‘নিজেকে এমন করে হত্যা করলে কেনো তুমি?’
পুষ্পকুন্তলার চুলের মধ্যে পরম মমতায় হাত বুলাতে বুলাতে তিনি বললেন।
স্বামীর উরুর উপর মাথা রেখে শুয়ে আছেন পুষ্পকুন্তলা। তাঁর আয়ু আর বেশিক্ষণ নেই, এটা তিনি নিজেও জানেন। জানেন বলেই শেষবারের মতো স্বামীকে দেখার ইচ্ছাপোষণ করেছিলেন তিনি।
স্বামী তাঁর তখন জেলে। মরণব্যাধী টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। সবাই জানে মরতে যাচ্ছেন তিনি এই রোগে। তিনিও তা জানেন। কিন্তু, সবাই যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে তিনি টাইফয়েডে মরতে যাচ্ছেন না। তাঁর মরণ হয়েছে অনেক আগেই। স্বামী যেদিন বিনা অপরাধে তাঁকে বিসর্জন দিয়ে যায়, সেদিনই তিনি মরে গিয়েছেন। টাইফয়েড এখন শুধু অছিলা মাত্র। মরণকে তিনিই টেনে এনেছেন নিজের কাছে সর্বশক্তি দিয়ে। এ ছাড়া তাঁর অন্য কোনো উপায়ও খোলা ছিলো না। আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের নিরন্তর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহ্য করে খুব বেশিদিন এই সমাজে একটা নারী টিকে থাকতে পারে না।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করায় এক মাসের জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন তাঁর স্বামী। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গতকাল এসে পৌঁছেছেন তাঁর কাছে। তখন থেকেই মানুষটি বসে আছে তাঁর শয্যায়। সেবা যত্নে ব্যস্ত করে রেখেছে তাঁকে।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। এই ভালোবাসা, এই সেবা যত্নটা যদি তিনি আগে নিতেন, এমন স্বেচ্ছামৃত্যুকে হয়তো তিনি বেছে নিতেন না।
নিজেকে হত্যা করার প্রশ্নের উত্তরে পুষ্পকুন্তলা তাই কিছু বলেন না। স্বামীর অন্য হাতের আঙ্গুলগুলোকে ছুঁয়ে দেখায় ব্যস্ত তখন তিনি। জীবনে এই প্রথম স্বামীর স্পর্শসুখ পেয়েছেন তিনি। এটা থেকে নিজেকে সামান্যতমও বঞ্চিত করতে চান না তিনি। উত্তরের বদলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি স্বামীর উদ্দেশ্যে।
‘আপনি আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেনো? বিয়ের দিনইতো ছেড়ে চলে গেলেন আমাকে। আমি কি কোনো অন্যায় করেছিলাম আপনার কাছে? নাকি আমাকে দেখে পছন্দ হয়নি আপনার?’
পুষ্পকুন্তলার চুলের মধ্যে বিলি করতে থাকা তাঁর আঙুলগুলো হঠাৎ করেই স্থির হয়ে যায় তাঁর। পুষ্পকুন্তলার এক রাশ জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর আসে না।
‘আজকে অন্তত বলেন, আমার অপরাধটা কী ছিলো? আমাকে কেনো এতো বড় আঘাত সইতে হয়েছিলো?’
‘তোমার কোনো অপরাধ ছিলো না পুষ্প। অপরাধ আমার।’ মৃদু কণ্ঠে তিনি বলেন।
‘কী রকম?’
‘বিপ্লবীদের বিয়ে করতে নেই। সংসারের বাঁধন আমাদের জন্য না। দেশ মাতৃকার জন্য নিজেদের বিসর্জন দিয়েছি আমরা। সংসারের মায়া থাকলে সেই কাজ সুষ্ঠুভাবে করা যায় না।’
‘তাহলে বিয়ে করেছিলেন কেনো? না করলেইতো আমাকে এর এমন শাস্তি পেতে হতো না।’
‘বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের প্রবল চাপকে উপেক্ষা করতে পারি নাই আমি। চাপে পড়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।’
‘চাপে পড়ে যখন রাজিই হলেন, সংসারটা করলে কী অসুবিধা হতো? আমি হতভাগিনীটা তো অন্তত বাঁচতাম। তা না পালিয়ে গেলেন আপনি আমি পালকি থেকে নামতে না নামতেই।’
‘পালিয়ে যাইনি, দেশের প্রয়োজনে গিয়েছিলাম।’ ইতস্তত শোনায় তাঁর গলা।
‘হায়রে দেশ! দেশের জন্যই তাহলে বলিকাঠে ঝুলালেন আমাকে।’ বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পুষ্পকুন্তলার বুক চিরে।
‘তোমার প্রতি মহা অন্যায় করেছি আমি। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’
স্বামীর বুকে মাথাটাকে আরেকটু গুঁজে দেন পুষ্পকুন্তলা। মৃদুকণ্ঠে বলেন,
‘অন্যায় আপনি করেন নি। এই সমাজটাই আমাদের মেয়েদের কখনো মানুষ ভাবেনি। আপনিও এই সমাজেরই একজন। এরা যা শিখিয়েছে আপনাকে, আপনি তাই শিখেছেন।’
পুষ্পকুন্তলার মাথাটাকে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকেন মাস্টারদা সূর্যসেন। চোখ দুটো জলে ভিজে গিয়েছে তাঁর। পুষ্পকুন্তলা যাতে সেটা দেখতে না পায়, সেজন্য মুখটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখেন তিনি। দেশের প্রতি দায় চোকাতে গিয়ে পুষ্পকুন্তলার প্রতি যে ঘোর অন্যায় তিনি করেছেন, তার কোনো ক্ষমা আসলেই হয় না।