মোনাজ হক

সম্পাদক আজকের বাংলা ডট কম

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমারের যুদ্ধ প্রস্তুতি, বাংলাদেশ কি ঘুমিয়ে আছে?

বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যাদি নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলো যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বিশেষ করে মায়ানমার কি স্ট্রেটেজিক কৌশলে দেশ শাসন করছে তার পুরো খবর রাখে না, অন্ততপক্ষে জনগনকে তা জানানো হয় নি। তা না হলে আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার পরে বাংলাদেশী জনগণ তখনো জানতেই পারলো না তার অন্তর্নিহিত কারন কি ছিলো।

অথচ গতবছর এপ্রিল মাসে, মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিংঅং হ্যালিং অস্ট্রিয়ায় একটি সংক্ষিপ্ত সফর শেষে জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ সফর করেন। তার সফর, জার্মান প্রতিপক্ষের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হয়, বার্লিনের পাশাপাশি ইউরোপের অন্যান্য দেশকে ও মায়ানমার জেনেরেল গুরুত্ব আরোপ করে বর্ণনা করে যে, মায়ানমারের উন্নয়নে এবং সামরিক ও অসামরিক বন্ধনের অগ্রগতির ভবিষ্যত সম্ভাবনাগুলি আরও সহজে অনুসরণ করে তারা। বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা থাকলেও মিংঅং হ্যালিং এর ইউরোপ সফর একটু আশ্চর্য বটে।

ইউরোপীয় দেশগুলি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ইউরোপীয় রাষ্ট্রই কেবল মায়ানমারের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অর্থনীতির মতো মানবাধিকারের পাশাপাশি শান্তি প্রচেষ্টা সমর্থন করে এবং মানবাধিকারের চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান সম্পর্কে সহায়তা করার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসে। এছাড়াও ইউরোপ যখন রাখাইন রাজ্যের সমস্যাগ্রস্থ পরিস্থিতি সমুহ সমাধানের প্রক্রিয়া সমুহ শুধু মনোযোগ সহকারে শোনাই নয়, বরং সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলো, তখন বাংলাদেশ সরকার কি ঘুমিয়ে ছিলো?

জেনেরেল মিন অং হ্লাইংয়ের কৌশল ছিলো, মায়ানমারের গণতন্ত্রকরণ অনুষ্ঠানের শুরুর পর থেকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুন:প্রতিষ্টিত হয়েছে বলে প্রোপাগান্ডা এবং বিরোধীদলীয় নেতার দ্বারা রাজ্য কাউন্সিলর অং সান সু কি কে আংশিক ক্ষমতায় বসানো হয়েছে বলে। পশ্চিমা দেশগুলোর সহানুভূতির জন্যই জেনেরেল এর এই ইউরোপ সফর ছিলো। তাই মায়ানমার এর প্রতি অর্থনৈতিক ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার দাবি করলো মায়ানমার এর এই কৌসুলি জেনারেল। এব্যপারে বাঙালিরা গতবছর ফেব্রুয়ারি তে বাংলাদেশের সরকারী কোনো মন্তব্য শোনে নি।

মিয়ানমারের সাথে বিশেষভাবে জার্মানির দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলির মধ্যে একটি সামরিক অস্ত্র বিক্রি। গত কয়েক বছরে মায়ানমারের সাথে ইউরোপের এই অস্ত্র ব্যবসার সম্পর্কটি উষ্ণ হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরো সম্ভব্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। ঠিক তারপরেই মায়ানমার জেনারেল মিংঅং হ্যালিং ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফিরে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে উচ্ছেদে লিপ্ত হয়।

মায়ানমার বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৫ গুন বড়, জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ মিলিয়ন অর্থাৎ বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ, এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চল জনবসতি শুন্য, কিন্তু রাখাইন রাজ্য খনিজসম্পদে ভরা। গত দশ বছরের আংশিক গণতান্ত্রিক উন্নতির সাথে সাথে সারা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি ও এসেছে। ইউরোপের ভারী শিল্প, অটোমোবাইল, জাপানের ইলেক্ট্রনিকস, চিনের অবকাঠামো ও রাস্তা নির্মাণ এবং ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি (যেমন ভারতের Jubilant Oil & Gas, OV Ltd, Essar Energy, Tata, Airtel) তাদের কাজ শুরু করেছে। আর মার্কিনমুলুকের সমরাস্ত্র সজ্জিত মায়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে ৫ গুন শক্তিশালী। প্রতিরক্ষা ব্যয় বাংলাদেশে ১ বিলিয়ন ডলার, মায়ানমার ৮ বিলিয়ন ডলার। এখনো যারা বিশ্বাস করে মায়ানমার রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে আবার ফিরিয়ে নেবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। হাস্যকর যে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতমাসে প্রায় ১০ লক্ষ শরণার্থীর মধ্যে থেকে ৮ হাজার শরণার্থীর লিস্টি বানায়ে ফুলের তোড়ার শুভেচ্ছা জানায় মায়ানমার এর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে।

আওয়ামীলীগ সরকার এখন ভোটের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, তা বোঝা যায়, "উন্নয়নের জোয়ার" জনসভায় প্রচার করা হচ্ছে পক্ষান্তরে বিরোধী দলকে দমনের সমস্ত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এখন শুধু সেলিব্রেশন নিয়ে ব্যস্ত, এই সুযোগে মায়ানমার সৈন্য মোতায়েন করেছে বর্ডার এলাকায়। জার্মান সংবাদ সংস্থা ডিপিএ বলছে ৮ হাজার সৈন্য বহর নিয়ে মায়ানমার বর্ডার এলাকায় কুচকাওয়াজ করছে।

এবছর ২ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি মায়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের প্রথম ত্রি-মুখি অনুশীলন চালায়। মায়ানমার বলছে এই ড্রিলস তারা তাদের সামরিক শক্তির আধুনিকায়নের অগ্রগতির জন্য সেনাবাহিনীর দৃঢ়সংকল্পকে শক্তিশালী করে এবং তার আচরণের উপর ক্রমাগত আন্তর্জাতিক পারদর্শী করণ এর মধ্যে তা শক্তিশালী করে।

'দ্যা ডিপ্লোম্যাট' পত্রিকা লিখেছে মায়ানমারের সেনা বাহিনী Tatmadaw নামে পরিচিত, যার সংখ্যা ৪ লক্ষ (বাংলাদেশের ১ লক্ষ ৩০ হাজার) এবং তারা টেকনিক্যালি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনীগুলির মধ্যে অন্যতম, তার ক্ষমতায় প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে অনেকটা পিছনে রয়েছে। মায়ানমারের সামরিক প্রধান মিংঅং হ্যালিং সম্প্রতি 'দ্যা ডিপ্লোম্যাট' পত্রিকায় বলেন, তারা একটি "আদর্শ বাহিনী" হিসাবে নিজেদের প্রশিক্ষণ অর্জন করেছেন যা নতুন অস্ত্র জ্ঞান অর্জন ও বৈদেশিক জঙ্গীদের দমন এর জন্য আদর্শিক সৈন্য বাহিনী গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপের সাথে সামরিক প্রতিষ্ঠানটিকে আরো উন্নত ও আধুনিকায়ন করতে চায।

পত্রিকাটি আরো বলে, জেনেরেল মিংঅং হ্যালিং হয়তো এবার নিজেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর করে গনতান্ত্রিক ভাবে ভোটে নির্বাচন করে, মায়ানমার এর প্রেসিডেন্ট হবেন।

এই পরিস্থিতি তে বাংলাদেশ কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে, তার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গত ৭২ তম জাতিসংঘের সাধারণ সভায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর সমস্যা সমাধানে একটি ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করেন, তারপর প্রায় ৫ মাস পেরিয়ে যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে কোনো দেশ কি সাড়া দিয়েছে? অথবা বাংলাদেশ কি কোনো উদ্যোগ হাতে নিয়েছে? শরণার্থী দের খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থান নির্মানে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দাতা সংস্থা এগিয়ে এসেছে, প্রচুর ত্রাণসামগ্রী এসেছে এবং আসছে, এটা দাতা সংস্থা সমুহের মানবিক কর্মসূচি, আওয়ামীলীগ প্রধানমন্ত্রীকে 'মানবতার মা' বলে আখ্যা দিয়েছে ভালোকথা, কিন্তু শরণার্থী সমস্যার পরবর্তী ধাপ কিভাবে সমাধান হবে তার কোনো পরিকল্পনা আছে কি? তা না থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেল এর সাথে কথা বলা উচিৎ, কারণ দু'বছর আগে উনি প্রায় দুই মিলিয়োন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত শরণার্থীর সমাধান করেছেন। যদিওবা সম্প্রতি নির্বাচনে তাঁর ভোট প্রাপ্তি প্রায় ৮% কমেছ, যার ফলে তিনি এখনো নতুন সরকার গঠন করতে পারেন নি, কিন্তু তাই বলে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার কোনো প্রগ্রাম তাঁর ছিলো না, কারণ গণতন্ত্র তখনি মজবুত হয় যখন রাজনীতিতে প্লুরালিজম কার্যকর হয়।

একথা এখন দিবালোকের মতো সত্য যে রোহিঙ্গা দেরকে এখন বাংলাদেশকেই পালতে হবে, তাই আমার পরামর্শ, তাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্ম ক্ষেত্রে ঢুকাতে হবে, সারাজীবন ক্যাম্পে বসিয়ে খাওয়ালে জঙ্গিবাদ বাড়বে। শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের বন্ধুকে, এখনো তা স্পষ্ট হয় নি, অন্যদিকে মায়ানমার এর সাথে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বন্ধুরাষ্ট্ররা হলো চিনা, জাপান, ভারত, রাশিয়া এবং পশ্চিমা বহুদেশ।

1625 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।