সৌম্যজিৎ দত্ত

লেখক, ব্লগার, আইএসআই তে লেকচারার এবং গবেষণারত ছাত্র।

পুরুষতন্ত্রকে ভাঙচুর করে আসা এক পুরুষ থেকে মানুষ হওয়ার গল্প

আমি ছোট থেকে এক ঘোর পুরুষতান্ত্রিক একটি পরিবেশ এবং পরিবারে বড় হয়েছি। ছোট থেকে বড় হওয়ার এই মূল্যবান একটি সময় যখন মানুষের মানসিক বিকাশ ঘটে, আগামীতে সে কেমন হবে, তার প্রকৃতি'র গঠন হয়, তখন আমি দেখেছি ভয়ঙ্কর এক পুরুষতন্ত্র।

ঘরে নারী নির্যাতিতা। পুরুষের গায়ের জোর। পুরুষের উশৃঙ্খল জীবন এবং সেটাই পুরুষত্ব, পুরুষ মানেই তার জোর সব থেকে বেশি হবে, সে যা করবে সেটাই ঠিক, নারী শুধু ঘর গোছানোর দাসী, নারী মানেই ঘরে থাকবে এমন একটি ভয়ঙ্কর পরিবেশ! এতো'কিছু আমি কখনোই চিন্তা করি নি। বরং প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে অবচেতন থেকে চেতন সমস্ত অংশেই আমিও এই ঘোর পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ হয়ে উঠছিলাম। এমনকি আমার যে প্রথম প্রেমিকা ছিলো, সে চেতনায় সমস্ত দিক থেকে স্বতন্ত্র এবং উচ্চমানসিকতার মানুষ হলেও, তার ওপর আমি প্রভুত্ব খাটাতে শুরু করেছিলাম এবং তাকেও দুর্বল করে ফেলেছিলাম আমার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সামনে।

ওই দিনগুলি আমার জীবনের সবথেকে ভয়ঙ্কর দিন। এতোটাই উদ্ধত হয়ে উঠেছিলাম যে নিজের মধ্যে মানুষ শরীরে পুরুষ নামক এক জন্তুকে পালন করছিলাম। মেয়েটি অসহায় হয়ে উঠেছিলো। অসহায় হয়েও সে মানিয়ে নিতে চেয়েছিলো সবটা। শুধু আমাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করছিলো আমার দেওয়া সমস্ত যন্ত্রণা, আঘাতগুলি সহ্য করে। আমি ওকে বুঝতে পারতাম, কিন্তু চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারতাম না কখনো। এরপর একদিন সে আমাকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে দূরে চলে গেলো।

অনেক বছরের একটি সম্পর্কের অবসান ঘটে গেলো এক ঝটকায়। এই বিচ্ছেদ আমি মানতে পারি নি। ইগো ছিলো না মানুষটির সাথে, ইমোশনালই এতোটাই জুড়ে ছিলাম যে ও চলে যাওয়ার পর থেকে নিজের সব ভুলগুলি আমাকে তীরবিদ্ধ করতে থাকে। আমি নিজেকে চেপে ধরি আর এমন ভুল করবো না কখনো ভেবে। নিজেকে বারবার প্রতিমুহূর্তে ধরে রাখার চেষ্টা করি। প্রতি পদক্ষেপে নিজেকে বলি, এটা ঠিক নয়, এমন যেন আর না করি। 

ঠিক এমন সময়ে আমার পরিচয় হয়ে যায় মানববাদী লেখক তসলিমা নাসরিনের আদর্শের সাথে। এই আদর্শের সাথে পরিচয় ঘটার পর থেকেই আমি আমার ভিতরে গড়ে ওঠা ঘোর পুরুষতান্ত্রিক দিকগুলি চিহ্নিত করতে পারি খুব সহজেই। নিজেকে পাল্টে ফেলার চেষ্টা তো ছিলোই, তার সাথে জুড়ে গেলো নিজের ভিতরে গড়ে ওঠা ভুলগুলি চিহ্নিত করে নিজেকে একেবারে শুধরে ফেলা।

আমি বুঝতে পারি, আমার ভিতরে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা গড়ে উঠেছিলো আমারই পরিবার থেকেই। নারীকে আমিও অবচেতনে একজন দায়বদ্ধ যন্ত্র ভাবতে শুরু করেছিলাম। আমার ভিতরেও এমন চিন্তা এসে গেছিলো, "আমি পুরুষ। আমি যা করি, যেটাই করি, তা ভুল হলেও ঠিক। আমি করতেই পারি। নারী আমাদের অধিকারের কোনো বস্তু বা সম্পত্তি। আমাদের ভালোলাগা, খারাপলাগা খেয়াল করার দায়িত্ব নারীর। আমাদের মনোরঞ্জন করার দায়িত্ব, সে শুধু নারীর।" 

আদর্শের এই বোধ জন্মানোর পর বহু চেষ্টা করেও আমার সেই প্রেমিকাটির বিশ্বাস আর পুনরায় অর্জন করতে পারি নি। সে আমার এই পরিবর্তনকে মুখোশ বৈ আর কিছুই ভাবতে পারতো না। অথচ সে এটা বুঝতে পারে নি, আমার ভিতরে এই পাল্টে যাওয়া মানুষটি একেবারে নতুন। এই মানুষটি আর তাকে কখনো অসম্মান করবে না। এই মানুষটি আর তার ওপর প্রভুত্ব ফলাবে না। এই মানুষটি আর তাকে প্রতারণা করবে না কখনো। তাকে ফেরানোর বহু চেষ্টা করতে থাকি। ব্যর্থ চেষ্টা।

শেষ যেদিন আমার এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিলো, সেদিন আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। আবেগতাড়িত যন্ত্রণা নিয়ে সেদিন লেখক তসলিমা নাসরিনকে মেসেজ করেছিলাম। আমার মেসেজে হয়তো সেই যন্ত্রণা তীব্রভাবে ফুটে উঠেছিলো, লেখক তসলিমা নাসরিন আমাকে তাঁর আদর্শের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে নেয় সেদিন। অবশেষে যখন সেই প্রেমিকাটি বুঝেছিলো যে আমি সত্যিই পাল্টে যাওয়া একজন মানুষ, নিজে মুখে যেদিন আমায় সে'কথাটি জানিয়েছিলো, তখন আর তার পক্ষে এই সম্পর্কে ফিরে আসা সম্ভব ছিলো না। তখন সে পরিবারের পছন্দ করা ছেলেটির সাথে বিয়ে করতে চলেছে। বিয়ের ঠিক আগের মুহূর্তে আমাকে জানায়, "তুই সত্যিই পাল্টেছিস। নিজেকে ভালো মানুষ গড়তে পেরেছিস। এভাবেই ভালো হয়ে থাকিস সবসময়।"

এরপর আদর্শের সান্নিধ্যে এসে একের পর এক ভুলগুলি খুঁজে বের করে নিজেকে আরও শোধরাতে থাকি। পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ হতে ক্রমশ নিজের মানুষ সত্তাকে জাগিয়ে তুলি। মানুষ হয়ে উঠি। এবার আমাকে বাস্তব কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।

আমি তো আদর্শের সান্নিধ্যে এসে নিজেকে পুরোপুরি ভিন্ন একটি মানুষ হিসেবে গড়ে তুললাম, কিন্তু আমার পুরুষতান্ত্রিক পরিবার তো আর পাল্টে যায় নি। সে যেমন ছিলো, একইরকম আছে। সেই একই চিন্তা, "পুরুষ মানেই প্রভু। সে বাইরে যা ইচ্ছা তা'ই করবে, যেমন ইচ্ছা চলবে, যেমন ইচ্ছা ঘরে নারীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে। নারীকে সেটা ভোগ করতে হবে, কারণ সে নারী।" আমি আর এই পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি না। এমনকি চোখের সামনে পরিবারের নারীদেরকেও শত অত্যাচার সহ্য করার পরও এই ঘোর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকেই "বিধাতার বিধান" বলে মানতে দেখি। ধর্মীয় কুসংস্কার তো আছেই, তার সাথে আছে পুরুষতন্ত্রে নিজেদের অভ্যস্ত করে ফেলা। পরিস্থিতি ভীষণই ভয়ঙ্কর। পরিবারে নারীরা অন্যরকম সমাজের স্বপ্ন দেখে না, চিন্তা করে না, ভাবে না। যেহেতু আমি ভাবি, আমার এই ভাবনাকে "অভিনয় বা ভান করা" ভাবে। মিথ্যে ভাবে।

প্রতিমুহূর্তে আমার চিন্তা এবং মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে পুরুষতান্ত্রিক পুরুষগুলি এবং পুরুষতন্ত্রে অভ্যস্ত নারী। দিনে দিনে একা হয়ে যাই। বেঁচে থাকি শুধু কিছু স্বপ্ন নিয়ে। বেঁচে থাকি লেখক তসলিমা নাসরিনের দিকে চেয়ে। ভাবি, একদিন আমি ঠিক সময় পাবো, সুযোগ পাবো নিজের চিন্তাভাবনাগুলিকে পরিবারে প্রতিষ্ঠা করার। সমাজে প্রতিষ্ঠা করা ব্যাপারটি অনেক বড় কিছু, আগে অন্তত নিজের পরিবারে যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, সেটিই অনেক। 

এই যে কিরণ নামের যে মানুষটিকে আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি, এই ভালোবাসা আমার কাছে ভীষণ মূল্যবান। কিরণ হয়তো আমাকে পছন্দ করে না, কখনো পছন্দ করে নি, হয়তো ভেবেছে প্রেম মানেই প্রতারণা, হয়তো ভেবেছে আমার অতীত এতো খারাপ, পরে আমি ওর সাথে প্রতারণা করবো না এমন কি নিশ্চয়তা আছে! একদম ঠিক ভেবেছে সে। আমার অতীত তো সত্যিই খারাপ। একজন খারাপ মানুষ ছিলাম। একজন প্রতারক ছিলাম। তার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন হওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে। সে আমাকে ভালোবাসবে নাকি খারাপ বাসবে সেই সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার তার আছে। আমি তার সিদ্ধান্তে কখনো জোর করবো না। করতে পারি না। শুধু এটুকু জানি, ও যদি আমাকে একটি সুযোগ দেয়, আমি একজন ভালো প্রেমিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাবো। আমি ওকে উপলব্ধি করাবো যে সমাজে আর যে পুরুষই নারীকে যন্ত্র, বস্তু বা সম্পত্তি ভাবুক, আমি কখনো ওকে আমার সম্পত্তি ভাববো না, যন্ত্র মনে করবো না, বস্তু মনে করবো না। যেমন মানুষ ভেবে ওকে আমি পছন্দ করেছি, ভালোবেসেছি, তেমনই মানুষ ভেবে ওকে সবসময় ভালোবাসবো। মানুষ হয়ে, বন্ধু করে ভালবাসবো আজীবন। 

আমি এখন জীবনের সব থেকে জটিল মুহূর্তটিতে এসে দাঁড়িয়েছি। একদিকে আমার কেরিয়ার, পড়াশোনা, যেখানে বহু সমস্যা ভেদ করে বেরোনোর চেষ্টা করছি, আরেকটু এগিয়ে যেতে পারলেই হয়তো সফল হবো, একটু ভুল হলেই হয়তো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যাবো, অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছি। অন্যদিকে কিরণের অপ্রেম মুহূর্তেই ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়, আবার পরিবারে ক্রমশ ভিন্ন মত গড়ে ওঠার কারণে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস করছি। বেঁচে থাকা বড্ড কঠিন মনে হয়। প্রতিটা মুহূর্তে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হচ্ছি। এরপরও স্বপ্ন দেখছি ভালো জীবনের। এরপরও উঠে দাঁড়ানোর অবিরাম প্রয়াস। এরপরও স্বপ্নকে ভাঙতে না দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা। হয়তো জিতবো একদিন। হয়তো হেরে গিয়ে হারিয়ে যাবো চিরতরে। তবু এতো সহজে আমি হেরে যাবো না। হেরে যাওয়ার আগে জীবনকে প্রতি'মুহূর্তে ভাঙবো, গড়বো, চেষ্টা করে যাবো জেতার। 

যে আদর্শকে বুকে নিয়ে চলছি, সে আদর্শ তো হাজারও বিপত্তির মধ্যেও, প্রাণহানির সম্ভাবনার মধ্যেও, গোটা একটি রাজ্যের, গোটা একটি দেশের সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে, এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমিও আমার লড়াইকে এতো সহজে ছেড়ে দেবো না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি লড়বো। যদি হেরে যাই, হারলেও আক্ষেপ থাকবে না। শুধু ভাববো সময় শেষ হয়ে গেছে। 

3264 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।