চৈতী আহমেদ

প্রধান সম্পাদক, নারী

রূপা হত্যার বিচার হলো, তনুসহ অন্যান্য ধর্ষণ ঘটনারও বিচার হোক!

টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্তবাসে গণ ধর্ষণের শিকার জাকিয়া সুলতানা রূপার ধর্ষণ মামলায় গতকাল ৪জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই মামলায় ঘটনার সাথে জড়িত বাসের সুপারভাইজারকে সাত বছরের জেল দেয়া হয়েছে। রূপার পরিবার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

জাকিয়া সুলতানা রূপা উচ্চ শিক্ষিত আত্মনির্ভরশীল সাহসী একজন নারী। ঢাকা আইডিয়াল ’ল কলেজের শিক্ষার্থী। রূপা ছিলো তার পিতৃহীন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল সদস্য। ২৫ আগস্ট ২০১৭ রাতে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে বাসে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে কর্মস্থলে ফেরার পথে বাসটি এলেঙ্গা পৌঁছালে বাসের অন্যান্য যাত্রীরা নেমে যায়। রূপাকে নিয়ে বাসটি কালিহাতি এলাকা পার হওয়ার সময় গাড়ির হেল্পার ও অন্যান্যরা একা পেয়ে রূপাকে গাড়ির পেছনের সীটে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।বাসটি মধুপুর পৌঁছালে রূপা বাইরে আলো দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলে ধর্ষণকারীরা তাকে ঘাড় মটকে হত্যা করে মধুপুরের পঁচিশ মাইল এলাকার জঙ্গলে ফেলে দিয়ে চলে যায়। লাশ আবিষ্কারের পর হত্যার আলামত দেখে মধুপুর থানার পুলিশ অজ্ঞাতনামাদের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।

পরিচয় উদ্ধার করতে না পেরে টাঙ্গাইলের গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। গণমাধ্যমে লাশ উদ্ধারের সংবাদ প্রকাশিত হলে রূপার বড় ভাই থানায় গিয়ে রূপার লাশ সনাক্ত করে। প্রশাসনের স্বদিচ্ছায় আটক করা হয় সম্ভব হয় অপরাধীদের। ধর্ষকরা স্বীকারোক্তি দেয় ঘটনার।

কি নির্মম ছিলো সেই স্বীকারোক্তি! সেই স্বীকারোক্তির পরে লজ্জিত না হয়ে এই সমাজের কোনো কোনো পুরুষ তর্ক জুড়েছিলো এই বলে যে - ‘সব পুরুষ এক নয়’ অথচ রূপাকে বারংবার ধর্ষণের পর ঘাড় মটকে বাইরে ফেলে দেয়া ধর্ষকরা সবাই ছিলো তাদের মতোই পুরুষ। সবল পুরুষ। এই লিঙ্গবাদী সমাজেরই পুরুষ। ধর্ষকরা স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো অমানবিকভাবে রূপাকে ধর্ষণের। বর্ণনা দিয়েছিলো “কিভাবে তারা রূপাকে একা পেয়েছিলো,  কিভাবে তারা রূপার দিকে পুরুষতন্ত্রের শিখিয়ে দেয়া লোলুপতা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো। রূপা অনুনয় বিনয় করেছিলো, সাথে থাকা টাকার বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করছিলো। কিন্তু পুরুষ, সে সমাজের নিম্নশ্রেণির পুরুষই হোক আর আর্মি অফিসারই হোক। রিক্সাওয়ালাই হোক আর আপন জুয়েলার্সের মালিকের মতো ধনীর পুত্রই হোক তারা সবাই এই পরিবার, সমাজে, ধার্মিক রাষ্ট্রে নারীকে শুধু শারিরীক ভোগের বস্ত বলে জেনেই বেড়ে উঠা পুরুষ।এই পরিবার, সমাজ, রাষ্টই তাদের শিখিয়েছে -তুমি পুংলিঙ্গ নিয়ে জন্মেছো, যেখানে যে অবস্থায় নারীকে পাবে তার মধ্যে প্রবেশ করার জন্য। তোমার লিঙ্গ যখন উদ্ধত হবে তখন নারীর অর্থ বিত্তের দিকে আগে তাকাবে না। তার শিক্ষার দিকে তাকাবে না। তাকাবে তার স্তনের দিকে, তাকাবে তার যোনির দিকে। তোমার লিঙ্গ আছে মানেই সমাজের যে কোনো স্তরের নারী তোমার ভোগ্য। বাগে পেয়ে তুমি যেমন তোমার গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করবে তেমনি বাগে পেলে তুমি তোমার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন নারীকেও ধর্ষণ করবে।”

সেই সময় আলোচিত রূপাকে নির্মমভাবে ধর্ষণের সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় বইতে থাকে। এই সময় ফেসবুকসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকেরই মন্তব্য ছিলো এমন যে -মেয়ে হয়ে রূপা কেনো একাকী রাতের বাসের যাত্রী হলেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন -রূপা কেনো অন্যান্য যাত্রীদের সাথে নেমে না গিয়ে একা বাসটিতে রয়ে যাওয়ার সাহস দেখালেন?এই সমাজ এখনও মনে করে নারী হলেই তাকে কোনো না কোনো পুরুষের সাহায্য নিয়েই পথ চলতে হবে। নারী হলেই তাকে সন্ধ্যার আগে আগেই খোয়াড়ের পশুপাখির মতো ঘরে ফিরতে হবে। রাষ্ট্রও এই ধারনার বাইরে আসতে পারে না। একটি ধার্মিক রাষ্ট্রের তা পারার কথাও নয়।

মহিলা পরিষদের একটি পরিসংখ্যান বলছে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৩০৪টি ধর্ষণ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অধিকাংশ ঘটনাকেই আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় নি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট লিখতে লিখতেই ঘটনা লোপাট হয়ে যায়। আর যে বিচারগুলো আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই ধর্ষণ প্রমাণ করতে না পারায় ডিশমিশ হয়ে যায়। কিছু মামলা ধর্ষণের শিকার নারীর অজ্ঞতার কারণে আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘঠিত অধিকাংশ ধর্ষণই সালিশ পর্যায়ে আপোস মীমাংসার মাধ্যমে চেপে যাওয়া হয়।

এই দেশের নারীদের দুর্ভাগ্য যখন যে দলই ক্ষমতায় আসুক বেশির ভাগ নারী ধর্ষণের শিকার হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা। যার কারণে ক্ষমতাসীনদের হুমকি ধামকিতেই ধর্ষণের শিকার নারীরা আর বিচারের দারস্থ হওয়ার সাহসই পায় না। উল্টো হয়রানীর শিকার হয় ধর্ষণের শিকার নারীটির পরিবার। এই সব ক্ষেত্রে প্রশাসনও ধর্ষককে বাঁচাতেই মরিয়া হয়ে ‍উঠে। উপরোল্লেখিত ধর্ষণ সংখ্যার অধিকাংশতেই  ছাত্রলীগ এবং আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরাই ছিলো অভিযুক্ত। স্বভাবতই ধর্ষণ ঘটনাকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় নি।দুঃখজনক বিষয়টি হলো প্রতিদিন যেখানে দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সেখানে দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ধর্ষণ বিষয়ে কোনো বক্তব্যই পাওয়া যায় না। ধর্ষণের বিষয়ে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও সুষ্ঠ তদন্তের নির্দেশ দেয়াতো দূরের কথা নিন্দা জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করেন না। সমাজের যে পর্যায়েই হোক সরকার প্রধান নীরব থেকে বুঝিয়ে দেন যে তিনি নারী হলেও পুরুষতন্ত্রেরই প্রধানমন্ত্রী, তিনি নীরব থেকে বুঝিয়ে দেন যে তিনি একটি ধার্মীক রাষ্টের প্রধামমন্ত্রী। যার কারণে এই দেশে ধর্ষণ হয়ে উঠেছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আজকাল ৬/৭ মাসের শিশু ধর্ষিত হলেও মানুষ আর অবাক হয় না। আগে তো তবু মানুষ রাস্তায় নামতো এখন ধর্ষণের ঘটনা পড়ার পরে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকার পাতা উল্টায়  না হলে ফেসবুক রিফ্রেশ দেয়। অনেক আগেই দেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

এই প্রসঙ্গে  সম্প্রতি কিছু আলোচিত ধর্ষণ ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়।  

সোহাগী জাহান তনুর কথা মনে আছে? ২০১৬ সালে ২০ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সোহাগী জাহান তনু’র ধর্ষিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছিলো। দুই দুইবার ময়না তদন্তে ধর্ষণ প্রমাণিত হওয়ার পর তদন্তে অপরাধীকে সনাক্ত করা গেলেও তনুকে ধর্ষণকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেউকেটা কেউ হওয়ায় তনুকে ভাল্লুকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে বলে ঘটনা ধামা চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো! অপরাধীদের রক্ষার জন্য সেই সময় তনু হত্যার দাবিতে শাহবাগের উত্তাল আন্দোলনকে টিয়ারশেল, গরম পানি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। রাষ্ট পক্ষ রূপা হত্যার বিচার করে কলার ঝাঁকানোর আগে মনে করিয়ে দিতে চাই তনুকে আমরা ভুলি নাই। তনু হত্যার বিচার চাই!

রাঙামাটিতে বিলাইছড়ি উপজেলায় সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালীন সময়ে দুই মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা ধামা চাপা দেয়ার চেষ্টা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। অবিলম্বে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পরিবারকে হয়রানী বন্ধ করে ধর্ষণকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি এখন দেশের সর্বস্তরের মানুষের দাবি। অথচ প্রশাসন এই ঘটনায় ধর্ষণকে রাজনৈতিক ঘটনায় পরিণত করে ফেলেছে। যা দেশের গণতান্ত্রিক চর্চাকে ব্যাহত করবে এবং নারী সমাজকে আরো বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলবে।বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ মামলারও কোনো আপডেট নেই। মিডিয়াও এই বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব হয়ে গেছে।

রূপা ধর্ষণ মামলায় দ্রুত বিচার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে কারণ ধর্ষণকারীরা সমাজের কেউকেটা কেউ নয় বাস শ্রমিক। তাদের একবার কেনো দশবার ফাঁসির আদেশে দিয়েও রাষ্ট্রপক্ষ বাহবা কুড়াতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য সোহাগী জাহান তনু, মারমা কিশোরীর এবং আমাদেরও যারা দীর্ঘদিন ধরে তনুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবী জানিয়ে আসছি। যারা মারমা কিশোরীর ধর্ষণের বিচার চেয়ে তাদের পরিবারকে হয়রানী বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছি। দুর্ভাগ্য এই কারণে যে ধর্ষক এবং হত্যাকারী ভাল্লুকেরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। জনরব আছে এইদেশে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে এই সেনাবাহিনীকে দুধটা কলাটা দিয়ে বশে রাখতে হয়। সেই হাতে রাখার প্রক্রিয়া আমরা যেমন দেখছি পাহাড়ে তেমনি সমতলেও সমান তালে। যাদের হাতে সরকারের প্রাণ ভোমরার বাস তাদের বিচারে সরকারের নিলর্জ্জ তাল বাহানা সুস্পষ্ট।

কাল যখন রূপা ধর্ষণের মামলায় চারজন আসামীর ফাঁসির আদেশের রায় হলো তখনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে ধর্ষণের সংবাদ পত্রিকায় পাতায় শিরোনাম হয়েছে। আজ যখন এই লেখাটি লিখছি তখন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ এর ঘটনা ঘটছে না এমন গ্যারান্টি নেই। যে দেশের নারীর নূন্যতম নিরাপত্তা নেই সেই দেশে সুশাসন সুদূর পরাহতই ধরে নিতে হবে। প্রশাসন এবং সরকারের উদাসীন ভূমিকার কারণেই সারাদেশ আজ ধর্ষকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা দেশের নারী সমাজ দেশের প্রধান নির্বাহীর কাছে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের দাবি জানাচ্ছি। আশা করি তিনি ঘুমিয়ে থাকবেন না। রূপার হত্যা মামলার মতো অন্যান্য ঘটনাগুলোরও যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিচারে আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেবেন বলেই প্রত্যাশা জারি রাখছি।

 

8767 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।