সেই নডির বয়স এখন কম কইরে হইলেও পঁচাত্তর হইবো। সে কী কইবো? কথাটা এমন অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতায় বলে রুহুল আবশ্যিক প্রশ্নে ফিরে যায়, তাহলে কয়টায় রওয়ানা করছো? সকাল দশটার বাসে বলে আমরা 'না করলেও চলে' জাতীয় কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে আপাত ফোনের কথা শেষ করি। আমি 'করা উচিত' যে প্রশ্নটা তা করতে ভুলে যাই। রুহুল কী নারীটিকে চিনে? কী করে চিনে?
'নডি' শব্দটি আমার কানে বহুমাত্রিক অর্থ নিয়ে দ্রিম দ্রিম করতে করতে আমাকে জীবনের প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের গলি ঘুপচি চেনাতে থাকে। শব্দের খোল নলচে পাল্টানোর অন্দরে সমাজত্তত্বের বিবর্তন, ভাষার রাজনীতি। নট থেকে নটি। প্রথম পেশাদার বাঙালি নারী মঞ্চাভিনেত্রীর বিশেষণ। নটি বিনোদিনী। সে কী আদতেই দেহপসারিণী ছিলো? নাকি কেবলই গিরীশবাবুর রক্ষিতা? এই নটি শব্দটি কী করে দেহ ব্যবসার সমার্থক হয়ে গেলো? আঞ্চলিক উচ্চারণে নডি। সেই মফস্বল শহরে থাকার সময় আমিও একটা নাটক করেছি। একদল কলেজ পড়ুয়া সহপাঠীর সাথে মঞ্চে। আমাকে কি আড়ালে আবডালে কেউ এনামে ডাকতো? কলেজের বার্ষিক নাটক। সেই শহরের স্থানীয় কোনো মেয়ে নাটকে আসলো না সমালোচনার ভয়ে। বাইরে থেকে যাওয়া আমার সমালোচনা নিয়ে মাথাব্যথা ছিলো না। মাথাটা তাই ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম 'নটি' হওয়ার ভেতরে। তখন অবশ্য শব্দটি উৎসের অর্থে নেই।
যাক, এসব আমার এমূহুর্তের ভাবনার বিষয় নয়। প্রয়োজনও নয়। আমার প্রয়োজন আমার প্রজেক্ট পেপারের জন্য সেই নারীর একটা পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য। রুহুল বলছিলো ওই মহিলা কী কিছু বলতে পারবে? আমিও সন্দিহান, সমাজতাত্ত্বিকের মতো এসব নিয়ে ভাবাতো এদের কাজ নয় যে মতামত দেবে! তবু চেষ্টা করতে দোষ কি! আমার প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের মাথায় ঢুকে গেছে, এদেশের শহর গ্রামাঞ্চলে বেশ্যালয় বা পতিতালয়গুলো উচ্ছেদ হওয়াই দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্ববহনকারী কারণ। একজন অভিজ্ঞ মাস্টারের মতো নানা যুক্তিতে, নানা কায়দায় বুঝাবার অনেক চেষ্টা করেছি, মঈনুল ভাই, দেশের সামাজিক ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিয়ে কেনো প্রজেক্টের তেরোটা বাজাচ্ছেন। বিদেশি অর্থায়নে আমরা দু দশজন নারী করে টরে খাচ্ছি, আমাদের বদৌলতে আরো দু দশজন নারী উপকৃত হচ্ছে। ধর্ষিতাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি, আইনী সহায়তা দিচ্ছি, পুনর্বাসন করছি। কেনো শুধু শুধু কন্ট্রোভার্সিয়াল ব্যাপার টেনে এনে ঝামেলা পাকাচ্ছেন?
কিন্তু মঈনুল ভাই নিজেতো আমার যুক্তিতে পটেনই নাই, উল্টা তার যুক্তিতে কান্ট্রি ডিরেক্টরকে এমনভাবে কনভিন্স করে ফেলেছেন যে দ্বিগুণ উৎসাহে কান্ট্রি ডিরেক্টর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আর যথারীতি ফিল্ড এসেসমেন্টের দায়িত্বটা আমার ঘাড়েই দিয়েছেন।
মোটামুটি গুছিয়ে এনেছি, শেষে দরকার পড়লো একজন পেশা ছেড়ে দেয়া অভিজ্ঞ নারীর মতামত। প্রথমেই মিন্টুর দ্বারস্থ হলাম। ও বলে কয়েই আড্ডা থেকে উঠে যায়, "হয়ে আসে"। কিন্তু সে যাদের সন্ধান দিলো, তারা যেনতেন নয়, খোদ ঢাকার গুলশানে বাড়ি ভাড়া করে পেশা চালানো এলিট দেহব্যবসায়ী। মিন্টুর মোটেই কোনো রাখঢাকের মুখোশ নেই। বললো, চাইলে যেতে পারিস আমার সাথে আমি রাতটা থেকে গেলাম, তুই পেমেন্ট করলি, হাজার দশেক হলেই চলবে। বলে হো হো প্রাণখোলা হাসি হাসে মিন্টু। কিরে টাকার অংক শুনে ঘাবড়ে গেলি? কথা বলছিস না?
আমি তখন অন্য হিসাবে, টাকার সাথে সম্পর্কহীন। চলতি পেশার মেয়ে দিয়েতো আমার চলবে না। এরা সুবিধা প্রাপ্তির অবস্থানে দাঁড়িয়ে বঞ্চিতদের বেদনার অভিজ্ঞতা বয়ানও দূরে থাক, বিষয়টি নিয়ে নির্মোহ মতামতও দিতে পারবে না।
আমার দরকার পেশা ছেড়ে দেয়া অভিজ্ঞ নারী। মঈন ভাই ফাঁকি ধরতে ওস্তাদ, ঝানু মাল। সাথে ছবি টবি এনক্লোজ করে দিয়ে তাকে বিশ্বাস করাতে হয়।
এবার ভেবেচিন্তে ধরলাম তরুণকে। বিয়ে শাদি করে নি, এদিক সেদিক যাবার অভ্যাসে রাকঢাক নেই। আসলে এসবের খবর রাখে এমন বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজে বের করাইতো মুশকিল। যার তার সাথে শেয়ার করার মতো জলবৎ তরলং ব্যাপার নয় এটা যে, যে কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসবে কিংবা সহজ ভাবে নেবে।
তরুণের সাথে আলাপ করার সময় আব্বা যেনো কি করে শোনলেন বিষয়টা, ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। কাগজে শহরের নাম আর নারীর নাম লিখে দিলেন। আমি একটু অবাক হলাম। আব্বা এতো মনোযোগ দিয়ে আমার পেশাগত কাজকর্ম অনুসরণ করে টেরই পাইনি।
আব্বা ব্রেইন স্ট্রোক করার পর কথা বলতে পারেন না। কী করে একটা দেহপসারিণী নারীর নাম ঠিকানা সব মনে রাখলেন, আমাকে দিলেন এ জাতীয় কিছু আব্বাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আব্বা উত্তর দিতে পারবেন না।
আমার তৎক্ষণাৎ রুহুলের কথা মনে পড়ে। সেই শহরে থাকে। রুহুল একসময় আমার প্রেমে পড়েছিলো। আব্বার যখন সেই শহরে পোস্টিং ছিলো, তখন। সেই শহরে তখন ইলেকট্রিক থাম্বার নিভু নিভু বাল্ব বেয়ে রাত নামতো সেবা প্রকাশনীর রহস্য উপন্যাসের মতো। ছোট শহর অথচ এ মাথা ওমাথায় অচেনা রহস্য।
রাত রহস্য গল্পের ক্লাইম্যাক্সের মতো গভীর হতে থাকলে আব্বা আর আম্মা প্রতিদিন সেই নটি পাড়া নিয়ে ঝগড়া করতেন। বয়সের কারণে যার সবটুকু আমি বুঝতাম না, কেবল তীব্র ঘুমের ঘোরে একটা বাক্য ঘুম পাড়ানি গানের মতো তন্দ্রালু মাথার চারপাশে ঘুরঘুর করতো, বেহায়ার মতো পুকুরপাড়ের দিকে তাকাইয়া থাকিস ক্যান হারামজাদা। মায়ের ছিলো অশালীন অনিয়ন্ত্রিত রাগ, রাগ উঠলে হুঁশ থাকতো না, রাস্তার পাগলের মতো মুখ দিয়ে অসহনীয় অগ্নি শলাকা ছুটতো, হাতও নিয়ন্ত্রণ হারাতো। মা রেগে গেলে আমিতো বটেই, আব্বাই যে কতো চড় থাপ্পড় খেতো, তার ইয়াত্তা নেই। আব্বা নেহাৎ ভদ্রলোক, তাই...। শহরটা আমাদের খুব ভালো লেগে গিয়েছিলো, মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা বেশ দামদরের তোয়াক্কা না করে মাছ সবজি বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যেতো। যতো ছোট অফিসারই হোক বাইরে থেকে শহরে আসা, আঞ্চলিকতার টানহীন কথা বলা আমরা শহরের স্থানীয় অধিবাসীদের বেশ সমীহে থাকতাম। দোকানে আইস্ক্রিম খেলে কেউ না কেউ টাকা দিয়ে দেয়, কাপড় কিনতে গেলে দোকানদার পুরোহিতের বসার মতো চেয়ার ঝেড়েঝুড়ে পবিত্র করে দেয়।
আব্বা -আম্মা ঝগড়া করে সেই শহর ছেড়ে না দিলে হয়তো রুহুলের সাথে আমার জ্বাল উঠতে থাকা প্রেম সংসার গড়ার মতো ঘন গাঢ় ক্ষীর হতে পারতো। হয়তো লক্ষ্মী বউয়ের মতো সংসার করতাম। ঢাকায় এসে আর্ট কলেজে পড়তাম না, এই ছবির হাট, আজিজ মার্কেট মর্যাদা, অধিকার ইত্যাদি অনুভূতিগুলো মাথায় ঠাসতো না। যে কোনো নারী হয়ে রুহুল না হোক, আমার সন্তান তাহসানের জন্মদাতার 'ডাইনে কেনো যাচ্ছো', 'বাঁয়ে কেনো ঝুঁকছো' ইত্যাদি সব বিধি নিষেধ প্রশ্নহীন, নির্বিবাদে মেনে চুপ করে সংসার করতাম। তাহসানকে নিয়ে স্কুল যেতাম-আসতাম। লাউশাক আর কাঁচকি মাছ রান্না করতাম। এই মধ্যবয়সে জীবিকার প্রয়োজনে দেহপসারিণী খুঁজে হণ্যে হতে হতো না। হয়তো সেই শিকল বাঁধা পোষা প্রাণীর জীবন মানুষের কিনা, সে প্রশ্নও জাগতো না। এই আত্মমর্যাদা আর স্বাধীনতার স্বাদটা অচেনাই থাকতো।
ভাগ্যিস আব্বা পঁচিশ বছর আগের সেই এক স্মৃতির শহর আর একদম উপযুক্ত এক নারীর সন্ধান দিয়ে আমাকে এ যাত্রা উদ্ধার করলেন। রুহুল আমার সাথে একসাথে প্রাইভেট পড়তো। যদিও স্কুল আলাদা। কিন্তু সে আমার ছায়া থেকেও আলাদা হতো না। আমি যেদিকে যাই পিছন পিছন সাইকেল নিয়ে পিছু নিতো। বাসায় এসে আমার হাতে চিঠি গুঁজে দিতো, সেখানে লেখা থাকতো উই মাস্ট লাভ ওয়ান এনাদার অর ডাই। আব্বা ট্যুরে গেলে বাজার সদাইও করে দিতো আম্মাকে। শহরটার কথা মনে হতেই হুড়মুড় করে অনেক স্মৃতি আমার বুকের পাঁজরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমি রুহুলের জন্য ছটফট করতাম বিকাল হলেই। রুহুল স্কুলের বই লালু মিয়ার দোকানে রেখে বাস ধরে চলে যেতো ভৈরব। তখন ভৈরবের হলে মুক্তি পেয়েই সব নতুন ছবি আসে। সেইসব ছবির প্রথম শোর প্রথম দর্শক রুহুল। সিনেমা দেখে এসে এমনভাবে শাবনূর সালমান এর গল্প বলতো, যেনো আমাকে গল্প বলার দায় না থাকলে ও সিনেমা হলের পথই মাড়াতো না, আর আমিও ওর সাথে সাথে শাবনূর হয়ে কতো বন বাঁদাড় ঘুরে গান গাইতাম! সম্প্রতি ফেসবুকে ওর সাথে যোগাযোগ হয়েছে, তুলোর গাদায় সুঁই খুঁজে পাওয়ার মতো কঠিন ব্যাপারও এখন পান্তাভাত খাওয়ার মতো সহজ করে দিয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তখন সালমান শাহের মতো চুলে পনিটেল বাঁধা রুহুলকে এখন চেনা যায় না, মাথাজুড়ে টাক। মুখে ডায়াবেটিসের ক্লান্ত ভাঙাচোরা বন্ধুর ছাপ। রুহুলের সাথে চ্যাটিং ভিডিও কল না হলেও ফোন নম্বরটা নিয়ে রেখেছিলাম। ম্যাসেঞ্জারে বারকয়েক কল দিয়ে না ধরাতে নিশ্চিত হয়ে গেলাম অনলাইনে সে একেবারেই আনকোরা। তাই ফোনই ভরসা।
পুকুর পাড়ের বাসা থেকে দেখা যেতো অপর পাড়ে বাঁধা ঘাটলায় মেয়েদের দল কাপড় কাঁচছে, সিঁড়ির শেষ মাথার জলে ফেঁপে ওঠা ফেনাদলের শুভ্রতা চোখে পড়তো দূর থেকেও...কেউ বাসন মাজছে, পুকুরে গোসল করে ঘাটলার সিঁড়িতেই কাপড় ছাড়ছে একদল মেয়ে, তাদের অস্পষ্ট পেটের ভাঁজ, ভেজা শাড়ি লেপ্টে থাকা কোমর আর ফুটে থাকা স্তনবৃন্ত যেনো নিজেদের প্রকাশ্যে যৌবন দিয়ে আড়াল করতে চাইতো পুরো শহরের অবদমন। পাড়ার বাচ্চারা আঙুল তুলে দেখাতো, ঐ যে নডি পাড়া।
স্কুলে যাবার সময় নিশা, শারমিন এসে গেইটে দাঁড়িয়ে ডাকলে মা প্রতিদিন কড়া করে বলে দিতেন পুকুর পাড়ের দিকে তাকাইবা না। আজ পঁচিশ বছর পর সেই পুকুর পাড় দেখতে নয়, রীতিমতো গবেষণা করতে যাচ্ছি আমি। জীবনযুদ্ধ আমাকে ঠেলে পাঠিয়েছে। মা বেঁচে থাকলে আসতে দিতেন? নডিপাড়া নিয়ে মায়ের বাড়াবাড়ি রকমের স্পর্শকাতরতার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না।
বাসস্ট্যান্ড থেকেই ধাক্কা খাওয়া শুরু হয় আমার। ঈদ শেষে বাড়ি থেকে এসে নামতাম এখানে, একটা বিরাট গাছের নিচে আমাদের দাঁড় করিয়ে আব্বা রিক্সা ডাকতে যেতেন। আমি তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে লাগানো সাইনবোর্ড পড়তাম, "অর্শ, পাইলস, ভগন্দরের মহৌষধ", "সারিবাদি সালশা, সাধনা ঔষধালয়", "শক্তি ঔষধালয়"...। সেই গাছটি কোথাও নেই। বড় বড় বিল্ডিংয়ের জঙ্গলে গাছটি কোথায় অচিহ্নিত হয়ে গেছে নিঃশব্দে, বিস্মৃতও।
রুহুলকে ফোন করে ওর অফিসের ঠিকানা নিয়ে ওর অফিসের দিকে রওয়ানা হই। এটাও দ্বিতীয় ধাক্কা। রাত জেগে আমার পড়ার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুহুল আমাকে বাসস্ট্যান্ডে নিতেও আসেনি। আমি আশাও করিনি। তবু অস্বীকার করতে পারি না, মনের কোন কোণে লুকানো বাসনা ছিলো, যদি এসে দাঁড়িয়ে থাকে আমি রুহুলকে দেখে কি করবো এতো বছর পরে? আসেনি বলে বেদনা নাকি অবহেলা কী যেন একটা টের পাই ভেতরে ভেতরে!
রুহুল আমাকে দেখে একটু বিব্রত হয় যেনো । আমি কেমন আছি, আব্বা কেমন আছে, আম্মার অকাল মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ, আমার ডিভোর্সের জন্য আফসোস ইত্যাদি পোশাকী কুশল পর্ব শেষ করে ওর অফিসে বেশ দূরের একটা গেস্ট রুমে বসিয়ে 'আসছি' বলে কোনদিকে মিলিয়ে গেলো সে। আমার হাঁসফাস লাগছিলো। ধুর একাই তো কাজটা করতে পারতাম। রুহুলের সাহায্যের কোনো দরকারই ছিলো না। রুমে আরেকজন লোক বসা। একা, অনাহুতের মতো বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছে। রুহুলকে বোধহয় সমস্যায় ফেলে দিলাম। না পারছে কইতে, না পারছে সইতের যাঁতাকলে সে কুণ্ঠিত।
আমি রুহুলকে আবার ফোন করলাম, আমি একাই যাই অসুবিধা হবে না। সে 'একটু বসো,আসছি,আসছি,' বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলো। বেশি বিরক্ত হলে আমার সিগারেট না ধরালে চলে না। বের হয়ে একটা যথেষ্ট নিরিবিলি একটা চিপা খুঁজে সিগারেট ধরালাম। দু‘ টান দিতে না দিতেই পিয়ন টাইপ এক লোক পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ের মতো এসে হাজির। আরে এইডা কি? এইডা কি? মাইয়ালোক সিগারেট খায়, বলে এমন হৈ চৈ শুরু করলো, আমি বিব্রত হওয়ার বদলে বিরক্ত হলাম, আরে চুপচাপ বললেই হতো, ফেলে দিতাম। আমি রেগে গিয়ে উত্তর দিলাম, মাইয়া মানুষ সিগারেট খায় তো আপনার অসুবিধা কী? আরে আবার মুখে মুখে কথা কয়, কে এই নডি! এইখানে কই থিক্কা আইলো, পিনছে কি দেখো! শব্দটা আবার ধাক্কা দেয় মগজে! আরে আমি কি পরবো না পরবো এটাও তার মাথায় ব্যাথার মতো অসহনীয়! আমি আরো খেপে যাই, গালি দেন কেনো? আশ্চর্য! সে স্বর দ্বিগুণে সপ্তমে চড়িয়ে দেয়, এই বেহায়া নডি, এখানে কই থিক্কা আইলি? শার্ট পেন্ট পইরা সিগারেট খাইয়া স্মার্ট অওন লাগে তো এহানে ক্যান নডি পাড়াত যা। আমার মাথা ঠিক থাকে না, এগিয়ে যাই...। মূহুর্তে জনাকয়েক লোক জমে যায়। তামাশা দেখার অদম্য কৌতুহল সবার চোখেমুখে। তখন কোথা থেকে যেন উড়ে আসে রুহুল। কী হইছে? কী হইছে? সর সর যা যা আমার মেহমান, বলে সবাইকে তাড়িয়ে ছো মেরে আমাকে নিয়ে বের হয়ে রিক্সায় ওঠে পড়ে রুহুল। কাঁচা বয়সের আবেগ আকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই তার বলায়, চেহারায়ও। একটু যেনো ধমকের সুরেই বলে, এইটা কি পোশাক পরে এসেছো? এই শহরে এগুলা কেউ পরে না, তোমার ধারণা নাই? ভুলে গেছো? গিয়া দেখো, নডি পাড়ার মাইয়াডাও কী সুন্দর পোশাক পইরা থাকে। যদিও সেই লোকটি এ পোশাক পরে পাড়ায় যেতে বলেছে, আর রুহুল বলছে উল্টা কথা। কিন্তু নডি পাড়ার মেয়েরা আদতে কী পোশাক পরে এ নিয়ে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তখন আমাকে তাড়িত করে না। বরং মূহুর্তের জন্য উঁকি দিয়ে যায় যে প্রশ্নটি, তুমি কিভাবে জানো তারা কী পোশাক পরে, সেই লোকটিই বা কী করে জানে? প্রশ্নটি আমি হজম করে ফেলি। ওরা যাই পরুক, আমি নিজের টি শার্ট আর জিন্সের জন্য একটুও বিব্রত হই না। বরং বিরক্ত লাগে রুহুলকে ফোন দিয়ে সহযাত্রী করলাম বলে।
নির্দিষ্ট স্থানে নেমে মনে হয় জীবনেও এ জায়গাটি আমি দেখি নি। কোথায় বিশাল পুকুর, বাঁধানো ঘাট আর তার পাড়ে দূর থেকে দেখা ছবির মতো ছোট ছোট মাটির ঘরগুলো। এঘরে ওঘরে ত্বরিতকর্মা মেয়েদের কর্মব্যস্ততা, উঠানে উড়তে থাকা ছাপা শাড়িতে ক্লান্ত দুপুরের ঘুম।
হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের পাশে দূরে একটা ছোট্ট টিনের চালার ঘর। রুহুল আঙুল তুলে দেখায়, তুমি যাও। ওখানে দিনের বেলা কেউ দেখলে রক্ষে আছে! আমি যাবো না। আমি রুহুলকে জোর করি না। রাতে দেখলে বুঝি রক্ষে হয়? প্রশ্নটা মুখে এলেও ফেলতে না পারা অসহায় থুথুর মতো গিলে নেই।
ভেতরে ঢুকে উঠানে বেতের মোড়ায় বসা যে নারীকে দেখি বুঝতে পারি তিনিই সেই। যার খোঁজে আমি এখানে এসেছি। আমি কোনকিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি মাথা না ঘুরিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কে? আমি অবাক হই না। বুঝতে পারি, নিশ্চয়ই তিনি চোখে দেখতে পান না। তীব্র ঘানেন্দ্রিয়ে তাঁরা মানুষ দেখেন। আমি জানাই তাঁকে, তাঁর সাথে কিছু কথা আছে আমার। তিনি অবাক হন, আমার লগে কী কথা? আমার লগে কারো আবার কোনো কথা আছে নাকি? বলতে বলতে পাশের মোড়াটিও না দেখেই একহাতে টেনে বসতে দেন। আমি তাঁকে বিষয়টি সংক্ষেপে বলি। তিনি দীর্ঘদিনের অবদমিত ক্ষোভ লুকানোর কোনো চেষ্টাই করেন না। অ ধর্ষণ বাড়ছে? ত আম্রা কিত্তাম? প্রসঙ্গের আশেপাশেও তিনি হাঁটেন না। যেনো মুখস্থের মতো বলেন, ব্যাটা মাইনষের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র রাখার লাইগ্যা না পুলিশ আইয়া বাইরাইয়া উডাইয়া দিলো সেইবার। আম্রা ক্যামনে খামু কেউ ভাবলো? প্রশ্নটা এতোই বহুল চর্চিত যে উত্তরটা আমরা কেউ যেমন জানি না, উত্তরটা খোঁজারও প্রয়োজন বোধ করি না। ওই এখন পেট চালায়, ওরে জিগান, যদি কিছু কইবার পারে, আমি পারুম না। পেডের চিন্তায় বাঁচি না, আর এইসব আজাইরা প্যাঁচাল! ওই, মাইয়াডারে কিছু খাইতে দে, অদৃশ্য কারো ঊদ্দেশ্যে আদেশ দিয়ে তিনি নির্বিকার মনোযোগে সুপারি কাটতে থাকেন, বসে বসে যা করছিলেন। মিনিট কয়েকের মধ্যে আমার সামনে যে মেয়েটি চায়ের কাপ আর কেক নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ায় আমি তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি, যেনো আয়নায় নিজেকে দেখি। ছাপা শাড়ি থেকে সূর্যমুখীর আলো ঠিকরে চোখ মুখ যেনো ঝলসে দেয় আমার। কানে আবার দ্রিম দ্রিম করে শব্দগুচ্ছ, ওই এখন পেট চালায়...। আমার আত্মমর্যাদার, স্মার্টনেসের, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ঝাঁঝ যেনো মিইয়ে যায় তার দৃপ্ত দৃষ্টিতে।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক খেয়ে মাটিতে রাখি। আমার খেতে ইচ্ছে করে না। হেঁটে বের হয়ে আসতে আসতে মনে হয় আমার পেছনে পেছনে কেউ আসছে।