সালমা লুনা

ফিজিক্স আর পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করেছেন। লেখালিখি করেন শখে। দায়বদ্ধতা অনুভব করেন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলায়। হোপ সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিওর প্রেসিডেন্ট তিনি।

কোনো মা‘ই চায় না ছেলে ধর্ষক হয়ে উঠুক- তাহলে ক্রটিটা কোথায়?

গুলশান বনানী ধানমণ্ডির ছেলেমেয়েরা উশৃংখল । ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরা উশৃংখল। আজকাল ছেলেমেয়েরা প্রেম বলতে ফিজিক্যাল রিলেশনই বোঝে। এইসব ছেলেমেয়েদের মায়েরা খালি নারীবাদ করে, ঘুরাঘুরি করে,পরকীয়া করে, কিটি পার্টি করে - ছেলেমেয়ে কোথায় যায় কী করে, কিচ্ছু খেয়াল রাখে না। ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় অনুশাসন দেয় না, ধর্মচর্চা করায় না। আমি ভয় পাচ্ছি। প্রতিটি খবরের নিচে এসব মতামত দেখছি আর ভয় পাচ্ছি। কুঁকড়ে যাচ্ছি। 

মেয়েটা বাড়ি থেকে বন্ধুর বাড়ি যাবে, মাকে বলে বেরিয়েছে। তারপর সে তার বয়ফ্রেন্ড কিংবা তার ছেলেবন্ধুটির খালি বাড়িতে গেছে। হয়তো বাড়ি খালি বলে ছেলেটিও মেয়েটিকে ডেকেছে। সেখানে কিছু একটা হয়েছে। স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক কিংবা জবরদস্তির ধর্ষণ।

যার ফলে মেয়েটার ব্লিডিং শুরু হয়। ছেলেটি উপায়ন্তর না দেখে ফোন করে তার ৩ বন্ধুকে ডেকে আনে। ৪ জন মিলে মেয়েটিকে হসপিটালে নিয়ে আসে। মেয়েটি মারা যায়। 

বাচ্চা মেয়েটি গতকাল সকালেও যে উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত ছিলো, আজ সে হিম ঠাণ্ডা হয়ে লাশকাটা ঘরে পড়ে আছে। আর এটি সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ অথবা ধর্ষণ নয় এই বিতর্ক চলছে আমাদের মাঝে। আর আমরা, কোনো কোনো মা গর্ভযন্ত্রণায় কাঁদছি। আমাদের জরায়ুতে টান পড়ছে। যন্ত্রণায় সব ছিঁড়ে যাচ্ছে।

শোনা যাচ্ছে ছেলেটির বাবা ক্ষমতাবানদের একজন। এবং এদেশে ক্ষমতাবানদের সাথে দেশের আইন প্র‍য়োগকারী সংস্থার সুসম্পর্ক সর্বদাই ভালো। তাই সন্দেহ এখানে জবরদস্ত ভূমিকা নেবে, হয়তো ঘটনাটিকে প্রভাবিতও করবে।

একই সমাজে বসবাস করায় যতদুর জেনেছি ছেলেটির বয়স ২০/২১ হবে। মেয়েটি আনুমানিক ১৬/১৭। ক্লাস টেনে পড়ে সেই হিসেবে তার বয়স ১৬/১৭ এর বেশি হওয়ার কথা না।

কারণ বাংলাদেশের আইনে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে। ছেলেটি সেটি জানত না। অনেক ছেলেই এই আইনটি জানে না। জানার কথাও না। কোথা থেকে শুরু করবো, কীভাবে যা বলতে চাইছি তা বলবো, বুঝতেই পারছি না। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। 

আচ্ছা, আমি তো ধর্মীয় অনুশাসন শেখালাম। ধর্মচর্চাও করালাম। ছেলেমেয়ের জন্য ঘরেই থাকলাম, সন্তানদেরও তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ ঘরেই আটকে রাখলাম। সারাদিন সব বাদ দিয়ে সন্তানদের উপর নজরদারি করলাম। ফোনের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধ করলাম, বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে যেতে দিলাম না, হ্যাং আউট করতে বাইরে, রেস্টুরেন্টে যেতে দিলাম না। ছেলেমেয়ের কাছে খারাপ হলাম, সবার মা কত্ত ভালো! আমি কেনো এমন!

তারপর?! এই কি জীবন! বর্তমান বাংলাদেশে আমাদের সন্তানদের শৈশব কৈশোর তারুণ্য কিচ্ছু নেই।

তাদের আছে ইয়াবা, উইড, শিশা, গাঁজা না জানি নাম না জানা আরো কত নেশা। খেলাধুলা, গানবাজনা, আবৃত্তি, বিতর্কের জায়গা নিয়ে নিয়েছে শরীর নিয়ে খেলা। এই উন্মুক্ত দুয়ার, গ্লোবাল নেটওয়ার্কের বিশ্বেও তারা শরীরকে চিনেছে ভুলভাবে। যৌনতাকে নিয়েছে খেলা হিসেবে। ভাবছি নিজের সতের বছর বয়সী মেয়ে আর বাইশ বছর বয়সী ছেলেটাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাবো দূরে, অনেক দূরে। আপনারা যারা বলেন, মায়েরাই দায়ী, তাদের কাছ থেকে বহুদূরে। 

তবু ভুল তো কোথাও একটা হয়েছেই। হয়তো তা আর সংশোধনের উপায়ও নেই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জানেন মায়েরা কখনো চেষ্টার ত্রুটি করেনি। বিধাতা জানেন মায়েরা কখনো চায় নি মেয়ে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার কথা বলে ছেলেবন্ধুর বাড়ি যাক। কিংবা খালি বাড়ি পেয়ে মেয়ে বন্ধুকে বাড়ি এনে ছেলেটি ধর্ষক হয়ে উঠুক।

কেউ একটা জায়গা খুঁজে দেবেন? এমন একটা জায়গা, যেখানে উশৃংখল না হয়ে শুধু স্বাধীন ভাবে ছেলেমেয়েরা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে গল্প করবে আনন্দ করবে!

যেখানে ছেলেমেয়েরা তাদের শৈশব কৈশোর তারুণ্যকে খুব আনন্দ নিয়ে উপভোগ করবে। যেখানে শরীর নিয়ে খেলা করা নাই। কেউ তাদের বলবে না মেয়েরা যত ফেতনা ফ্যাসাদের জড়। মেয়েরাই খারাপ। ছেলেদের প্রলুব্ধ করে। মাথা ঠিক রাখতে না পেরে ছেলেরা ধর্ষক হয়।

দেবেন এমন একটা ঠিকানার খোঁজ, যেখানে গেলে ওদেরকে নিরাপদ দেখে আমিও একটু স্বস্তি একটু মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে পারি! বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছি জানেন, এই মায়ের দায়িত্ব পালন করে করে! ক্লান্ত, বেদনার্ত, হতাশ এক মা মুক্তি পেতে চায় এসব থেকে।

1370 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।