বিগত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চাকরিপ্রার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, তার যৌক্তিকতা মানতে সরকার বাধ্য হয়েছে। সরকার একমাস সময় চেয়েছে কোটা সংস্কার বিষয়ে যাচাই বাছাই করার। এটা আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক বিজয়। কিন্তু এই আন্দোলন থেকে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে সবাইকে ভাবতে শেখায় সেটি একটা জাতির জন্য বড়ই কলংকের।১. একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পর যেখানে প্রয়োজন ছিলেঅ রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও পাকিপন্থীদের তালিকা করা, সেখানে তখনকার প্রশাসন তালিকা করেছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের। অথচ পাকিস্তানের সহায়ক শক্তি ছাড়া দেশের আপামর সকল জনগণ কোনো না কোনো ভাবেই মুক্তিযোদ্ধা। গোড়ার সেই গলদের কারণে এখনো সরকার বদলের সাথে সাথে দেশে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয়। অথচ প্রয়োজন ছিলো রাজাকারদের একটা পাকাপাকি তালিকা। আমরা সেই ভুল পদ্ধতি নিয়ে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও একুশ শতকের বাংলাদেশে দৌড়ঝাঁপ করছি।
২. ৪৭ বছরেও দেশে একটি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা কোনো কাজে লাগছে না। শিক্ষার্থীদের নির্ভর করতে হচ্ছে গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের উপর। কোনো সরকার এই ব্যবস্থা পাল্টানোর তাগিদ অনুভব করে নি।
৩. শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীকে যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ যে কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রধান কাজ ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করা। এখানে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন সরকারের ইচ্ছায় ওঠাবসা করে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন থেকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিয়োগের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, এটা একটা দেশের জন্য মোটেও শুভ নয়। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন এসব ছাত্রসংগঠনের শিক্ষার্থীরা দলীয় ফাই-ফারমায়েস খাটছে। বিশেষ সুবিধায় সরকারি চাকরি নিয়ে তারাই আবার শিক্ষার্থীদের সামনে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছে। আজকে পুলিশের যে ভাষায় চোখ রাঙানি চোখে পড়লো, এটা এই সংস্কৃতির ধারাবাহিক প্রতিফলন।
৪. মিডিয়া যখন সরকারের দাসে পরিণত হয়, তখন তাকে আর মিডিয়া বলা যায় না। সরকার থেকে মিডিয়া সিন্ডিকেটের নেতারা যে ভাগভাটোয়ারা পায়, তা নিয়েই তারা এই চামচামি করে। যার ফলে মিডিয়ার একটা জাতি গঠনে যে ভূমিকায় থাকার কথা, মিডিয়া আজ সেই ভূমিকায় নেই। তারা স্রেফ সরকারের দালালে পরিণত হয়েছে।
৫. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেশে সরকারদলীয় চামচায় পরিণত করা হয়েছে। সরকার বদলের সাথে সাথে তাই সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ভোল পাল্টে সেই সুরে কথা বলেন। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হতে পারছেন না। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় থাকাকালীন যাদের নিজ দলের সমর্থকদের মনে করছে, তারাই কেবল দেশের জনগণ, বাকিরা তাদের সমর্থন না করলে তারা তাদের কাছে শত্রু হিসাবে গণ্য হচ্ছে।
দেশের জনগণকে সুস্পষ্টভাবে এভাবে ভাগ করা কোনো শাসক দলের জন্য মোটেও সমীচীন নয়। আর তা মোটেও গ্রহণযোগ্যও নয়। ন্যায্যতার প্রশ্নে দেশের যে কোনো নাগরিক সরকারের সমালোচনা করতে পারবে না কেনো? সমালোচনা করলেই তাকে বিরোধী ট্যাগ দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। বরং সমালোচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দরভাবে দেশ পরিচালনাই কাজের কথা।
৬. স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিতর্ক করাটা দেশের জন্য মোটেও শুভকর নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে জাতির জনক হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া পবিত্র দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু যে কোনো দলীয় বিশেষ মর্যাদার উর্ধ্বে। এই সত্য যতদিন একটা জাতির মধ্যে তৈরি করা সম্ভব না হবে, বুঝতে হবে আমাদের সিস্টেমে এখনো গলদ রয়ে গেছে। সেই গলদ সংশোধন করাটা সময়ের দাবি।
৭. 'জয় বাংলা' কোনো দলীয় শ্লোগান নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক 'জয় বাংলা' শ্লোগান দিতে অধিকার রাখে। 'জয় বাংলা'কে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের আদর্শ শ্লোগান হিসাবে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হোক। এই শ্লোগান যে কোনো নাগরিক দেবার অধিকার রাখে।
৮. ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধকে যেদিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপব্যবহার করা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই এটি স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই দুটি বিষয়কে রাজনীতিতে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো উদার ও সচেতন হতে হবে। রাজনীতিতে এই দুটি'র অপব্যবহার বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি।
৯. বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ বেকার যুবক কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছে, তাদের কর্মসংস্থান করার জন্য সরকারকে নতুন পলিসি ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। কেবলমাত্র কোটা পদ্ধতির সংস্কার দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। সবাইকে সরকারি চাকরি করতে হবে কেনো? সমাজ থেকে এই সরকারি চাকরির মোহকে যতক্ষণ দূর করা না যাবে, ততক্ষণ এই সমস্যা কোটা পদ্ধতি সংস্কার করেও কোনো ফল বয়ে আনবে না।
১০. বেসরকারি উদ্যোগের প্রতি সরকারকে আরো মনোযোগী হতে হবে। কেবল সরকারি চাকুরীজীবীদের বেতন বাড়ানো একটা দেশে বৈষম্য সৃষ্টি করার একটা নতুন লক্ষণ। নির্বাচনী বছরে সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থ থাকলেও তা শেষ বিচারে দেশের ক্ষতি করছে। কারণ সরকারি চাকরিজীবীরা তখন আর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে বিহ্যাব করছেন না। তারাও সরকারি দলের ক্ষমতার অপব্যহারে উৎসাহিত হচ্ছেন।
১১. যে কোনো বিষয়ে যৌক্তিক দাবি'র জন্য আন্দোলন সংগ্রাম একটা সুনির্দিষ্ট সময় মেনেই চলা উচিত। শাহবাগ এখন আন্দোলনের জন্য একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। জনজীবনে দুর্ভোগ দিয়ে দাবি আদায় এখন আর কোনো যৌক্তিক পন্থা হতে পারে না। বরং আলোচনার টেবিলে গিয়ে এর সমাধান বের করাটাই এখন অনেক বেশি যৌক্তিক উপায়।
মোদ্দাকথা, একটা জাতিকে শিক্ষায় যতক্ষণ আপনারা দাবিয়ে রাখবেন, ততক্ষণ নানান কিসিমের রাজনৈতিক মুলা ঝুলিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে পারবেন। এই রাজনীতি একটা দেশের জন্য শেষ বিচারে কোনো উন্নয়ন বয়ে আনে না। বরং তা কেবল একটা জাতিকে পেছনের দিকেই টানতে থাকে। দেশের সত্যিকার উন্নয়ন যদি চান, বছরে একটা একটা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করুন, তাও এক ধাপ হলেও দেশ এগিয়ে যাবে। জোড়াতালির আগানোর চেয়ে ধীরে হলেও সেই আগানো অনেক বেশি টেকসই আর সেটিই কাম্য হওয়া উচিত।