নিউজার্সি সিটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় নাদেরের সাথে পরিচয়। আমি তখন আমেরিকায় নতুন। বাবা মা আমেরিকায় আসতে দিতে চান নি প্রথমে। বাড়ির বড় মেয়ে তার উপর আমাদের পরিবার খুব প্র্যাকটিসিং। আমার মা ও অন্যান্য বোনরা হিজাব পরে। আমি যদিও হিজাব পরি না তবে চেষ্টা করি নামাজ পড়তে।
আমেরিকায় এসেও আমি খুব হালাল হারাম বেছে খাই। আমেরিকায় যখন আমার টিউশন ফি’তে টানাটানি অবস্থা তখন ছুটির দিনে একটা পিজার দোকানে কাজ শুরু করি। কাজটা বৈধ নয়। পিজার দোকানের মালিক লেবানীজ। আমাকে নগদ টাকায় বেতন দিতো। এখানে বলে ক্যাশে কাজ করা। ক্যাশ দিতো বলে আমাকে খুব কম টাকা দিতো। অভাব বলে আমি তাতেও রাজী।
এখনকার মতো তখন ফেসবুক ছিলো না। আইসিকিউ নামে একটা চ্যাট সার্ভিস ছিলো। ওখানে আমি টাইগ্রেস নিক নিয়ে লগইন করতাম। নাদেরের সাথে তখন অনলাইনেই কথা। ক্লাস, পড়াশুনা, পিজার দোকানে ডো বানানোর কাজে হাঁপিয়ে উঠে রাতে আমার বিনোদনের অংশ অতটুকুই, নাদের।
নাদেরের নিক ছিলো রূপগঞ্জের রূপকথা। এরকম নিক দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম প্রথমে। বাংলা ভাষায় কেউ নিক রাখতে পারে অনলাইনে ভাবতেও পারি নি। আমার নিক টাইগ্রেস দেখে দুনিয়ার মানুষ আমাকে ইনবক্স করতো। নিক মানেই মুখোশ বলে লোকজন ইনবক্সে সরাসরি বিছানায় যাবার প্রস্তাব করতো।
হাই সেক্সি, হটি এসব সম্বোধন তো মামুলি। কেউ কেউ সরাসরি তার ন্যুড ছবি পাঠাতো ইনবক্সে। আমার গা ঘিনঘিন করে উঠতো। কতো আর ব্লক করবো!
বসন্ত বাতাসের মতো একদিন আবিষ্কার রূপগঞ্জের রূপকথা। নাদেরের সাথে সেই চ্যাট শুরু। নাদের তখন থাকতো পেনসেলভেনিয়া। আমার একাকীত্ব, সংগ্রাম আর কষ্টের পাশে এসো দাঁড়ালো নাদের। আমার মনের সমস্ত জানালা খুলে আমি নাদেরকে বলি সব আভাষ। নাদেরও।
এরকম ক্ষেত্রে যা হয় এক পর্যায়ে টাইপ করতে ভালো লাগে না আর। শুরু হয় আমাদের দূরালাপনী কথোপকথন। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম টেলিফোনে।
একবার আমার জন্মদিনে সে আমাকে অবাক করে আমার শহরে হাজির। ড্রাইভ করে আসতে বেশিক্ষণ লাগে না। আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে নাদের হাজির। কতো কী উপহার! চোখ ভিজে যায় আনন্দের আল্পনায়। দু’জনে কেক কাটি। নাদের চলে যাবার সময় আমরা পরম নির্ভরতায় ভালোবাসার তপন দেখি। সেই প্রথম নাদের আমাকে চুমু করে। টের পাই আমার ঊনিশ বছর। আমার দ্রাঘিমা, আমার প্রণয় কুসুম।
নাদেরের সাথে আমার ঘন ঘন দেখা হতে লাগলো। নাদেরের বোন, বাবা মা আমার পরিবারের অংশ হয়ে উঠলো যেন। ছবির ওরা যেন আমার কাছে কতো জীবন্ত যেন।
বিয়ে না করে আমাদের এরকম তীব্র শারিরীক সম্পর্ক একপর্যায়ে আমাকে খুব অপরাধী করে ফেলে। একবার নাদেরের ওয়ালেট থেকে আমি কনডমের প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে বললাম-
: নাদের আমরা বিয়ে করি, চলো।
নাদেররা খুব ধনী। সেবার ওর বাবা মা আমেরিকায় বেড়াতে এলে নাদের ওর বাবা মায়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওর মা বললো- তুমি তো খুব সুইট লক্ষ্মী মেয়ে।
আমার পড়াশুনার স্পীড বেড়ে গেলো। জিম করতে শুরু করি। নাদেরকে আর কাছে ঘেঁষতে দেই না। তীব্র আদর করতে ইচ্ছে করলে আমি সুন্নত নামাজ পড়তাম। কখনো রোজা রাখতাম। আমি নাদেরের বউ ভাবতে শুরু করি। নিউজার্সিতে প্রচুর বাঙ্গালী। কারো সাথে আমার মেলামেশা নেই। হাইওয়ে ধরে সাঁ সাঁ গাড়ি চালাবার সময় আমি সিডি প্লেয়ারে বিয়ের গান শুনছি “লীলাবালি লীলাবালি”।
সামারের ছুটিতে প্রথমবারের মতো দেশে গেলাম। মা বাবা ছোট বোনদের দেখার জন্য আমি পাগল হয়ে উঠছিলাম। তাছাড়া নাদের তখন দেশে। আমাদের বাসায় তখন নাদেরের কথা জানে। বোনরা নাদেরকে দুলাভাই বলে খেপায়।
একদিন ছোটবোনের সাথে রিক্সায় করে গাউসিয়া মার্কেটে যাবার সময় খবর এলো বোমা ফাটানোর মতো করে যে নাদেরের মা বিয়েতে রাজী নন কারণ ওদের ফ্যামিলির সাথে আমার মধ্যবিত্ত পরিবারের এডজাস্ট হবে না।
আমার সবকিছু স্বপ্ন, আগামী চুরচুর করে ভাঙ্গতে থাকে। আমেরিকা যাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। ধ্বংসাত্মক কিছু করবার ইচ্ছা হলেও বাবা মায়ের কথা ভেবে আবার বাঁচবার কথা ভাবতে থাকি।
একদিন অনেক সাহস করে নাদেরদের বাসায় ফোন করি। ফোন নাদেরই ধরে।
আমি তখনই খানখান হয়ে পড়ি, আশ্চর্য নাদের আমার কন্ঠ পর্যন্ত চিনলো না।
বেঁচে থাকাটা এতো দীর্ঘ মনে হতে থাকে, এতো যাতনা বিষের যে আমার নিজের কাছে নিজের শরীরটা অসম্ভব ভারী হতে শুরু করে। এক রুম থেকে অন্য রুমের দূরত্ব হাজার মাইল মনে হতে থাকে। মা আমাকে হিজাব পরিয়ে দেন। যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সারাদিন ধর্মকর্ম করতে থাকি।
সেজো বোন আমাকে ফেসবুকে একটা একাউন্ট খুলে দেয় মন ভালো করার জন্য। একদিন সন্ধ্যায় ফেসবুক খুলে চমকে উঠি, দেখি রূপ গঞ্জের রূপকথা নামে এক আইডি আমাকে বন্ধুতার অনুরোধ পাঠিয়েছে।
পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম সময়ে আমি আইডিটা ব্লক করে দেই।
ছোট বোনটা পাশের রুমে কী যেন করছিলো। দৌঁড়ে ওর কাছে গেলাম। চিৎকার করে বললাম-
: ছোটু, চল গাউসিয়া যাবো।
: বড়পু এখন? সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো।
: চুপ কর ছেমড়ি। চল..
রিক্সা ছুটলো। মনে হচ্ছে আমরা দুই বোন পংখীরাজের ঘোড়ায় করে যাচ্ছি। খিলখিল করে অকারণে হাসছি দুই বোন। হঠাৎ ছোটু আমার দিকে অবাক তাকিয়ে বলে-
: বড়পু তোর মাথায় দেখি হিজাব নেই?
বলেই আমরা দুই বোন আবার ঝরণার হাসিতে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ি অকারণ।
পৃথিবীতে আমরা কতো কী করি অকারণ!