ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

পুরুষ হলো অধিকর্তা-নারী তার অধীন : ভাষার উপর পুরুষের আধিপত্যই টিকিয়ে রেখেছে এই ধারণা

আমিন এবং সীমার ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া অসীম বুদ্ধিমতি মেয়ের বাংলা ভাষার সেক্সিজিম (লৈঙ্গিক বৈষম্য) নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষিতে এই ছোট্ট লেখাটা। ওর প্রশ্ন দুটো দিয়ে দেই এখানে, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে সবার। সে দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে তার মা-বাবাকে।

প্রথম প্রশ্ন: মাতৃভাষা আছে কিন্তু পিতৃভাষা নেই কেনো?

দ্বিতীয় প্রশ্ন: কবিতার নাম 'আদর্শ ছেলে', তাহলে 'আদর্শ মেয়ে' নেই কেনো? শুধু 'আদর্শ ছেলে' আমি পড়বো কেনো?

আমাদের সমাজকাঠামো যেহেতু দীর্ঘকালের পুরুষতান্ত্রিক, ভাষাটাও হয়ে উঠেছে সে কারণে তারই আদলে প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক। বাংলা ভাষার গালিগুলোর দিকে তাকালেই, তা পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান। প্রায় সব চ বর্গীয় গালিই নারীকেন্দ্রিক।

পশ্চিমেও ভাষাটা এক সময় পুরুষতান্ত্রিক ছিলো। এরা এখন এটাকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে এই চেষ্টার গতিটা শ্লথ। যে কারণে তসলিমা নাসরিনকে আমার ছেলেবেলা না লিখে প্রতিবাদ করে লিখতে হয় আমার মেয়েবেলা।

ভাষা হচ্ছে যোগাযোগের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। আবার এই ভাষাই হচ্ছে ক্ষমতা রাজনীতির মূল হাতিয়ার। ভাষা এমন একটা জিনিস, যেখানে প্রতিফলিত হয় পুরুষের ক্ষমতা আর সামাজিক সুবিধাভোগীতা, অন্যদিকে এতেই প্রতিফলিত হয় নারীর ক্ষমতাহীনতা আর তাদের সামাজিক প্রান্তিকতা ও প্রতিকূলতা।

ভাষার উপর পুরুষের আধিপত্য ছিলো সকল সময়ে, সকল যুগে। এর ফলে এর সম্পুর্ণ সদব্যবহার করেছে তারা। ভাষার অপরিসীম ক্ষমতাকে তারা কাজে লাগিয়েছে পূর্ণভাবে। পুরুষ অধিকর্তা আর নারী তার অধীন, এই আদর্শের প্রচারণা করেছে তারা প্রবল এবং সাফল্যজনকভাবে।

ভাষার উপর পুরুষের আধিপত্য শুরু হয়েছে বাবা আদমের সময় থেকেই। ঈশ্বর আদমকে ক্ষমতা দিয়েছিলেন তার সব সৃষ্টির নামকরণের। ঈভের কোনো নীরব ভূমিকা থাকাতো দুরের কথা, তার উপস্থিতিও ছিলো না সেখানে। বাবা আদমের এই ভূমিকার কারণেই কিনা কে জানে, ভাষার বিকাশ এবং এর নিয়ন্ত্রণ সবসময়ই থেকে গেছে সম্পূর্ণরূপে পুরুষের হাতে।

পুরুষ লেখকেরা লিখিত ভাষার রাজ্যকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাহারা দিয়ে রেখেছেন, কুক্ষিগত করে রেখেছেন। নারী লেখকদের কোনো পদচারণা করতে দেওয়া হয় নি সেখানে। পুরুষ ঐতিহ্যে নারী-কেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে সচেতনভাবে। নারী লেখকেরাও প্রবল পুরুষ-পক্ষপাতী এই ভাষায় নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন পলে পলে।

নারীবাদী ভাষা গবেষকরা অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, ভাষার মধ্যে পুরুষের ক্ষমতা প্রদর্শিত হয় অনেকগুলো জটিল উপায়ে। ডেল স্পেনডার নামের একজন নারীবাদী ভাষা গবেষক এর মধ্যে একটাকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন যে, অতীতে ভাষার উপর পুরোপুরি দখল ছিলো পুরুষদের। সব দার্শনিক, বর্ণনাকারক, রাজনীতিবিদ, ব্যাকরণবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ, সকলেই ছিলেন পুরুষ। কাজেই স্বাভাবিকভাবে এই সকল পুরুষেরা ভাষার মধ্যে লৈঙ্গিক বৈষম্য ঢুকিয়ে দিয়েছে পুরুষের আধিপত্য নিশ্চিত করতে।

পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পৌরুষত্ব নারীত্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। নারী-পুরুষের এই বৈষম্যমূলক অবস্থান দীর্ঘদিন ধরে এমনভাবে নানা প্রতিষ্ঠান, চিন্তা-ভাবনা এবং কর্মকাণ্ডের মধ্যে জেঁকে বসেছে যে, এই অসমতাকেই মনে হয় স্বাভাবিক। এর বিপরীত চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থা আর থাকে না।

ভাষার মধ্য দিয়ে পুরুষেরা পুরুষতন্ত্রের আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে, সসুংহত করতে চেয়েছে, করতে চেয়েছে চিরস্থায়ী। পুরুষতন্ত্র ভাষার মাধ্যমে তৈরি করে এক বিশাল জালিক কাঠামো, আর এই জালিক কাঠামোই পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যকে বাড়তি শক্তি যোগায় আর ন্যায়সম্মত করে তোলে।

নারীর জন্য এই রকম একটা বৈরী পরিস্থিতিতে, বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামোতে, কর্তৃত্বপরায়ন প্রভুর হাত দিয়ে যে ভাষার বিকাশ ঘটবে, সেই ভাষা যে নিপীড়নমূলক হবে, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক হবে, সেটাই বলা বাহুল্য। যে সমাজ কাঠামোতে তাদেরকে মানুষ বলেই স্বীকার করা হয় না, দাসি-বাদি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, গবাদি পশুর মতো অনাদর-অবহেলায় রাখা হয়, সেই সমাজ কাঠামো যে তাদের জন্য সমতামূলক সমমর্যাদার ভাষা চালু করবে, সেই আশাটা দূরাশাই মাত্র। বরং নিবর্তনমূলক ভাষার ব্যবহারটাই অতি স্বাভাবিক সেখানে। আর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই ঘটেছে আসলে প্রায় সব ভাষাতেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে বিকশিত ভাষাগুলোতে হয় নারী অনুপস্থিত, অথবা উপস্থিত থাকলেও তা অত্যন্ত অমর্যাদাকর।

শব্দের জন্ম- মৃত্যু সময়ের প্রয়োজনে হয় নি, হয়েছে পুরুষের অনৈতিক এবং অন্যায় লোভের অনল থেকে। প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়েছে আদম, আর সেই প্রদীপের পাদদেশের কালো ঘেরে কুপিত হয়ে থাকার কালো ইতিহাসে ঢেকে গেছে নারীর ভাষিক এবং অন্য সব অধিকার।

1635 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।