রোকেয়া তসলিমা

লেখক, এক্টিভিস্ট।

রক্ষক যখন ভক্ষক

ধর্ষণ' ছোট এই শব্দটির অর্থ এতই বড় যে সারা জীবনেও ব্যাখ্যা করে শেষ করা যাবে না। পত্র-পত্রিকা, সোস্যাল নেটওয়ার্কিং এর কল্যাণে শুধু চোখ বোলালেই শত শত ধর্ষণের খবর দেখি, কিন্তু ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে আহামরি কোনো শাস্তি দিতে দেখি না। গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে বের হয়ে আসে। এপাড় ওপাড় দুই বাংলা যেন ধর্ষনের রেইস করছে। 

আমি, একজন ধর্ষণকারী এবং একজন খুনীর মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। একজন খুনীর যদি সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হতে পারে, তবে একজন ধর্ষকের কেনো নয়? 
ভোগবাদী সমাজে নারীমুক্তির স্লোগানের আড়ালে নারীরা চিরকালই ভোগের পণ্য? যে দেশে নারী সরকার, যে দেশে নারী বিরোদী দলীয় নেত্রী, যে দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী নারী, আছেন নারী সংসদ সদস্য, সে দেশে কেনো এত নারী ধর্ষণ? 
নারী নির্যাতন? কেনো? কেনো? কেনো?

এখন আসুন ভাষণ ছেড়ে ভাষণের কারণটা বলি শোনেন- 
বিলাইছড়িতে ২১ জানুয়ারি রাতে দুই মারমা সহোদরা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন৷ এঁদের একজন ১৮ বছরের তরুণী, যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ আর তাঁর ১৪ বছরের কিশোরী বোন হয়েছেন যৌন নির্যাতনের শিকার৷ সেনাবাহিনীর সার্চিং অপারেশন চলাকালে এই ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ৷ এই মুহূর্তে এঁরা দু'জন রাঙামাটি সদর হাসাপাতালে আছেন৷ হাসপাতাল ছাড়তে চাইলেও তাঁদের সেখানে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও জানা গেছে৷ হাসপাতালে তাঁদের দেখতে যাওয়া মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বঞ্চিতা চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাদের একজন ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ অথচ এখনো কোনো মামলা হয় নি৷ তারা ভয়ের মধ্যে আছেন৷ জেলা প্রশাসক একটা প্রতিবেদন দেবেন৷ ঐ প্রতিবেদনের পরে আমরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব৷’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘দুই বোনের মধ্যে একজন বাংলায় কথা বলতে পারে না, চাকমা ভাষাও পারে না৷ ছোট বোন কিছুটা বাংলা বলতে পারে৷ সে জানিয়েছে যে, আর্মিরা ছিলো ওখানে৷ আর্মি করেছে বলে জানিয়েছে সে৷

স্পষ্ট নয় কি? রক্ষকের দায় নিয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে পাহাড়ে তথাকথিত শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা কাজে নিয়োজিত বিডি সেনাবাহিনী। স্বাধীনতার পর থেকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী অঘোষিত সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি রেখে নিপীড়ন-নির্যাতন, অন্যায় ধরপাকড়, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি সংঘটিত করছে। এবার এমন সময়ে ঘটনাটি ঘটলো যখন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের নানান আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার। 

আপসোসের ব্যাপার হলো- এতকিছুর মধ্যেও যথেষ্ট আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না জুম্মরা।

অথচ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরস্পর বিরোধী কথাগুলো শুনলে, পদক্ষেপগুলো পরখ করলে স্পষ্ঠত বোঝা যায় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে কতটা স্টান্ডবাজি করে চলেছে জুম্মদের সাথে সরকার। তবুও লাগামহীনভাবে সেসবকে ওভারলুক করে চলেছেন জুম্মদের মাথায় বসে থাকা সুবিধাভোগী জুম্ম নেতা এবং বুদ্ধিজীবিরা। তাতে করে দিনের পর দিন দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে জুম্মদের একাংশ। সরকারের আশ্বাস ও সুবিধার মোহে আশ্রিত এবং সরকারের ঘৃণা ও পীড়নে ধিকৃত শ্রেণিদ্বয়ের জুম্মরা পরস্পর বিরুদ্ধ অবস্থানে থাকায় বছরের পর বছর ধরে সমাজ ও রাজনীতিতে জিইয়ে থাকছে অপ্রয়োজনীয় রক্তক্ষয়ী সংঘাত। তাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মুক্তির রাজনীতি।

লক্ষণীয় যে, অতীতের মতন এবারেও মারমা নারী ধর্ষণের ঘটনায় মারমা সংগঠনগুলো অতিশয় নিরব। উভয় জেএসএসসহ অন্যান্য জুম্ম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো উদাসীন। জানি না, এসবে তারা মজা পায় কিনা! খুন, ধর্ষণ এত বড় ঘটনা ঘটছে তবুও গায়ে লাগে নি যেন তাদের। আসলে সুবিধার চাদরে মোড়ানো থাকতে থাকতে আজকাল তাদের আর এসবে গায়ে জ্বালাপোড়া ধরে না। খুন হলেও চুপ, গ্রাম পুড়ে গেলেও চুপ, সবকিছু হারিয়ে যেতে বসলেও সয়ে যাবার যে চামড়াবান্যে মনন চেতনাবোধ তা বহুবছর ধরে দেখছি উভয় জেএসএসসহ তথাকথিত জুম্ম বুদ্ধিজীবি সুশীলের মধ্যেও। এতো ভয়ানক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারবার। তাহলে কি তারা জুম্ম অধিকার কল্যাণের কথা বলে প্রকৃত অর্থে শাসকের তল্পিবহন করে চলছে? যদি নাইবা হবে তো তারা কিসের কল্যাণ করছে? কার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করছে? অধিকারকামী প্রত্যেক জুম্মের উচিত এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খোঁজা। নতুবা খুঁজে পাওয়া যাবে না মুক্তির পথ।

এমন ঘটনার বিচারের দাবীতে আমরা যতই চিল্লাপাল্লা করি না কেনো তার কিছুই আমরা পাব না বলে মনে করি। কারণ পাহাড়ে শান্তি শৃঙ্খলা সুরক্ষার নামে এসব অপকর্ম করবার এখতিয়ার তো সরকার সেনাবাহিনীকে দিয়ে রেখেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই ১১ দফা নির্দেশনা জারির মধ্য দিয়ে। এই ১১ দফা রহিত হলে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর ধরপাকড়, অত্যাচার, নির্যাতন, খুন, গুম, গ্রেফতার, ধর্ষণের আইনগত সুযোগ থাকে কোথায়? তাই লড়াইকারীদের উচিত এই ধরণের ধর্ষণ, খুনের ঘটনাগুলোকে সামনে এনে এই রকমের মানবতাবিরোধী নির্দেশনা প্রত্যাহারে জোর আন্দোলন গড়ে তোলা।

সরকার পাহাড়ে সেনাবাহিনীকে এই ধরণের মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠনের একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের যে গেম খেলছে তা বুঝে উঠতে না পারলে একতরফা গোল হতেই থাকবে। এসব বুঝতে হবে জেএসএসসহ অন্যদের। সেই সাথে মাথায় রাখতে হবে আমরা সকলে বাঙালি। যতদিন আমরা সাম্প্রদায়িক হয়ে ভাগাভাগি করে নিবো নিজেদের ততদিন এমন নেক্কারজনক কাজ বন্ধ হবার নয়। সকলের প্রতি আহ্বান করছি সাম্প্রদায়িকতা ভুলে সকলে বাঙালি বলে গর্জন তুলে এই মানবতা বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলুন।

মারমা মেয়ে ধর্ষণের ঘটনার নিন্দা এবং দোষীদের শাস্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।

"অসাম্প্রদায়িকতা জিন্দাবাদ
সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক
মানবতা মুক্তিপাক"

1954 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।