আহমেদ সায়েম

লেখক একজন সমাজ সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট। এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখেন যেখানে নারী পুরুষের কোন বৈষম্য থাকবে না।

রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন বেশ স্ববিরোধী

ভারতবর্ষের আধুনিকতার অন্যতম প্রধান পথিকৃত ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতীও  ছিলেন, কিন্তু  বাস্তবে নিজের পরিবারে তা প্রয়োগ করতে সমর্থ হন নি। একই পরিবারে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন বেশ স্ববিরোধী, তাঁর লেখায়, চিন্তায়, চেতনায়।


তবে দেবেন্দ্রননাথ ঠাকুর স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে অবরোধমোচনের ঘোর বিরোধী  ছিলেন। কিন্তু ঠাকুর পরিবারে, সে সময় সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অনেকটা নারীমুক্তিকামী। এখন যে বাঙালি নারীরা যে ভঙ্গিতে শাড়ি পরেন, এই সত্যেন্দ্রনাথই তা প্রবর্তন করেন। কি করে, সে কথায় পড়ে আসছি।

বাঙালি সমাজে কোনো নমুনা না থাকা সত্ত্বেও, তরুণ  বয়সেই সত্যেন্দ্রনাথ নারীমুক্তির প্রেরণা লাভ করেছিলেন। কোথা থেকে তিনি এই ধারণা ও আদর্শ  পেয়েছিলেন, তা জানা যায় না। তবে সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া জন্য ১৮৬২ সালে বিলেতে যাওয়ার আগে থেকেই তিনি সমস্ত  প্রকার বিশ্বাস  হারাতে আরম্ভ করেন।

তাই তিনি সেকালে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে কেবল দুঃসাহসী নয়, পাগলামো  বলে মনে হতে পারে। যেমন- তাঁর বালিকা স্ত্রী  জ্ঞানদানন্দিনী লজ্জায় একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেও, একবার রাতের বেলায় সবার অজ্ঞাতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, বন্ধু মনমোহন ঘোষের সঙ্গে।

দেশীয়দের মধ্যে প্রথম সিভিল সার্ভেন্ট হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন ১৮৬৪ সালের অক্টোবর মাসে। দেশে এসেই অভিজাতদের মধ্যে এ যাবত যা কেউ করতে পারেন নি। "নারীমুক্তির তেমন কয়েকটি সাহসী পদক্ষেপ  গ্রহণ করেন তিনি।

প্রথমটি হচ্ছে, কিশোরী  স্ত্রীকে তিনি আপন কর্মস্থান আহমেদাবাদে নিয়ে যান।" আজকের দিনে এটা শুনতে সহজ ও স্বাভাবিক  মনে হলেও সেকালে তা মোটেও সহজ ছিল না কারণ, তখনকার মূলবোধ ও রীতি অনুসারে স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়িতে রাখাই নিয়ম ছিলো।

পোশাকের সমস্যা দূর করা যদি বা সম্ভব  হয়, স্ত্রীকে পৈতৃক ভবনে রেখে যাওয়ার সেকেলে রীতি ভঙ্গ করা সহজ ছিলো না। জ্ঞানদা দেবীকে আহমেদাবাদে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরিবারের করো সমর্থন ছিলো না।
দেবেন্দ্রনাথের তো নয়ই। কিন্তু তিনি প্রথা ভেঙেছিলেন। বেশ কিছু জায়গায় সমূলে শিঁকড় সমেত উপড়ে ফেলেছিলেন।

কিন্তু জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে জ্ঞানদা কি করে জাহাজে যাবেন, তাও সমস্যা  সৃষ্টি করেছিলো। কারণ সত্যেন্দ্রনাথ তাকে ঘোড়া গাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেকেলে মেয়েদের ঘোড়ার গাড়িতে চড়া একেবারে বারণ ছিলো।

কর্মস্থানে তাঁকে নিয়ে য়াওয়ার  ব্যাপারে আরেকটা  বড় বাধা ছিল পোশাক। এটা শুনে এখন অবাক হওয়ারই কথা।কিন্তু  তখন মেয়েদের পোশাক বলতে বোঝাতো শুধু একটা শাড়ি।

সেই মিহি শাড়িসর্বস্ব পোশাক পরে বাহিরের লোকের সামনে যাওয়া দূরের কথা, বাড়ির ভেতর কোনো পুরুষের সামনে যাওয়াও চলতো না।
শীতের দিনে শাড়ির উপর মেয়েরা পরতেন একটা চাদর।
বাঙালি নারীদের মধ্যে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরা তখনো চালু হয়নি। জুতা ও মুজা পরার রীতিও তখনো চালু হয় নি। 
রবীন্দ্রনাথ নিজেই ১৯৩৬ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে মেয়েদের এই পোশাক পরার সেকেলে সংস্কারের কথায় বলেছেন যে, "সেই এক বস্ত্রের দিনে সেমিজ পরাটাও নির্লজ্জতার লক্ষণ ছিলো। এমনকি মেয়েদের ছাতা ব্যবহারও লজ্জর কারণ ছিলো।"

তাই স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁর জন্য সত্যেন্দ্রনাথকে বাহিরে যাওয়ার উপযোগী একটা পোশাক উদ্ভাবন করতে হয়েছিলো।
এতে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কলকাতার এক ফরাসি দর্জি। তিনি জ্ঞানদা দেবীর পোশাক বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে পোশাক এতোই জটিল ছিলো যে, তা পরার জন্য সত্যেন্দ্রনাথ প্রতিবার সাহায্য করতেন। পরে 
বোম্বাই গিয়ে জ্ঞানদা যে অভিজাত পরিবারে ছিলেন, তাদের নারীদের শাড়ি পরার ভঙ্গি দেখে তাকে বাঙালিদের উপযোগী করে নিয়েছিলেন।

পশ্চিম ভারতে শাড়ি পরার সময় আঁচলটা থাকে ডান কাঁধের উপর। সেটা পাল্টে, অর্থাৎ আঁচলটা ডান দিকে রেখেই, আর সেই সঙ্গে ব্লাউজ ও পেটিকোট পরে তিনি একটা নতুন পোষাক উদ্ভাবন করেন বাঙালি নারীর জন্য। বর্তমানে বাঙালি নারীরা যে ভঙ্গিতে শাড়ি পরেন, তা তিনিই প্রবর্তন করেন।

এখানেই শেষ নয়, প্রবল সমাজিক নিষেধ অমান্য করে সত্যেন্দ্রনাথ এরপর জ্ঞানদা দেবীকে একাকী গভর্নর জেনারেলের ভোজসভায় পাঠিয়েছিলেন। সেই পোশাকেই।

সে সময় তাঁর বহু কাজই সমালোচনা-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো।
তারপরও সর্বপ্রকার রীতি-নীতি ভেঙ্গেই তিনি নারীমুক্তিকামী হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন।

এ ধারার নারীমুক্তিকামীর কাতারে বহু পুরুষই আছেন। তথাপি এ যুগেও পরুষরা সর্বপ্রকার নারীবাদী আন্দোলনের সহযোগী হয়েও সর্বত পুরুষ সর্বাংশে নারীবান্ধব কেনো নয়? এ প্রশ্নটি কি অবান্তর নয়? বাদকে ভাগ করে বিভাজন চলে, অভিন্ন পথে হাঁটা কি সম্ভব?

আহমেদ সায়েম

 

 

2818 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।