বোরখার অধিকারে লড়াই করে 'শেরনী' শিরোনাম পান, তিনি টি-শার্ট এবং অন্যান্য আধুনিক পোশাক পরে এলোচুলে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুললেন কী করে? যদিও এই ছবির সত্যতা প্রমাণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। এটা কোনও কথা নয় যে কাল কেউ টি-শার্ট পরেছেন বলে আজ বোরখা পরতে পারবেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, কাল যিনি পোশাক নিয়ে ফ্লেক্সিবল ছিলেন, আজ এতটা কড়া হলেন কোন্ মন্ত্রে?   

ব্যক্তিগত স্তরে কেউ বোরখা পরেন, কেউ পরেন না। ক্ষেত্রবিশেষে বিকিনিও পরেন কেউ কেউ। এবং আমি মনে করি বোরখা পুরুষতন্ত্রের দান যেমন, বিকিনিও কোনও ধোয়া তুলসীপাতা নয়, তার গায়েও পুরুষতন্ত্রের গন্ধ লেগে আছে। দুটোই মেয়েদের ভোগ্য প্রমাণ করে। একটা মেয়েদের ভোগ্য ভেবে ঢেকে রাখে, আর একটা ভোগ্যপণ্য করে প্রকাশ করে। এর মধ্যে ক'জন মেয়ে স্বেচ্ছায় এসব (বোরখা-হিজাব এবং বিকিনি) পরিধান করেন, আর ক'জন পুরুষতন্ত্রের চাপে, আলাদা করে বোঝা সত্যিই মুশকিল। পছন্দের পোশাক নিয়ে যাঁরা কথা বলেন তাঁদের  অধিকাংশই বোরখা আর হিজাবকে চাপিয়ে দেওয়া পোশাক মনে করলেও বিকিনির বেলায় তা ভাবেন না। তাঁরা হয়তো ভাবেন বিকিনি মানেই নারীর স্বপ্নের উড়ান। আমি কিন্তু মনে করি দু‘টোই পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া সুচারু এবং সুদক্ষ কৌশল। তবে, বোরখা আর বিকিনির মাঝেও স্বীকৃত মার্জিত এবং প্রচলিত বহুরকম পোশাক থাকার কথা পৃথিবীতে। এবং আছে বলেই বিশ্বাস হয়। বাকি থাকলো রুচিসম্মত পোশাক। রুচি যেহেতু ব্যক্তি বিশেষে আলাদা, তাই পোশাকের রুচিসম্মত হওয়াও একান্ত ব্যক্তিগত। হিজাব বা বোরখা না-পরা মানেই বিকিনি পরে ঘুরে বেড়ানো নয়, এটাও বুঝতে শিখতে হবে আমাদের।  

পছন্দের পোশাক অবশ্যই স্বাধীন উড়ানের একটা ধাপ। অনেকেরই মেয়েদের পায়ের নীচে এই একটা সিঁড়ি ছেড়ে দিতেও বদহজম হয় বৈকি! স্থান-কাল হিসাবে স্বাধীনতা এবং অধিকার আবার বদলে বদলে যায়। এটা মানুষের চলমান শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। ছোটবেলায় শোনা একটি মজার গল্প মনে পড়ছে। তখন হিন্দু সমাজে বিবাহিত মেয়েদের ভাশুর দেখে ঘোমটা (পর্দাপ্রথা) দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিলো। এবং মেয়েদের বিয়েও হতো শিশুকালে। গল্পের সেই শিশু বউটি একটুকরো গামছা পরে বাড়ির সামনে খেলছিলো একমনে। এমন সময় তার ভাশুর চলে আসে। কেউ একজন বলে, তোর ভাশুর এসেছে, মাথায় কাপড় দে। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে পরনের গামছা খুলে মাথায় তুলে দেয়। শরীরের কোনো অংশ ঢেকে রাখা বেশি প্রয়োজন সে-বিষয়ে সম্ভবত মেয়েটি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলো। 

আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞানও বলে শরীরের গোপন এবং প্রকাশিত অংশের অনুপাত যুগে যুগে দেশে দেশে বদলে বদলে যায়। পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং ব্যক্তির মতিগতির  উপরেও তা নির্ভর করে। ধর্ম পোশাককে নিয়ন্ত্রণ করে। পোশাক ইতিহাসকেও অনুসরণ করে। ভূগোলও পোশাকের গায়ে কাঁচি চালায়। আবার সমাজ-সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পোশাকেরও পরিবর্তন এবং রূপান্তর ঘটে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, একসময় বাঙালি হিন্দু ভদ্র সমাজে মেয়েদের ব্লাউজ পরা নিষিদ্ধ ছিলো। তখন ব্লাউজ পরতো কেবল বারাঙ্গনারা। আর আজ দেখুন, ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি আমরা কল্পনাও করতে পারি না। 

তবে হ্যাঁ, পোশাকের বাইরে মেয়েদের মাথার চুল, পায়ের পাতা, জামার হাতা, কানের লতি, গলার ভাঁজ, হাতের কব্জি দেখে যাঁদের উত্থান পতন হয়, আর যাঁরা মনে করেন শরীরের খাঁজ, গোপন অলিগলি, উপত্যকা, বেলাভূমি এইসব না দেখালে যথেষ্ট মর্ডান এবং স্মার্ট হওয়া যায় না, তাঁদের উভয়েরই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারলে তবেই এই পোশাক-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারবো আমরা। যেদিন আমরা মেয়েরা সাজ-পোশাকের কোনরকম বাহুল্য এবং বাড়াবাড়ি ছাড়াই স্বেচ্ছায় পুরুষের মতো ঝট করে বাইরে বেরোতে পারবো, সেদিনই প্রকৃতপক্ষে পোশাকের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবো।

1786 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।