একটু গ্রামের গল্প বলি। ধরে নেই নাম তার কথা। একেবারে বাল্যবিবাহ বলতে যা বোঝায় তাই। ক্লাস সেভেনে থাকতে বিয়ে। বরের বয়স ছিলো চব্বিশ বা পঁচিশ। কয়েক বছর সংসার করার পর বর বাবাজীর মনে হয়েছে উনি বউয়ের ছোটবোনকে বিয়ে করবেন। করতেও চাইলেন। তখন তাড়াতাড়ি করে সেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করা হলো অন্যজায়গায়। বলা বাহুল্য ওই মেয়ের বয়স মোটে ১৫/১৬ বছর। যেই উনি জানতে পারলেন শ্যালিকার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে উনি উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করলেন। আগের বউকে মারধোর করাতো আছেই। তারপর অবশেষে তিনি ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরার নাটক করার চেষ্টা করলেন। শ্যালিকার সাথে বিয়ে দেওয়া না হলে তিনি মারা যাবেন। অনেক কান্ড করে মেয়েটাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রথম বউয়ের উপর নির্যাতন চলছে আজও।
গল্প দুই- ভালোবাসার বিয়ে, সহপাঠীর সাথে। কম বয়সের বিয়ে। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর এখন জানা গেছে পতিদেবের আরেকটা সম্পর্ক আছে। ফলাফল ঝগড়া বিবাদ। বউয়ের গায়ে হাত তোলার কথা আলাদা করে বলা লাগবে না। বউটি স্বামীর সাথে না পেরে উঠে অন্য মহিলাটির সাথে যেয়ে নিয়মিত ঝগড়া করেন যাতে পতিদেব ফিরে আসেন। ওই মহিলা বিধবা, উনি একাই থাকেন।
গল্প তিন- দুজনের সংসার ভালোই চলছিলো। কোনো অসুবিধা নাই। হঠাৎ একদিন স্ত্রী দেখতে পেলেন যে পতিদেব নাই। কোথায় গেলো? পরে জানা গেলো পতিদেব আরেকটি বিয়ে করেছেন। বউ নিয়ে আসছেন। বেচারা বউটি জানতেও পারে নি পতিদেবের মনে এই ছিলো। অনেক গরীব ঘরের একটা মেয়ে নতুন বউ। এই দুই বউ নিয়েই সংসার চলছে আজ প্রায় চার বছর। দুই বউতে আগে তুমুল ঝগড়া হতো। বড়বউ ছোটোটাকে মেরেছেনও কয়েকবার। তখন পতিদেব এসে দু’জনকেই পিটাতেন। এখন ওনারা বুঝে গেছেন। আর ঝগড়া করেন না।
আমরা যখন প্রেম করি বা কোনো সম্পর্কে থাকি তখন যদি জানি যে আমাদের পার্টনার সম্পর্কে সৎ নয় তখন সেটা মেনে নেওয়া প্রচন্ড কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কতোটা কঠিন তা সেই লোকগুলোই জানে। প্রচন্ড কষ্ট আর অপমান ঘিরে ধরে। ওই সম্পর্ক বা মানুষটার সাথে থাকা বা তাকে ক্ষমা করে দেওয়া কতোটা সম্ভব হয়? কিন্তু এই মেয়েগুলো থাকে। কেনো থাকে? কারণ না থেকে উপায় নেই। এসব জানার পরেও পুরুষটির মার খেয়েও থাকেন।
গল্প চার- জমজ বাচ্চা পেটে। তীব্র ব্যথা নিয়ে কিশোরী বাচ্চা মেয়েটা দুইদিন শ্বশুরবাড়ী পরে থাকলো। বাচ্চা হয়ে যাবে যাবে করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো না। প্রসব বেদনা সবচেয়ে ভয়ংকর বেদনা। তাই নিয়ে দুটো দিন। দুইদিন পর যখন মারা যাওয়ার মতো হলো মেয়েটা, আশেপাশের লোকেও গালি দিতে শুরু করলো তখন নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। একটা বাচ্চা বেঁচে আছে, অন্যটা নাই। আরেকটু হলে মাও বাঁচতো না।
প্রত্যেকটা ঘটনা গল্প নয় কিন্তু। আমার নিজের জানা ঘটনা। পাত্র পাত্রী অনেককে জানি। এমন অনেক আছে। গ্রামের নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েদের সাধারন স্কুলে থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। না পড়াশুনা করার সুযোগ পান, না সাহস থাকে শহরে যেয়ে কাজ করে কিছু করতে পারার। আর তা যদি করতেও চান তবু তার জন্য কতোটুকু সহায়ক আমাদের সমাজ? যে হারে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি তাতে হয়তো এরা মনে করে বাইরের লোকের কাছে মার খাওয়ার চেয়ে চেনা পরিবেশেই থাকি। সেটাই যুক্তিযুক্ত। আর নিজের বাবা মায়ের কাছে যেতে চাইলে তারাও বলবেন মেয়েলোকের এসব মেনে নিতে হয়। শত অত্যাচার অপমান সহ্য করে এনারা জীবন পার করে দেন।
এই ধরনের ঘটনা যদি একটা শিক্ষিত মেয়ের সাথে হতো হয়তো বলতাম, মেয়ে লড়াই করো, চিৎকার দিয়ে নিজের কথা বলো। কিন্তু এনাদেরকে কিছু বলার মতো ভাষাও আমি পাই না। কিসের অধিকার? কিসের চিৎকার? সব চিৎকার থেমে যায়। কিসের লড়াই? যেখানে জীবনের নূন্যতম প্রাপ্তিও নাই। যাদের জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটা দিন কাটে অন্যের মর্জি মতো।
এই দেশের কতোগুলো মেয়ে সব সুযোগ পায়? পড়তে পায়? বাল্যবিবাহের হাত থেকে রেহাই পায়? যদি সব অন্যায় না মেনে একা বাঁচতে চায় সে বাঁচার অধিকার পায়? বিদ্যা না থাকলেও বুদ্ধি বা শারীরিক শক্তি দিয়ে একটা নিরাপদ পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পায়?
আমি নিজে মেয়ে বলে এইটুকু পথ আসতে কতো হয়রানির সম্মুখীন হয়েছি। শুধুমাত্র মেয়ে বলে কতো সমস্যা দেখতে হয়েছে। মনে হতো এটা কিসের জীবন। কিন্তু এনাদের দেখলে মনে হয় আমি কতো সৌভাগ্যবতী।
পুরুষতান্ত্রিকতার সবচেয়ে জঘন্য রূপটা মনে হয় তৃণমূল পর্যায়ে গেলে দেখা যায়। অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ নারী অধিকারের কথা শুনলে নাক সিঁটকান। নারীবাদ শব্দ নিয়ে মজা করেন। তারা কি কখনও এই মেয়েদের দেখেছেন? ভেবে দেখেছেন অমন জীবন যদি আপনার হতো? একবার ভাবুন, গতকাল বাংলাদেশের মানুষ পালন করলো স্বাধীনতা দিবস অথচ দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী কি অপূর্ব স্বাধীনতা ভোগ করছে!