সানজিদা রোমান

লেখক একজন প্রবাসী

রাতকে আর ভয় পাই না

একটা পোস্ট পড়ে আজ লিখতে ইচ্ছে হলো নিজের কথা যা কখনো লিখিনি। যদি একটা মেয়েও আমার গল্প পড়ে ঘুরে দাঁড়ায় তাহলেই স্বার্থকতা। আমার বয়স এখন ৩৯। আমার নিজের জীবনের এই গল্পটার সময়কাল ১৫ বছর তবে চেস্টা করব ছোট রাখতে।

 

পড়াশুনায় আমি খুব ভাল ছিলাম, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল কিন্তু পরিবারের বড় মেয়ে হলে যা হয়! ১৮ বছর বয়সে সবাই মিলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলো বিলেতে বসবাসকারী ৩৫ বছরের একজনের সাথে। বিয়ের রাতে বুঝলাম সে একজন ড্রাগ এডিক্ট। শারীরিক সম্পর্কে তার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। বিয়ের চারদিন পর একটা কথার সুত্র ধরে প্রথমবার সে আমাকে সিগারেটের চ্যাকা দেয়। এই দাগ এখনো আমার বা হাতের কব্জিতে আছে। নানা ধরনের অত্যাচার তখন থেকেই শুরু, চলতে থাকলো। আব্বু-আম্মু বুঝতে পেরে বললো শেষ করে দিতে সব কিন্তু পারলাম না। আমার ছোট তিনজন ভাই-বোন। আব্বুর ব্যাংকের চাকরীতে আর্থিক সচ্ছলতা কেমন হতে পারে সেকথা সবার জানার কথা। বিয়ের কয়েকমাস পর সে ফিরে গেলো ইংল্যান্ডে। কথা ছিল আমাকে পরপরই নিয়ে আসবে কিন্তু মাস যায় তার কোন খবর নেই। একদিন আব্বুকে বললাম যেভাবেই হোক আমার ইংল্যান্ডে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে, আমি এর শেষ দেখতে চাই। আব্বু অনেক কস্ট করে পাঠিয়ে দিল।

১৯৯৭ – আসলাম ইংল্যান্ডে। আসার পর শুরু হলো আসল অত্যাচার। গ্রামে বড় হওয়া আমি এক বাক্য ইংরেজি জানিনা, যাওয়ার জায়গা নেই। একদিন রাতে মাইনাস তাপমাত্রায় মারধোর করে ঘর থেকে বের করে দিল। রাস্তায় শীতে কাঁপতে কাঁপতে মরে যাইনি সেটাই ছিল জীবনের উপহার। সকালে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক মহিলা একটা সরকারী আশ্রয় কেন্দ্র দেখিয়ে দিল। গেলাম, ওখানে সন্ধান পেলাম পড়াশুনা আর কাজের। কিছুদিন ওখানে থাকার পর ওই লোক ক্ষমা চেয়ে ফেরত নিয়ে আসলো। কিন্তু স্বভাব কি আর বদলায়! পুরুষ দেখলে ভয় পাই, রাত দেখলে ভয় পাই, শীত লাগলে ভয় পাই। আত্মীয়স্বজনহীন আমি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে গিয়েছি। শুধু পড়াশুনাটা ভাল লাগে, ডুবে থাকি ওটাতেই। একটা ফাস্টফুডের দোকানে ক্লিনারের কাজ করি, কাজ শেষে কলেজ।

কত মাস গেছে বাংলায় কথা বলিনি। না খেয়ে ছিলাম কত বেলা সে হিসেবও রাখিনি। তবুও মারধোরের মাঝেই কেমন যেন একটা দৃঢ়তা এসে গেলো যদি বাঁচি মেরুদন্ড সোজা করেই বাঁচবো। এর মধ্যে অনেক নোংরা ঘটনা ঘটে গেছে। সেসব আজ থাক।

যাই হোক, পড়াশুনা শেষ করে চাকরী নিলাম ভাল। তবুও ভয় আমার যায় না। রাত হলেই ভয় লাগে। ব্যগের মধ্যে বিস্কিট রাখি সবসময় ক্ষুধা লাগার ভয়ে। যদি খেতে না পাই আবার! ওই লোকটার সাথে ছিলাম সব মিলিয়ে আট বছর। অনেক বার আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছি আবার ফেরত এসেছি। চেস্টা করেছি অনেক সব ঠিক করতে কারন ডিভোর্সের কলংক নিতে চাইনি। শেষ পর্যন্ত একদিন তার চোখে খুনির দৃস্টি দেখে আর পারিনি। লুকিয়ে বাংলাদেশ ফেরত গেলাম। ডিভোর্স হলো আব্বুর সাহায্যেই। বাংলাদেশ আমাকে আবারো রক্তাক্ত করতে শুরু করলো বিভিন্নভাবে, টিকতে পারিনি। চাকরীর এপ্লাই করলাম ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ থেকেই। হয়ে গেলো। বাংলাদেশে এর মধ্যে পরিচয় হলো এক সুদর্শনের সাথে। ক্ষত-বিক্ষত মনটা ভাবলো অবশেষে সুখ বুঝি পেলাম।

আমি প্রথমে ইংল্যান্ডে এসে চাকরীতে জয়েন করে, টাকা জমিয়ে ওকে নিয়ে এলাম। ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দেয়ার সাথে সাথেই তার চেহারা বদলে গেল। সে স্বীকারও করলো এইদেশে আসার জন্য এত প্রেমের অভিনয়! বুঝলাম একবার বাবা-মা ধরে আমার কোমর ভেঙেছে আর এবার নিজেই নিজের গলা কাটলাম। আমি দুই নম্বরী মাল কারন আমার আগে একবার বিয়ে হয়েছে।

সুদর্শন এমনিতেও মেয়েমানুষ পাগল তার উপর এই অভিযোগে সে পোক্তভাবেই সাদা মেয়ে ধরলো। অথচ জীবনে একটা প্রেমও করিনি। শেষ পর্যন্ত আবারো ডিভোর্স। আর পারছিলাম না। কতবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছি! মানসিক কস্ট সহ্য করতে না পেরে ব্রেইনও বেঈমানি করা শুরু করলো। ডান হাতটা প্যারালাইজড হয়ে গেল। ডাক্তাররা শুধু বলে মাথা ঠিক করতে, অসুধে কাজ হয় না। তারপর থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম আবার। কাউন্সেলিং করেছি তবে তেমন কিছু হয়নি। নিজে নিজে পড়াশুনা করলাম, নিজেকে ভাল করে তোলার পড়াশুনা। পাঁচ বছরে আস্তে আস্তে পুরোপুরিভাবেই সেরে উঠলাম। রাত আর ভয় পাই না, ব্যাগে বিস্কিট রাখি না, পূর্নিমার চাঁদ দেখে আঁতকে উঠি না। আমি অনেক অনেক ভাল আছি। জীবনের প্রতিটা জিনিস আমার কাছে অসাধারণ লাগে। জীবন যে কত সুন্দর সে কস্টগুলি না পেলে বুঝতাম না। কস্টকে ধন্যবাদ দেই প্রতিদিন।

2894 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।