রাক্ষসের গপ্প না শুনে কোনো বাঙালি শিশুর শারীরিক, মানসিক বা বৌদ্ধিক বিকাশ হয়েছে কোনোদিন? রাক্ষস এসে তুলে নেবে, চেটে দেবে, খেয়ে ফেলবে, তবেই না বাঙালি শিশু মানুষ হবে! তারপর মানুষটি হয়েই সে ধরে নেবে সব বোগাস! আসলে রাক্ষস বলে কিচ্ছু হয় না, আসলে কোনো দশমাথা বা মুণ্ডহীন বা কেবল মাথাসর্বস্ব কোনো রাক্ষস কোনোকালে ছিলো না, আজও নেই।
রাক্ষস কিন্তু আছে, অনেক বেশি পরিমণেই আছে। হ্যাঁ, তাদের মুখের দু‘দিকে দুটো বড়ো দাঁত বেরিয়ে থাকে না, তাদের বড়ো বড়ো নখ নেই, চোখ দিয়ে আগুনও বেরোয় না; তাদের না আছে রাবণের মতো দশটা মাথা, না তারা কবন্ধের মতো মুণ্ডহীন, আর না তো রাহুর মতো শুধুই মাথা। অথবা সবই আছে, শুধু দেখা যায় না খালি চোখে। তারা আসে কখনও বন্ধু বেশে, কখনও প্রেমিক সেজে, কখনও প্রতিবেশী হয়ে। হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ বলে না তারা, তারা বলে হাঁউ মাঁউ খাঁউ, নারীর গন্ধ পাঁউ। কিন্তু সে শব্দ শোনা যায় না খালি কানে। তারা নারীকে ক্রিয়াহীন, ক্ষমতাহীন, ইচ্ছাহীন একদলা মাংসপিণ্ড ভাবে। নারীকে মাল বলে, তাকে হাটে বেঁচে, বাজারে কেনে ; তাকে ধর্ষণ করে, তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে। কারণ, আজও, এমনকী মেয়েরাও, কোনো নারীকে বিচার করার সময় তার রূপকেই একমাত্র মানদণ্ড করি। তার কোনো রকম বৌদ্ধিক অথবা প্রতিভাগত যোগ্যতা আছে কি নেই, সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না; নারীর রূপই তার সর্বস্ব এবং একমাত্র পুরুষের ভোগে লাগাই তার উপযোগিতা।
পুরুষ ও নারীর মধ্যে একটা খাদ্যশৃঙ্খল আছে, এখানে পুরুষ খাদক আর নারী খাদ্য যেনো! আমরা সবাই ভেতরে এবং বাইরে লালন করি এই শৃঙ্খল, যত্নে গড়ি তাকে। তাই তো আমাদের সমাজে ধর্ষকের বিয়ে হয়ে যায় খাতিরের সঙ্গে, পাত্র জুটে না নির্যাতিতার। অ্যাসিড আক্রামণকারী বাইকের পিছনে বউ নিয়ে তারই হাতে ঝলসে যাওয়া মেয়েটাকে নিয়ে কটূক্তি করতে করতে চলে যায়, আমরা তাই দেখে বিগলিত হয়ে হাসি। আমরা ধর্ষককে খুব সহজেই আপন করে নিই, দু-চার দিনেই ভুলে যাই অ্যাসিড আক্রামণকারীর নৃশংসতা। কিন্তু আমরা কোনোদিনই নির্যাতিতাকে কাছে টেনে নিই না, দেখতে চাই না অ্যাসিড আক্রান্তের পোড়া মুখ, তাদের ত্যাগ করি, যেনো তারা প্রাগৈতিহাসিক কুষ্ঠ রোগী। তাদের গড়া সংসার ভেঙে যায়, প্রেমিক ছেড়ে চলে যায়, তারা এক্কেবারে অচ্ছুৎ হয়ে যায়। সমাজের যতো নিন্দা, যতো কটূক্তি শুধুই আক্রান্তের জন্য। সমাজের আড়চোখ দুমড়ে মুচড়ে দেয় তাদের, প্রথম আঘাতের পর দ্বিতীয়, তৃতীয় আঘাত নেমে আসে, ভেঙে পড়ে তারা, অবশ্যই যদি সে নারী হয়। কেননা, আমাদের স্থির বিশ্বাস, পুরুষ যা করেছে ঠিকই করেছে, আমরা ধরেই নিই যা হয়েছে মেয়েটার দোষেই হয়েছে।
প্রেম জিনিসটাও খুব ডেঞ্জারাস একটা চিজ। প্রেমে পড়ার একচেটিয়া অধিকার যেনো পুরুষেরই আছে! অবশ্যই প্রেমে নারীকেও প্রয়োজন, তবে সমাজ নারীকে প্রেমের নিষ্ক্রিয় পাত্রী ভাবতে ভালোবাসে। নারী প্রেমে সক্রিয় হলেই গেলো গেলো রব। যে মেয়ে কোনো পুরুষের প্রেমে পড়ে, সমাজ ধরে নেয় সে সব পুরুষের সঙ্গেই প্রেম করতে আগ্রহী। যতোটা পারি তাকে নীচে নামিয়ে আনি আমরা। পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন ধারণা আমাদের মনেও আসে না। বরং সব কচি খোকার বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী অথবা বন্ধুরাই ভাবে তাদের কচি মনের নাবালক খোকাটাকে ফুসলিয়ে ফাঁসিয়েছে ওই চরিত্রহীন ধিংড়ি। পুরুষ বাজার করে নিজ ক্ষমতায়, বাইক চড়ে নিজ সাহসে, বিয়ে করে নিজ ইচ্ছায়, কিন্তু প্রেমে পড়ে কোনো চরিত্রহীনার প্ররোচনায়; এমনই সরল বিশ্বাস আমাদের! পুরুষ শব্দটাই যেনো সাবানের মতো, শুধুমাত্র পুরুষ হলেই তার সব অপরাধ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। এই সাফাই কর্মে একযোগে হাত লাগাই আমরা সবাই।
পুরুষ বা নারী বলে নয়, প্রতি আক্রামণকারীর মনের গঠন আমাদেরই মতো আসলে। তাই প্রত্যেক আক্রামণকারীই সফল, তারা কখনও হারে না। তাই তো মানুষ রাক্ষস হয় বারবার; সে শঠ হয়, খল হয়, ধূর্ত হয়, খুনি হয়, ধর্ষক হয়। রূপকথা আর পুরাণের যতো রাক্ষস, মানুষের ক্রোমোজমে বাসা বেঁধে আছে। আমাদের জিনে বাহিত হয় তারা। যতই তারা দেবতাদের বর ম্যানেজ করুক, পুরাণ ও রূপকথায় রাক্ষসরা কখনও জেতেনি। হার এবং মৃত্যুই তাদের নিয়তি। কিন্তু আজকের রাক্ষসরা কিছুতেই হারে না, আমরা তাদের জিতিয়ে দিই বারবার! এমনই গড়ন আমাদের মনের, মননের, আমাদের সমাজের। কিন্তু মানুষ যেহেতু মানুষ, একবার ভেবে দেখলে হয় না, আমরা কেনো এখনও রাক্ষসপুরীর দুয়ার খটখটাবো? আমাদের মধ্যেকার সব রাক্ষসকে কি মানুষ করা যায় না?