চিঠির শুরুতে কখনই তোমার নাম সম্বোধন করতাম না আমি কারণ, ভালোবাসাকে নামের অক্ষরে বন্দী করতে চাইনি। তবে আজ চিঠি নয় তোমাকে নিয়ে দারুণ এক রোমান্টিক গল্প লিখবো বলে লেখা শুরু করলাম। কিন্তু রোমান্টিকতার ভারে শব্দের পর শব্দ আর গল্প থাকে না, কবিতা হয়ে যায়। আবার কবিতায় যখন আরো ভালোবাসার দোল লাগে সেটা আর কবিতা থাকে না, গান হয়ে যায়।তোমাকে কত দিন বলেছি আমার জন্য একটা কবিতা লেখো না প্লিজ, তুমি বলেছো, আমাকে নিয়ে লিখতে বসলে তোমার কলম অসাড় হয়ে যায়। কত রজনী গুন গুন করে তোমাকে ঐ গানটা শুনিয়েছি, যাতে তুমি আধাটা কবিতা হলেও লেখো আমার জন্য, ঐ যে, সেই গানটা, “একটা গান লিখো আমার জন্য...”, কই তুমি তো লিখোনি। তাই ভাবলাম ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে আমিই তোমার জন্য গল্প লিখে ফেলি। কিন্তু তোমাকে নিয়ে কি গল্প লেখা যায়?
জানো তো গল্পের নায়ক হতে হলে নিখুঁত হতে হয়, সব দিক দিয়ে নিখুঁত। দর্শনে নিখুঁত, কাজে কর্মে নিখুঁত, চলনে বলনে নিঁখুত, চিন্তায় নিঁখুত। কিন্তু দেখো, আমার গল্পে আমি কোনোভাবেই তোমাকে নিখুঁত নায়কের রূপ দিতে পারছি না। না পারছি তোমাকে নিখুঁত বানাতে - না পারছি নিজের একটি নিঁখুত চরিত্র কল্পনা করতে। তাহলে গল্প হবে কি করে?
বাংলা সাহিত্যের কোনো গল্প কিংবা উপন্যাসে কি কখনও অসুন্দর অসম্পূর্ণ নায়ক-নায়িকার বর্ণনা পড়েছো? পড়োনি তো। রূপকথার গল্পে দু’একজন থাকলেও, রাজকুমারীর জাদুর পরশে তারা সুন্দর হয়ে গেছে। গল্পের নায়ক নায়িকারা সব সময় সুন্দর-ই হয়, নিঁখুত হয়। তুমি- আমি কি তেমন, বলো? তাই আমাদের নিয়ে গল্প হয় না। কিন্তু আমাদের নিখুঁত ভালোবাসা নিয়ে তো একটা গল্প হতেই পারে।
সেই কবে তুমি আর আমি ঢাকার পথে রিক্সায় বসে স্বপ্ন দেখেছিলাম, মনে আছে তোমার? ইশ্! কি গরমই-না ছিল সেদিন। বর্ষার মাঝামাঝি, তবু আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে নি। তুমিও কদম ফুল আনো নি আমার জন্য, বর্ষার প্রথম কদম ফুল! তখন তো আর হাতে স্মার্ট ফোন-সাথে এ্যাকুওয়েদার অ্যাপ ছিলো না, থাকলে নিশ্চয়ই বৃষ্টি হবে এমন দিনেই তোমার সাথে দেখা করতে যেতাম, তাই না?
আমি ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই তোমার খুব বিপদ, তা না হলে এতো তড়িঘড়ি তলব কেনো দেখা করার? তোমার মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিলো, চেহারা ভীষন অন্ধকার। আমি ভাবছি, কি বলবো তোমাকে? কিভাবে সাহায্য করবো? তোমার কন্ঠস্বর মলিন লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম। আমিই কথা শুরু করলাম তোমাকে স্বাভাবিক করতে। একথা সে কথা বলে ঘুড়েফিড়ে তোমার কথা শুনার আগ্রহ প্রকাশ করলাম, ‘কথা’ বললে ভুল হবে, তোমার সমস্যা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তুমি অনেক কথার মারপ্যাঁচে যা বলেছিলে বা যে প্রস্তাব দিয়েছিলে সেদিন তাহলো বন্ধু হবার প্রস্তাব? অন্তত আমি সেদিন তাই-ই বুঝেছিলাম। এমন এক বন্ধু যে কখনই ছেড়ে যাবে না অপর বন্ধুকে। তারপর সে কথাই তুমি সুন্দর সাহিত্যক ভাষায় চিঠিতে লিখেছিলে।
সেই তো শুরু...এভাবে মাস গেলো বছর গেলো, তোমাকে একটু একটু করে চিনতে লাগলাম। ভালো তোমাকে, খারাপ তোমাকে। ভাবলাম, ভালো তোমাকে ভালোবাসবো নাকি খারাপ তোমাকে? সিন্ধান্ত নিলাম তোমার সীমাবদ্ধতা সহই তোমাকে ভালোবাসবো। শুধু খেয়াল রাখলাম তোমার সীমাবদ্ধতাগুলো যেন আমার সীমাবদ্ধতা না হয়ে যায়। না, তা হয় নি কখন। তবে তোমার সীমাবদ্ধতাগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে অনেক। আমার কষ্ট হয়েছে, আমার মেয়েরও কষ্ট হয়েছে। অস্বীকার করছি না যে তুমি চেষ্টা কর নি সামলে নেবার কিন্তু জন্ম থেকে যে সীমাবদ্ধতা নিয়ে বেড়ে উঠেছো সে কি সামলানো যায়? ভয় নেই, মেয়ে ভুলে গেছে, গর্ভকালীন কষ্টের কথা অনাগত শিশুর মনে থাকবার কথা নয়। কিন্তু আমি ভুলি নি, যাকে বলে ঘা শুকিয়ে গেছে কিন্তু দাগ মোছে নি।পাশাপাশি ভুলি নি তোমাকে ভালোবাসতে। কারণ সেদিন আমি বুঝেছিলাম, তোমার সীমাবদ্ধতা শুধু তোমার সীমাবদ্ধতা নয়, বাঙ্গালি পরিবারের সকল ছেলের-সকল পুরুষের সীমাবদ্ধতা। অসহায়ত্বের সীমাবদ্ধতা, অসম্মানের সীমাবদ্ধতা। তোমার ভালোবাসাকে অসম্মান, তোমার অনাগত শিশুকে অসম্মান, সে তো তোমার অসহায়ত্বই, তোমার অসম্মান।
তুমি বলেছিলে বদলে যাবে সমাজ যদি আমরা স্বপ্ন দেখি; স্বপ্ন আমরা ঠিকই দেখেছি কিন্তু পারি নি বদলে দিতে ঐ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে। শেষে সেই অসুস্থ সমাজ থেকে পালিয়ে বেঁচেছি।
এখন আমরা স্বাধীন, আমার ভালোবাসাও স্বাধীন। তাই ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে তোমায় দিলাম সকল ভ্রান্ত ধারণামুক্ত ভালোবাসা। মনে রেখো, যদি কখনও হারিয়ে যাই, যেখানেই থাকি না কেনো, যত দূরেই থাকি না কেনো, যদি কখন ভালোবাসাহীনতায় ভোগো, ভেবো, আমি আজো ভালোবাসছি তোমাকে । ইতি-বউ।