আলতো করে তপ্ত মাটিতে এক পা রাখেন তিনি। তারপর দ্বিতীয় পা-টাকে বাড়িয়ে দেন তেমনই সাবধানে। তিনি পা রাখলে মাটি ব্যথা পাবে, এমনই যেন ভাব তাঁর হাটার মধ্যে। খুব ধীরে ধীরে মাটিকে ব্যথা না দিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন তিনি।
যারা তাঁকে চেনে, তারা জানে, কেনো তিনি এভাবে হাঁটেন। যারা জানে না, তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধা এই মহিলাটির দিকে। গায়ে সাদা রঙের শাড়ি, মাথাভর্তি শাদা চুল, মুখে বলিরেখার দাগ স্পষ্ট, চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে একগাদা বই। ভিক্ষুক তিনি নন, অথচ পা খালি। আবার সেই খালি পায়েও হাঁটছেন অত্যন্ত সাবধানে। নিজের পা-কে বাঁচাতে নয়, যেন জীবন্ত কোনো কিছুর উপর পা ফেলছেন তিনি, এমনই সাবধানতার সাথে অতি মোলায়েমভাবে পা ফেলে হেঁটে চলেন তিনি। পাশ থেকে কৌতূহলী কেউ হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে বসে,
“এমন করে হাঁটছেন কেনো খালাম্মা? পায়ে কোনো সমস্যা? আপনার জুতো কোথায়?”
প্রশ্নকর্তার দিকে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। দৃষ্টি স্থির করে দেখেন তাঁকে। তারপর যেমন মোলায়েম করে হাঁটেন তিনি, ঠিক সেরকম নরম গলায় বলেন,
“আমার তিন ছেলে মাটির নীচে শুয়ে আছে বাবা। আমি মা হয়ে জুতো পায়ে হাটি কী করে? আমার বাছারা কষ্ট পাবে না?”
২.
যাঁর কথা বললাম, তিনি গল্প উপন্যাসের কোনো চরিত্র নন, আমাদেরই খুব চেনা একজন। তাঁর নাম রমা চৌধুরী। একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে লক্ষ লক্ষ নারীদের মতো তিনিও ধর্ষিতা হয়েছিলেন বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে। শুধু ধর্ষিতা হয়েই শেষ হয়নি তাঁর উপরে নেমে আসা পৈশাচিকতার। এর মাশুল আরো বিশাল পরিমাণে তাঁকে চোকাতে হয়েছে পরবর্তীতে। পুরো জীবনটাই ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে তাঁর, হয়ে গিয়েছে লণ্ডভণ্ড এবং তছনছ। অন্তহীন এক অন্ধকার নেমে এসেছে তাঁর জীবনে।
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন রমা চৌধুরী। এর পর স্কুল শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। একাত্তুর সালে যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর স্বামী ভারতে চলে যান। তিনি দুই সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন তাঁর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে।
গ্রামে গিয়েও বিপদ কাটে না। মে মাসের এগারো তারিখে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ চালায় এই গ্রামে। গ্রামের অসংখ্য নারীদের সাথে সাথে রমা চৌধুরীও ধর্ষণের শিকার হন। আর এই ঘটনা ঘটে তাঁর দুই শিশুপুত্রের চোখের সামনেই। ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে জান বাঁচাতে বাচ্চাদের নিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন তিনি। প্রাণে বাঁচলেও বাড়িটা বাঁচে না তাঁর। গান পাউডার দিয়ে সেটাকে পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় দালালেরা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী চলে যাবার পরে শুরু হলো আরেক লাঞ্ছনার ইতিহাস। যারাই তাদের দেখতে আসছিলো সহানুভূতি জানাতে, তারাই আবার নানা জায়গায় গিয়ে অশ্রাব্য এবং অশ্লীল ভাষায় তাঁর উপরে ঘটা যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলো রসালোভাবে। এই সব সামাজিক লাঞ্ছনাকে সহ্য করেও টিকে ছিলেন তিনি শুধুমাত্র তাঁর দুই শিশুপুত্রের কথা ভেবে।। নইলে আত্মহত্যা করে চরম অপমান এবং গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করার চিন্তা বহুবারই তাঁর মনের মধ্যে বাসা বেধেছিলো।
যে সন্তানদের জন্য তিনি মরতে পারেননি, যাদের কথা ভেবে তিনি নিজেকে শক্ত করে টিকিয়ে রেখেছিলেন সকল বৈরিতাকে, সেই সন্তানরাই যে তাঁকে ফাঁকি দিয়ে দ্রুত চলে যাবে, সেটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আসার ঠিক আগেরদিন থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাঁর বড় সন্তান সাগরের। ডিসেম্বর মাসের বিশ তারিখে মারা যায় সাগর। সাগরকে হারিয়ে অর্ধ উন্মাদিনী হয়ে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বামী ফিরে আসে ভারত থেকে। কিন্তু তাঁর সাথে সংসার করতে অস্বীকৃতি জানায়। বড় ছেলে সাগরকে হারানোর মাত্র দুই মাস পরে উন্মাদিনী অবস্থায় ছোট ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেলেন তিনি। শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায় টগর।
হিন্দু রীতিতে শবদেহকে পোড়ানোয় বিশ্বাস ছিলো না রমা চৌধুরীর। ফলে, তাঁর দুই সন্তানকেই কবর দেওয়া হয়। জুতো পরে হাঁটলে তাঁর দুই সন্তান ব্যথা পাবে, এই বিবেচনায় জুতো পরা বন্ধ করে দেন তিনি। চার বছর এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায়। পরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের অনেক অনুরোধ এবং পীড়াপীড়িতে জুতো পরেন তিনি। কিন্তু, কে জানতো, এই জুতো পরাও বন্ধ হয়ে যাবে একদিন।
রমা চৌধুরী দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন। কিন্তু এই সংসারও সুখের হয়নি। প্রতারক স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে যান। এই সংসারে জন্মেছিলো তাঁর আরেক সন্তান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এই সন্তানকেও তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পারেন নি। ১৯৯৮ সালের ষোলই ডিসেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর দ্বিতীয় সংসারের সন্তান টুনু মারা যায়। এর পর থেকে পায়ের জুতোকে পুরোপুরি বিসর্জন দেন তিনি। খালি পায়েই চলা ফেরা করে চলেছেন সেই থেকে।
নিজের উপর এবং তাঁর পরিবারের উপর নেমে আসা এইসব চরম বিপর্যয়ের পরেও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন রমা চৌধুরী। নিত্য অভাবের সাথে লড়তে কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে নিজে উপার্জন করার পন্থাকেই বেছে নেন তিনি। এর জন্য লেখালেখিকেই পেশা হিসাবে পছন্দ করেন তিনি। নিজের লেখা বই নিজেই ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। এটাই তাঁর পেশা। চট্টগ্রাম এবং ঢাকা, এই দুই শহরে খালি পায়ে হেঁটে, কাঁধের ব্যাগে নিজের বই নিয়ে তিনি ছুটে গেছেন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে, এক অফিস থেকে আরেক অফিসে। বই বিক্রি হলে খাবার জুটেছে, বিক্রি না হলে খাবার জোটে নি। তাঁর ভাষাতেই বলি, “আমি বই বিক্রি করি। যেদিন বিক্রি করতে পারি সেদিন খাই, যেদিন পারি না, সেদিন উপোষ করি।”
মুক্তিযুদ্ধ এই নারীকে নিঃস্ব করে দিয়ে তাঁর কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে দিয়েছে। একটা বিড়ালকে সঙ্গী করে ছোট্ট এক কক্ষে এখন তাঁর জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
৩.
রমা চৌধুরী প্রচণ্ড রকমের অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। ডায়াবেটিস, ব্রংকাইটিসসহ নানা ধরনের জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। তাঁর পিত্ত থলিতে পাথরও রয়েছে। এটাই তাঁর প্রথম হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নয়। গত জুন মাসেও তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। হাসপাতালে থেকেছিলেন দীর্ঘদিন। এখন অর্থের অভাবে তাঁর চিকিৎসা সঠিকভাবে হচ্ছে না।
রমা চৌধুরী একাত্তরের বীরাঙ্গনা। তাঁর দুই সন্তান যুদ্ধে গিয়ে মারা যায় নি যদিও, কিন্তু তারাও আসলে এই যুদ্ধেরফল ভোগ করেছে। এই দেশের জন্য এই ভদ্রমহিলার জীবনটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। একটা সুখের এবং শান্তিময় জীবন কাটানোর কথা ছিলো তাঁর, তাঁর বদলে অতি নির্মম একটা জীবন পেয়েছেন তিনি। সেই জীবনে শুধু একাকীত্বের বেদনাই নেই, রয়েছে সব হারানোর তীব্র যন্ত্রণাও। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি হারিয়েছেন তাঁর সর্বস্ব। আমাদের স্বাধীনতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর অবদান। কিন্তু, এর বদলে তিনি কখনোই কিছু চান নি বাংলাদেশের কাছে। নিজের জীবিকা তিনি নিজে জোগাড় করেছেন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। আজ শেষ বয়সে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিরই সময় এসেছে রমা চৌধুরীর ঋণ শোধ দেবার।
শুধু রাষ্ট্রের একার না, এই দায় আমাদের সকলেরও।