তাসনিম হালিম মিম

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পুরুষতন্ত্রের অনাকাঙ্ক্ষিত শিকার

কয়েকদিন আগে একটি খবর ফেসবুকের হোম পেইজে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের এক ছাত্র সিনিয়র তিন জন ছাত্রীর দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছে। খবরটা যথেষ্ট বেদনানাদায়ক এবং বিব্রতকর। কিন্তু তার চেয়েও বহুগুণে বিব্রতকর হচ্ছে, এই খবরে মানুষের রিএকশনগুলো। এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির খবরে, নিউজ পেইজ গুলোর কমেন্ট সেকশনে ঢুকলে সুস্থ বুদ্ধির যে কোনো মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু এই খবরটি যেন এক কাঠি সরেস। যতবার শেয়ার হয়েছে, ততবারই দেখলাম বিপুল পরিমাণ 'হা হা' রিয়্যাক্ট দিয়ে ধ্বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সংবাদটির গুরত্বকে। যেন ব্যাপারটি নিতান্তই ফালতু, হাস্যকর, বিনোদনদায়ক। 'একজন মানুষ অন্য তিনটি মানুষ দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছে'-- এরকম একটি সেনসিটিভ খবর অধিকাংশের কাছে লাগছে মজাদার।

এই ঘটনাটিই একজন নারীর সাথে যদি ঘটে, আর কিছু না হোক, বর্তমান সময়ে অন্তত মানুষ হেসে তা উড়িয়ে দেয় না। সাধারণ মানুষের বক্র দৃষ্টি, কটু কথার পরেও প্রতিবাদ হয়, আন্দোলন হয়। এই প্রেক্ষাপটও কিন্তু খুব সহজে আসে নি। এমনও সময় ছিলো, যখন নারীর প্রতি যৌন সহিংসতাকে তেমন ওজনদার অপরাধ বলেই দেখা হতো না। দীর্ঘদিনের নারী আন্দোলনের ফসল হিসাবে ধর্ষণ একটি culpable crime হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে যেসব পুরুষ এরকম যৌন হয়রানির স্বীকার হচ্ছে, তারা নিজের প্রতি এইটুকু সহানুভূতিও পাচ্ছে না।

কারণ, পাবলিক তো এভাবে ঘটনাটাকে দেখছে না যে, একজন 'মানুষ' লাঞ্ছিত হয়েছে। তারা দেখছে একটা ছেলে তিনটা মেয়ের দ্বারা নাস্তানাবুদ হয়েছে। তাদের কাছে 'লিঙ্গ' ম্যাটার করে। পুরুষতন্ত্রের কাছে পুরুষ সবলতার আর নারী দুর্বলতার প্রতীক। আর সামাজিক সাইকোলজি যেখানে হয়রানি, নিগ্রহকে শক্তিমত্তার প্রদর্শন হিসাবেই দেখে, সেখানে একজন সবল পুরুষ যখন দুর্বল নারীর কাছে মার খায়, লাঞ্ছিত হয়, সেই হতভাগা পুরুষ আর কিছুই না, শুধু হাসিরই পাত্র হয়। না তাকে কেউ ভিক্টিম মনে করে, না ঘটনাটাকেই কেউ গুরত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।  

প্রথম কারণ তো গেলো এটি। দ্বিতীয় কারণ টা আরো মারাত্মক। নারীর ক্ষেত্রে তার শরীরের সাথে সম্মানের ধারণাটি ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত করে দিয়েছে সমাজ। অর্থাৎ তাকে যৌন আক্রমণ করা তার সম্মানের উপর একটি আঘাত বলে ধরে মনে করা হয়। 'ধর্ষণ' এর পরিবর্তে এখনো পর্যন্ত যখন 'সম্ভ্রমহানি' শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখনই এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নারীর সম্মান তার শরীরেই আবদ্ধ, নারীর সম্ভ্রমকে তার যোনীতে নিহিত করে রেখেছে পুরুষতন্ত্র। পুরুষের যেহেতু এই সমস্যা নেই, তাই তাদের উপর যৌন হয়রানিকে খেলো করে দেখার মানসিকতা মানুষের থাকতেই পারে। 

শুধুমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই শরীরের সাথে সম্মানের সম্পর্ক তৈরি করে রাখা লৈঙ্গিক রাজনীতির একটি চাল। কিন্তু তার প্রভাব থেকে যে পুরুষও বাদ যাচ্ছে না, শুরুর খবরটিতে মানুষের প্রতিক্রিয়াই তার প্রমাণ। এরকম, আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা খেয়াল করেছি। এক বড় ভাই টিএসসিতে একদিন গল্প করছিলেন, কোনো এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তাকে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বেশ কিছু মেয়ের একটি দল তার প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছিলো, ফোন নাম্বার চাচ্ছিলো। ভাই যথেষ্ট ক্ষোভের সাথে আমাদের ঘটনাটি বলছিলো, কিন্তু আমি আরো ক্ষোভের সাথে আবিষ্কার করছিলাম, দলের শ্রোতারা খিকখিক করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। একজন তো বলেই ফেললো, "মেয়ে মানুষ নাম্বার চাচ্ছে, আর আপনি ভেড়ার মতো পালায় চলে এলেন। পুরুষ মানুষের এতো লজ্জা, এটা ঠিক না ভাই!" 

এ আরেক মজার কথা। পুরুষদের লজ্জা থাকতে নেই, ভয় থাকতে নেই, পুরুষদের কোমল হতে নেই, পুরুষদের কাঁদতে নেই--আরো কতো অযৌক্তিক অমানবিক বিধি-নিষেধ।  অর্থাৎ মানবীয় অনেক বৈশিষ্ট্য থেকে পুরুষদের বঞ্চিত করছে পুরুষতন্ত্র। রাফ এন্ড টাফ হিসাবে গড়ে তুলতে গিয়ে বরং পুরুষের মানুষ হতে দিচ্ছে না, আধ-মানব হিসাবে তৈরি করছে। আর যেসব পুরুষেরা এই ছকের বাইরে যাচ্ছে, যারা লজ্জা পাচ্ছে, কেয়ার করছে, যারা কাঁদছে সেইসব সংবেদনশীল পুরুষেরা হচ্ছে ঠাট্টার পাত্র, তারা হয়ে যাচ্ছে 'মেয়েলি'। 

আরো আছে। আমার কাছের বন্ধুদের দেখি (বান্ধবী নয়), ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব টেনশনে। এতো টেনশনে যে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটিও ঠিকভাবে উপভোগ করতে পারছে না। কারণ, তাদের পাশ করে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। অন্যদিকে অধিকাংশ মেয়েকেই দেখি, তাদের সামনে দুটো 'অপশন' আছে, এমনটা ধরে নিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতে। অপশন দুটো কি? একটা চাকরি, অন্যটা বিয়ে। ছেলেরা বিয়ে করুক বা নাই করুক, অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেওয়া থেকে তাদের রেহাই নেই। যদিও এতে শেষ পর্যন্ত বড় ক্ষতিটা হয় মেয়েদেরই। তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে, কাজ করার জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে, পরনির্ভর বানানোর প্রক্রিয়াটা খুব ভালো ভাবেই সম্পন্ন করছে সিস্টেম। কিন্তু তবুও, যেখানে দায়িত্বটা সমান-সমান ভাবে নারী-পুরুষ দুজনেরই বহন করার কথা ছিলো, সেখানে পুরুষের উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়াটাকে 'সুবিধা' হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায় কি? না কি এটা পুরুষদের জন্যই অধিক চাপের আর ক্ষতিকর? 

পুরুষতন্ত্র নামক সামাজিক ব্যবস্থাই বলুন বা সামাজিক ব্যাধিই বলুন, তার থেকে কিন্তু খোদ পুরুষরাও রেহাই পায় না। শিকার কিন্তু তার উভয় লিঙ্গই।  

5563 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।