লীনা হাসিনা হক

উন্নয়ন কর্মী

পূর্ব আফ্রিকার ডায়রী

অলিভিয়া আমাকে ঘরের কাজে হেল্প করে। সপ্তাহে তিনদিন সে আসে, এর মধ্যে শনিবারই কেবল তার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়, অন্য দুইদিন সে ঘরের কাজ শেষ করার আগেই আমার অফিসের সময় হয়ে যায় তাই আলাপের কোনো ফুরসত পাই না। অলিভিয়ার বাবা মারা গেছে বেশ অনেক বছর আগে, হতদরিদ্র মা জীবনের তাগিদেই নুতন জীবনসাথী খুঁজে নিয়েছে।

অলিভিয়া আর তার ভাই গ্রাম থেকে শহরে এসে চাচার বাসায় থেকে কিছু করার চেষ্টা করছে। অলিভিয়া প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েছে আর ভাই তার আগেই পড়া ছেড়েছে। আমার কাছে ছাড়াও অলিভিয়া আরো দুই জায়গায় কাজ করে। টাকা জমাচ্ছে সে, দুইশ ডলারের সমান টাকা জমলে সে কুকিং স্কুলে ভর্তি হবে। তার এই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমার বেশ ভালো লাগে।

গত বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি হাসিখুশি মেয়েটির মুখ ম্লান। প্রায়ই কাজে ভুল করছে। গত শনিবারে জিজ্ঞেস করলাম, অলিভিয়া, ব্যাপার কি বলতো? ওমা মেয়ে বলে কি, জানি না আমার জীবনে কি হবে? আমি বলি, জীবন তো শুরুই হয় নাই তোমার, এখনি এসব কি কথা! আলাপ করে জানলাম উনিশ বছরের সদ্য তরুণীর কথার মর্মার্থ।

অলিভিয়ার একটা বালকবন্ধু (বয় ফ্রেন্ড) ছিলো, ছিলো বলছি কারণ তার সাথে এখন আর অলিভিয়ার কোনো সম্পর্ক নাই মাস খানেক হলো। এই ছেলেটির জন্য অলিভিয়া টাইটানিক সিনেমার সেই বিখ্যাত গানের রিং টোন সেট করেছিলো। সেটা নিয়ে হেসেছিও আমি। ছেলেটি অলিভিয়াকে ‘চিট’ করেছে।

ঘটনা শুনলাম, প্রায় দুই বছরের সম্পর্ক তাদের, মানে হলো অলিভিয়ার বয়স যখন সতেরো তখন এই ছেলেটির সাথে তার সম্পর্ক হয়। তবে এটি অলিভিয়ার দ্বিতীয় সম্পর্ক। প্রথম সম্পর্ক হয়েছিলো তার তেরো বছর বয়সে। সেটি যে কেনো ভাঙলো তা ঠিক মতন বুঝতে পারলাম না, যেটুকু বুঝলাম যে সেই ছেলেটি অলিভিয়ার সমবয়সী ছিলো।

বর্তমান ছেলেটি ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করে। বেশ কিছুদিন ধরে ছেলেটি অলিভিয়ার ফোন ধরে না, ঠিকমতন কথা বলে না, শনি রবিবারে আসে না দেখা করতে ইত্যাদি। সপ্তাহ দু’য়েক আগে অলিভিয়া গিয়েছিলো তার চাচাতো বোনের বাড়ি বেড়াতে, ফেরার সময়ে দেখে ছেলেটি অন্য আরেক মেয়ের সাথে বসে রেস্টুরেন্টে।

আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম, তুমি কি কিছু বললে তাকে? অলিভিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো, নাহ, আমি তো বুঝেই গেলাম যা বোঝার, জানতে চাইবো কেনো! তার এই ম্যাচিউর জবাবে একটু অবাকই হলাম। এই প্রসঙ্গে জানাই, উগান্ডাতে ছেলে মেয়েরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। উগান্ডান ব্যুরো অফ স্ট্যাস্টিসটিক্সের হিসাবে দেখা যায়, ২৫% মেয়ে আঠারো বছরের আগেই প্রেগন্যান্ট হয়। তার মানে দাঁড়ালো ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে তিন জন টিনেজ প্রেগন্যানসির শিকার। এদের প্রায় ৬৭% সিঙ্গেল মাদার বা বিয়ে না করেই সন্তান ধারন করেছে।

উগান্ডার টিনেজ প্রেগন্যান্সির হার সাব সাহারান অঞ্চলের মধ্যে সবার উপরে। স্বভাবতই অপ্রতুল শিক্ষার হার, দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব সব মিলিয়ে উগান্ডার কিশোরী তরুণী এমনকি বালিকারাও শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই। শহরে এই হার প্রতি ১০ জনে দুইজন আর গ্রামে প্রতি ১০ জনে তিনজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে সন্তানধারন শুরু করে। উগান্ডার জনসংখ্যা বছরে তিন দশমিক ছয় হারে বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশের চাইতে আয়তনে প্রায় দ্বিগুণ দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় চার কোটির কাছাকাছি, আশংকা করা হচ্ছে এই হারে জনসংখ্যা বাড়লে ২০২৫ সালের মধ্যে ছয় কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান জনসংখ্যার ৭৮% তিরিশ বছর বয়সের নীচে আর ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে ৬০%, এর মধ্যে ৫১% নারী। প্রেসিডেন্ট স্বয়ং অনুরোধ করেছেন মেয়েরা যেন আঠারো বছরের আগে সন্তান ধারন না করে আর যেন চারটি সন্তানের বেশি না নেয়। উল্লেখ্য বর্তমানে উগান্ডার দম্পতি প্রতি গড়ে ছয় সন্তান। এদিকে উগান্ডায় এইচআইভি নতুন করে বিস্তার লাভ করেছে। শতকরা ১৪জন এইচআইভিতে আক্রান্ত আর নারীদের মধ্যে এর সংক্রমণ বেশি তাতে স্বাভাবিক ভাবেই এইচআইভি পজিটিভ শিশুর জন্মও বেশি! সব মিলিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী নিয়ে উগান্ডা বেশ বিপাকের মধ্যে আছে।

যাইহোক অলিভিয়ার কথায় ফিরে আসি। আমি বুঝাবার চেষ্টা করলাম যে বয়ফ্রেন্ড ছাড়াও তো জীবন চলতে পারে, এত ঝামেলা নেয়ার দরকার কি? তার অবাক প্রশ্ন, তাহলে উইকেন্ডে আমি টাইম পাস করবো কিভাবে? আমাকে শহরে যেতে হবে, সিনেমা দেখতে হবে, রেস্টুরেন্টে খেতে হবে, একা একা কি কেউ এসব করে? তাইতো, এই মোক্ষম প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে বলি, ‘কেনো অলিভিয়া আমি তো একাই বেশ আছি, তুমি তো দেখো নিজেই বেড়াই, নিজেই রেস্টুরেন্টে খাই, তোমাকেও তো মাঝে মাঝে সাথে নিয়ে যাই, কত আনন্দ হয়!’ অলিভিয়া অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আরো অবাক গলায় বলে, “সেতো আমার মায়া হয় তোমার জন্য তাই যাই, কিন্তু আমি তো তোমার বয়ফ্রেন্ড নই। আর কোনো বয়ফ্রেন্ড নাই কেনো তোমার? নিশ্চয়ই তোমার কোনো সমস্যা আছে! তোমার জন্য আমার খুব মায়া হয়, আহারে কি জীবন!” আক্কেলগুড়ুম আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকি!

2049 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।