সালমা লুনা

ফিজিক্স আর পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করেছেন। লেখালিখি করেন শখে। দায়বদ্ধতা অনুভব করেন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলায়। হোপ সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিওর প্রেসিডেন্ট তিনি।

রাজীবের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, এটি পরিষ্কার হত্যা - খুনীদের বিচার চাই!

আজকাল কিছু লিখতে ইচ্ছা করে না। লিখে কী হয় এই ভাবনাটা নিজের তো ছিলোই। পরিবারের লোকজনও বলে, কী কী সব লিখছো। ভয়ডর নাই?

পরিচিতরা বলেন, সাবধানে লিখ। কী দরকার লেখার। শুভাকাঙ্খীরা বলেন, গদ্য পদ্য লিখ। ওইটা তাও একটা কাজ। হাবিজাবি লিখে কী হবে? তোমার কথা কেউ শুনবে?

আমি হতাশায় তো ছিলামই আরো কুঁকড়ে যাই।

ছিঃ! তাইতো, আমি কে? কত জ্ঞানীগুণীজন আছেন, কত বিখ্যাত মানুষজন। কবি সাহিত্যিক পত্রপত্রিকা মিডিয়া রাজনীতি করা মানুষজন, তারা লিখলে তবু মানুষ জানবে, পড়বে, মনে নেবে। কোথাও একটু হলেও ঢেউ উঠবে।

আমার সেই ক্ষমতা কোথায়?

তবু লিখছি।

সকালে রাজীবের মৃত্যু সংবাদটা জেনে মন খারাপ হলো। লিখলাম। একটু পরেই মেসেঞ্জারে দুটো ছবি পেলাম। এক ছোটোভাই দিয়েছেন। তারও নাম রাজিব। হতভাগ্য রাজীব ছিলো উনার সহকর্মী। তারা একটি হসপিটালে কাজ করতেন। রাজীব ছিলেন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে।

ভাই রাজিব দুটি ছবি দিয়ে লিখলেন, 'আপা কিছু লিখুন। এমন পরিশ্রমী হাসিখুশি ছেলেটিকে এভাবে মেরে ফেললো সহ্য করতে পারছি না।'

হায়! আমি যে একজন পরিশ্রমী কর্মক্ষম রাজীবের গোটা জীবনের সংগ্রামী পথচলার গল্পটা লিখবো, আমার সে ক্ষমতা কোথায়!

রাজীব বাবামা হারা খুব কষ্ট করে জীবনের পথে চলতে থাকা একটি ছেলে ছিলো। সদা হাস্যমুখ। তার দুটি ভাইও আছে। তাদের নাকি খুব আশা ছিলো রাজীব একদিন বড় চাকরি করবে তারপর তাদের নিয়ে একসাথে থাকবে।

রাজীব দুর্ঘটনায় মারা যায় নি।

কেননা রাজীব বেপরোয়া রাস্তা পার হতে গিয়ে বা দৌড়ে চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে প্রাণ হারায় নি। সে ফুটপাথ ছেড়ে মধ্য রাস্তা দিয়ে মোবাইল ফোন কানে নিয়ে বা ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে হাঁটতে গিয়ে নিরুপায় বাসচালকের স্টিয়ারিং এর চক্করে পড়ে নি। অথবা নিয়তির পরিহাসে চলন্ত বাসগুলি নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে কোনো পথের পাশের চা দোকানে ঢুকে পড়ে চা পানরত রাজীবকে অনিচ্ছাকৃত মেরে ফেলে নি।

রাজীবকে খুন করা হয়েছে। রাজীব দু’টো ঠাণ্ডা মাথার খুনীর নৃশংস আনন্দের শিকার হয়েছে। সে আমাদেরই কারো ছেলে বা ভাই হতে পারতো।

এবং এই খুনীদের মদদদাতা ও পৃষ্ঠপোষক আর কেউ না, স্বয়ং রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ, যারা তাদের দ্বায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে নি। ফলে একটি অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে।

দেশে অরাজক অবস্থা চলছে বলেই রাজপথে দু’টো বাসের ড্রাইভার এমন নৃশংস আচরণ করতে পারে। তার মধ্যে একটি আবার সরকারি পরিবহণ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত।

সেই কবে মন্ত্রী বলেছিলেন 'ছাগল চিনলেই ড্রাইভার' সেসব আমরা ভুলে গেছি। সড়কে যেসব গাড়ি চলে তাদের ড্রাইভাররা কতটুকু দক্ষ তা উনারা দেখেন না, আমরাও জানার প্রয়োজন বোধ করি না।
রাজীবরা তাদের কর্মক্ষম হাত হারিয়ে বেঁচে থাকতে আদৌ চায় কীনা তা নিয়ে আমাদের ভাববার দরকার থাক বা না থাক।

আমরা কি এই রাষ্ট্রের কাছে অন্তত খুনের বিচারটা চাইতে পারি? এইসব মস্তিষ্ক বিকৃত ঠাণ্ডামাথার খুনীদের বিচার চাওয়ার অধিকারটুকুই না হয় আমরা চাইলাম হে মাননীয়রা।

আমাদের সেই ভিক্ষে চাওয়া অধিকার থেকেই আমরা রাজীবের খুনীদের বিচার চাই।

আমরা দুই বাসের কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে রাজীবের দুটি ভাইয়ের জন্য আর্থিক ক্ষতিপুরণ চাই।

ততক্ষণ আপনারা না হয় হাসিখুশি রাজীব আর আপনাদেরই পরোক্ষ কৃতকর্মে সৃষ্ট রাজীবের পরিস্থিতির চিত্র দুটি দেখতে থাকুন।

1994 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।