আমাদের ছেলেগুলা মানে বাঙালি কিশোর, যুবক, মধ্য বয়স্ক পুরুষ, এবং বিগত যৌবনা বয়স্ক পুরুষেরা যারপরনাই অত্যন্ত কিউট প্রজাতি। উনারা অত্যন্ত সৎ, ভদ্র, সুশীল জাতি। কেনো বলছি একথা? আসুন একটা জরিপ করি। মি টু হ্যাশট্যাগে কতজন বাঙালি নারী তাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে তাদের সাথে হওয়া যৌন নিপীড়নের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন? আর এর বিপরীতে কতজন পুরুষ আই হ্যাভ হ্যাশট্যাগে তাদের দোষগুলো স্বীকার করেছেন?
আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন নারীই মি টু হ্যাশট্যাগে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া খারাপ ঘটনাগুলো শেয়ার করলেও পরিচিত/অপরিচিত একজন পুরুষকেও দেখলাম না তাদের কৃত কর্মের দায় স্বীকার করে নিয়েছে, উল্টো বেশ কয়েকজনকে দেখলাম আই হ্যাভ ক্যাম্পেইন নিয়ে ট্রল বানিয়ে ফেসবুকে শেয়ার করে মজা করছেন। এতে করে বোঝাই যাচ্ছে বাঙালি পুরুষেরা কতটা সুশীল এবং সভ্য। আমাদের এই কিউট ভাইলোগেরা জীবনেও কোনো নারীর দিকে খারাপ ভাবে তাকায়নি, কোনো নারীকে অসম্মান করেনি, কোনো মেয়ের প্রতি বাজে কমেন্ট পাস করেনি, ভিড়ের মধ্যে কোনো মেয়েকে একা পেয়ে তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেনি, ধর্ষণ করেনি, কাউকে এসিড ছুড়ে মারেনি, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেনি, তারা প্রেমিকার সাথে প্রতারণা করেনি, পরকীয়া করেনি কখনো, কোনো মেয়ের ইনবক্সে তাকে অশ্লীল কথা কিংবা ছবি পাঠায়নি।
তবে এখানে একটা খটকা আছে। যে দেশের পুরুষজাতি এতটা সুশীল সেই দেশের নারীরা মি টু হ্যাশট্যাগে তবে কাদের কথা লিখলো? সুইডেনের পুরুষরা এদেশে এসে বুঝি এই কুকাজগুলো করে গেছে? নাকি এগুলো রূপকথার গল্প! বাংলার দামাল ছেলেরা এসব করতেই পারে না! ভাই থামেন, অনেক সুশীলগিরি তো দেখলাম এবার বাস্তবতা বলি।
পহেলা বৈশাখের ঘটনাটা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। ভিড়ের মধ্যে যে মেয়েটার শাড়ি খুলে নিয়েছিলো, ওরা এই বীর বাঙালি পুরুষই ছিলো।
তনু, রুপা এই দেশী কুকুরদের কাছেই ধর্ষিত হয়েছে।
একশোটা ধর্ষণ শেষে উল্লাস করেছে এই দেশেরই সুসভ্য পুরুষ।
চারপাশে মি টু হ্যাশট্যাগে যে হয়রানির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে ওরা আমাদের চারপাশের এই পুরুষগুলোই।
গভীর রাত্রে পাশের ফ্ল্যাটের যে নারীর আর্তচিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায় তার সম্মানিত পতিবর এই বাংলারই দামাল পুরুষ।
আমার সহপাঠী যার এক প্রেমে মন মজে না, মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তাদেরকে দিয়ে স্বার্থ হাসিল করাই যার এইম ইন লাইফ সেও কিন্তু বাঙালি।
গতকাল বাসে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ফলে যে লোকটা আমায় বললো, “ইদানীং মেয়েগুলার সাহস বেশি বেড়ে গেছে। মেয়ে হয়ে এত সাহস হয় কিভাবে?” এই লোকটাও কিন্তু বাংলাদেশেরই মুখ উজ্জ্বল করেছে!
প্রেসক্লাবের সামনে যে বদমাইশকে জুতো দিয়ে পিটিয়েছিলাম, সে এবং ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামশা দেখা ১০/১৫ জন মহাত্মা পুরুষ বাঙালি পুরুষই ছিলেন বটে।
নিজের ঘরে, লোকাল ট্রান্সপোর্টে, স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিসে, রাস্তায়, সিনেমা হলে, পূজোর মন্ডপে, বিয়ে বাড়িতে, বই মেলায়, বন্ধুর আড্ডায় সর্বত্র এই মহাত্মাদেরই বিচরণ; একটু ভীড়ের সুযোগ, একটু অন্ধকার নামলে এই এরাই মুখোশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তবে এরা এখনো এতটা সুশীল হতে পারেনি যে নিজ নিজ কুকর্মের দায় স্বীকার করে নেবে। কেননা এইটুকু বিবেকবোধ এই সভ্য জাতি এখনো অর্জন করতে পারেননি, কেননা দায় স্বীকার করে নিলে পরবর্তীতে কুকর্ম করতে পারবে না, কেননা এরা জানে এরা যদি নিজেদের এই জীবনে করা সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে নেয় তবে ঘরে বাইরে তাদের মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পাবে না।
তবে দিন বদলাইছে ভাইলোগ। আপনারা সতেরো কোটি জনগনের এই দেশে গা ঢাকা দিয়ে অন্যায় করে অনেক বছর কাটিয়েছেন, এখন আর আপনাদের সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এখনকার এই আমরা আমাদের পূর্ববর্তীদের চাইতে অনেক বেশী সাহসী, অনেক বেশী মারমুখী। আমার গায়ে হাত দিয়ে ভীড়ের মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আমি আপনাকে দেই না, শার্টের কলার খাবলে ধরে সবার সামনে টেনে আনি (যদিও আপনার নোংরামিতে ভরা শার্টের কলারে হাত দিতে আমার রুচি হয় না)। এখন আপনারা বলেন “মেয়ে হয়ে এতো সাহস হয় ক্যামনে?”। আমি হাসতে হাসতে বলি সাহসের দেখছো কি বাপধন! দিনে দিনে আরো দেখবা।