লক্ষ্মী সেহগাল, ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী, লক্ষ্মী স্বামীনাথন, যে নামেই ডাকি তিনি সেই মহীয়সী যিনি নেতাজী সুভাষ বসুর ডাকে আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী ব্রিগেড “ঝাঁসীর রানী”র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, ইনি সেই আজন্ম সংগ্রামী যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশ থেকে বিতাড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। উদ্বাস্তু শিবির পরিচালনাসহ কলকাতায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে মূখ্য ভূমিকা রাখেন তিনি। আজ তাঁর জন্মদিন।
২৪ অক্টোবর, ১৯১৪ সালে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) লক্ষ্মী স্বামীনাথন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এস. স্বামীনাথন মাদ্রাজ হাইকোর্টে অপরাধ আইন চর্চা করতেন। তাঁর মা এ.ভি. অম্মুকুট্টি যিনি পরবর্তীতে অম্মু স্বামীনাথনরূপে পরিচিত, তিনি একজন সমাজকর্মী এবং স্বাধীনতা কর্মী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
সেহগাল চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নে আগ্রহী হন এবং মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। এর এক বছর পর গাইনোকোলজি এবং অবস্টেট্রিক্স বিষয়ে ডিপ্লোমাধারী হন। চেন্নাইয়ের ত্রিপলিক্যান এলাকার সরকারি কস্তুর্বা গান্ধী হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৪০ সালে পি.কে.এন. রাও এর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং সিঙ্গাপুরে তিনি পাড়ি জমান।
সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালীন সময়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু'র ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি দরিদ্র বিশেষতঃ অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে অভিবাসিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে একটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
সুভাষচন্দ্র বসু ২ জুলাই, ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুর গমন করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নারী রেজিমেন্ট গঠনের কথা উল্লেখ করেন, যাতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরা অংশগ্রহণ করবে। লক্ষ্মী সেহগাল এ বিষয়টি শোনেন এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু'র নারী রেজিমেন্ট গঠনের খসড়া নীতিমালা সম্পর্কে অবগত হন। এ নারী বাহিনীই পরবর্তীকালে ইতিহাস বিখ্যাত ঝাঁসির রাণী বাহিনী নামে পরিচিতি পায়। এশিয়ায় এটাই প্রথম সেনাবাহিনীর কোন নারী ব্রিগেড। নেতাজীর উদাত্ত আহ্বানে অনেক নারী ব্রিগেডে অংশ নেয়। ডঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথনও ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামে সারাজীবন পরিচিতি পান।
আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর সাথে বার্মা অভিমুখে ডিসেম্বর, ১৯৪৪ সালে রওয়ানা দেয়। কিন্তু মার্চ, ১৯৪৫ সালে প্রবল যুদ্ধে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর ফলে আইএনএ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের বাহিনী ইম্ফলে প্রবেশ করবে। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী মে, ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং মার্চ, ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বার্মায় কারাগারে আটক ছিলেন। দিল্লীতে আইএনএ সদস্যদের বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি অবিভক্ত ভারতে ফিরে আসেন।
পরবর্তীতে মার্চ, ১৯৪৭ সালে লাহোরে কর্ণেল প্রেম সেহগালের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিবাহ-পরবর্তী সময়কাল তারা কানপুরে স্থায়ীভাবে আবাস গড়েন। সেখানে তিনি চিকিৎসা চর্চা ও ভারত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে আগত ব্যাপকসংখ্যক শরণার্থীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।
সেহগাল দম্পতির দু'টি কন্যা সন্তান - সুভাষিণী আলী এবং অনিশা পুরী রয়েছে।
১৯৭১ সালে লক্ষ্মী সেহগাল সিপিআই (এম)-এ যোগ দেন ও রাজ্যসভায় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮১ সালে সিপিআই (এম)-এর অখিল ভারতীয় জনবাদী মহিলা সমিতির নারী শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন বিধায় বিভিন্ন দলীয় কর্মকাণ্ড ও প্রচারণায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে ভূপালের গ্যাস দূর্ঘটনায় চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেন। একই বছর শিখবিরোধী দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে কানপুরে জনসংযোগ করেন। ১৯৯৬ সালে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে গ্রেফতার বরণ করেন। ৯২ বছর বয়সী হয়েও ২০০৬ সালে পর্যন্ত কানপুরে নিয়মিতভাবে নিজ ক্লিনিকে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেন তিনি।
২০০২ সালে ভারতের চারটি বামপন্থী দল -সিপিআই, সিপিআই (এম), বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল এবং অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক লক্ষ্মী সেহগালকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেয় কিন্তু তিনি এপিজে আব্দুল কালামের কাছে পরাজিত হন।
১৯ জুলাই, ২০১২ সালে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল হৃদযন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত হন। অতঃপর ৯৭ বছর বয়সে ২৩ জুলাই, ২০১২ সকালে ১১:২০ মিনিটে কানপুরে মৃত্যুবরণ করেন। কানপুর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রয়োজনে তাঁর দেহ দান করা হয়।