নিইয়র্কের ট্রেনে খুব ভীড় থাকে। বিশেষ করে সকালে ও অফিস ছুটির পর। কাল রাতে বাসায় ফেরার সময়ও ট্রেনে প্রচুর ভীড়। এতোটাই যে পাশের জনের নিঃশ্বাস এসে কপালে লাগছে। এরা এতো ভীড়ের ভিতরেও পরস্পরের গা বাঁচিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে হঠাৎ আমার মনে হলো দেখি পাশে কারা দাঁড়ানো। আবিষ্কার করলাম তিনদিকে তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বলতে গেলে ওদের সবার শরীরের সাথেই আমার শরীর লাগানো। সামনের ছেলেটা এতো কাছে যে সামনা সামনি দাঁড়ালে আমার মাথা ওর গালে গিয়ে প্রায় লাগে। বেচারা তাই মাথাটা আর হাত উঁচু করে ফোনে কিছু একটা করছে। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম যে সে নিজের কাজে ব্যস্ত সামনে কে আছে এসব দেখার দরকার নেই। তখন হঠাৎ আমার বাংলাদেশের কথা মনে হলো। প্রথমত এতো ভীড়ের গাড়ীতে হয়তো উঠতাম না। আর যদি উঠেও পড়তাম তবে পাশে কে বা কারা আছে তা তাকিয়ে দেখা লাগতো না। ওনারা নিজ দায়িত্বে গায়ে হাত দিয়ে বা দেয়ার চেষ্টা করে বা আরো গা ঘেঁষে এসে বুঝিয়ে দিতেন যে আমরা পুরুষ।
যে কোনো বাঙালি মেয়ের কাছেই মনে হয় ভীড় একটা আতঙ্ক। ভীড়ের মধ্যে গিয়েছে কিন্তু কোনো অযাচিত ঘটনার সম্মুখীন হয়নি এমন মেয়ে আছে কি? আমার নিজের কয়েকটা কথা খুব মনে পড়ে। তখন কেবল ইউনিতে ভর্তি হয়েছি। আমাদের এলাকার কয়েকজন বসে আছি কলাভবনের সামনে। তা আমার সাথে আরো একটা ছেলে পরীক্ষা দিয়েছিলো। পছন্দমতো বিভাগ না পেয়ে মন খারাপ তার। তখন হঠাৎ শুনলাম তাকে আরেকজন বলছে “নীলক্ষেত যেয়ে একটু কনুই মেরে আসো মন ভালো হয়ে যাবে”। আমি কিছু না বুঝে জিজ্ঞেস করেছিলাম এর মানে কি? তারা আমাকে তা বলেনি।
এর মানে আমি বুঝেছি কিছুদিন পর। ঢাকা কলেজের সামনের মার্কেট দিয়ে কিসব কিনে হেটে বের হয়েছি। সাথে পূজা বলে আমার এক সিনিয়র দিদি ছিলেন। তিনি আমার শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে আমার বুকের উপর দিয়ে বললেন এভাবে ধরে হাঁটো। এখানে অনেক ভীড়! উনি কি বলতে চাচ্ছেন তা বুঝে গেছিলাম। সেই শুরু। যতোদিন নিউমার্কেট বা নীলক্ষেত গেছি শপিং করে শপিং ব্যাগ বুকে চেপে ধরে ওই জায়গাটুকু পার হয়ে আসতাম। খালি আমি না হলের অধিকাংশ মেয়ের এই অভ্যাস ছিলো। নীলক্ষেতের ওই ভীড় নিয়ে সবাই বিব্রত থাকতো। কেনো? কারণ কারো কাছে ভীড়ের মধ্যে মেয়েদের বুকে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়া একটা মন ভালো করার মজাদার উপায়।
ভীড় নিয়ে আমার জীবনের সবচে বাজে ঘটনা ছিলো অন্য একটা। নিজে মেয়ে বলে বহুবার বহু আতঙ্কিত সময় গেছে। এটা তারমধ্যে একটা। তখন মনে হয় থার্ড ইয়ারে পড়ি। এক দাদার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেছি রমনা কালী মন্দিরের সামনে। তখন বই মেলা চলছে। বের হয়ে মন্দিরের গেইট দিয়ে রাস্তায় নেমে দেখি প্রচন্ড ভীড়। তখন মেলা শেষ হবার সময় নাকি ঠিক মনে নেই। তো আমরা একটা ভুল করে ফেললাম। রাস্তা ক্রস করে এই পাশে আসতে গেলাম। রাস্তার মাঝে এসে আবিস্কার করলাম আমি একটা অনেকগুলো ছেলের দলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। কয়েক বছর পর পহেলা বৈশাখের ঘটনাটা দেখে আমার নিজের কথাটা মনে পড়েছিলো। যাই হোক দুই সেকেন্ড আশে পাশে লোকগুলোর মুখের দিকে চেয়ে আমি যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলাম। কি এক আতঙ্ক ভর করেছিলো সে আমি জানি। আমি বের হতে পারছি না। এগুতে পারছি না। এতো ভীড়। আমার সাথে যিনি ছিলেন তিনিও আমাকে নিয়ে বের হতে চাচ্ছেন পারছেন না। আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে আমি ওনাকে সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার অন্যকোনো উপায় আর মাথায় আসে নি। ওই দাদা আমাকে ওভাবে ধরেই বের করে কোনোমতে ফুটপাতে ওঠেন। খুব অল্প সময়। কিন্তু মনে হয়েছিলো কতো লম্বা। আমি বহুক্ষন কোনো কথাই বলতে পারিনি। সাথে যিনি ছিলেন তিনি আরো বিব্রত। মনে আছে টিএসসি এসে উনি ধপ করে বসে পড়েন।
প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া একটা শরীর নিয়ে সবসময় আতঙ্ক, জড়তা, ভয় নিয়ে কাটাতে কেমন লাগে তা মেয়ে মাত্রই জানে। এগুলো কেনো? কারা এগুলো করে? চারপাশে যাদের দেখি সবাই নাকি ভালো। তো এই মানুষগুলো কারা? তারা কি আকাশ থেকে নেমে আসেন?
যাই হোক কালকে ট্রেনের ভীড়ে দাঁড়িয়ে এই কথা গুলোই ভাবছিলাম। এই যে ট্রেনের ছেলেগুলো এরা তবে কি? এই যে এতো ভীড়ে প্রায়ই আসি কখনো অস্বস্তি হয় না, আতঙ্ক হয় না। কেনো? পরে মনে হলো এরা মনে হয় ঠিকঠাক পুরুষ হয়ে উঠতে পারে নি। পুরুষ মানুষ এমন নয়। পুরুষ মানুষ পুরুষত্ব জাহির করে, করতে হয়।