লীনা হাসিনা হক

উন্নয়ন কর্মী

পূর্ব আফ্রিকার ডায়রী- ৩

ছোট ছোট চুলে ঢাকা মাথা, কাজল কালো চোখের শীর্ণ বারো বছরের বালিকার দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যিখানে অনন্তবিস্তৃত আকাশের নীচে ছোট্ট মলিন গ্রামের আরো মলিন মাটির ঢিবির মতন ঘরের দাওয়ায় বাঁশের মোড়ায় বসে বসে আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করলো।

গত সপ্তাহে আমাদের একটি প্রকল্পের ফিল্ড অফিসে একটি জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় প্রায় দৌড়ে গেলাম কাম্পালার ১২০ কিলোমিটার উত্তরে কাগাডি জেলায়। উগান্ডাতে অনেক নুতন নুতন রাস্তাঘাট হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক এবং আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে/ঋণে চাইনিজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে তৈরি হচ্ছে এসব রাস্তা। পাহাড়ের বুক চিরে গভীর বনে ঢাকা গ্রাম পেরিয়ে এসব পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে শ’য়ে শ’য়ে কিলোমিটার। এসব রাস্তার কারণে মানুষের চলাচলের সুবিধা হয়েছে, আগে যেখানে পঞ্চাশ কিলোমিটার দুরত্ব পাড়ি দিতে সারাদিন লেগে যেতো এখন এসব রাস্তার কারণে কয়েক ঘণ্টায় পেরোনো যাচ্ছে কয়েক’শ কিলোমিটার। ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার হচ্ছে। গভীর জংগল বা পাহাড়ি জনপদের মানুষ আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পাচ্ছে।

এইসব উন্নয়ন সাথে করে নিয়ে আসছে তথাকথিত আধুনিকতার নানা  উপসঙ্গ। পাহাড়ি এইসব গ্রামগুলিতে হয়তো দশ বারো কি তিরিশ চল্লিশ ঘর পরিবারের বসবাস ছিলো। কৃষিই একমাত্র জীবিকা। দিনের আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষজন নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যেতো। বিদ্যুতের আলো ছিলো না তাই অন্ধকারে ঘোরাফেরা করার তেমন কোনো কারনও ছিলো না। একেকটি গ্রামে হয়তো একটা গোষ্ঠীর মানুষরাই বসবাস করতো।

সাপের মতন হিলহিলে এইসব রাস্তা তৈরি করবার জন্য ঠিকাদারি কোম্পানি ট্রাক বোঝাই করে শ্রমিক নিয়ে এসেছে অন্য জেলা থেকে। তারা অন্য জাতি গোষ্ঠীর লোক, তাদের ভাষা, রীতি নীতি সব আলাদা। এইসব শ্রমিক, যাদের একশত ভাগ পুরুষ, তারা নির্মাণাধীন সড়কের পাশেই ক্যাম্প করে থাকে। সারাদিন কাজ করার পরে, সন্ধ্যায় তাদের অখন্ড অবসর। গ্রামের হাট বাজার যা উগান্ডাতে ট্রেডিং সেন্টার নামে পরিচিত, সড়কের ধার দিয়ে বৈদ্যুতিক বাতির পোল দেখা যায়, তারে বয়ে জলবিদ্যুৎ চলে এসেছে অনেক সেন্টারে, সৌর বিদ্যুতে আলোকিত অনেক সেন্টার। এই শ্রমিকেরা সন্ধ্যায় ভিড় জমায় ট্রেডিং সেন্টারে। হাতে কাঁচা পয়সা। বিনোদনের মধ্যে স্থানীয় বীয়ার আর ভুট্টা থেকে তৈরি মদ। কাঁচা পয়সার একটা ব্যাপার হলো, এর ক্রয় ক্ষমতা প্রায় অসীম এবং অপ্রতিহত।

আধুনিকতার ছোঁয়া বঞ্চিত অভাবী এইসব গ্রামের মেয়েরা প্রায় পতঙ্গের মতন ছুটে এসে আগুনে আহুতি দেয়ার মতন করে এই কাঁচা পয়সার কাছে সমর্পিত হচ্ছে। আমরা উগান্ডা সরকারের রোড অথরিটির সাথে পার্টনারশিপে রোড সেক্টরের সোশ্যাল রিস্ক ম্যানেজ করবার চেষ্টা করছি। উগান্ডাতে, হয়তো পৃথিবীর আরো অনেক দেশেই সড়ক তৈরির সাথে সাথে স্থানীয় জনগণের অধিকার বিষয়ক ব্যাপারগুলির মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা বা জেন্ডার বেইসড ভায়োলেন্স একটা অত্যন্ত প্রকট সমস্যা।

আমার সংস্থা উগান্ডার নির্মাণাধীন তিনটি দীর্ঘতম সড়কের সোশ্যাল রিস্ক মিটিগেট করার কাজে সরকারকে সহায়তা করছে। এগুলো মূলত জনসচেতনতা বৃদ্ধি, কন্সাল্টেশন, স্থানীয় জনগনের সাথে সাথে নির্মাণ কোম্পানীর শ্রমিকদের সচেতন করা, রেপ, এবিউজ, ডিফাইলমেন্ট ঘটলে সেগুলোর জন্য দরকারী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া,  ভায়োলেন্স সারভাইবারদের অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেওয়া, তাদের ট্রেনিং দিয়ে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া, সামাজিকভাবে তাদের যাতে হেনস্থা না করা হয় সেসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা ইত্যাদি।  

নির্মাণাধীন একশত বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ চেনজোজো হোইমা কাগাডি হাইওয়ের ধারের একটি গ্রামের টেডি নামের এই ছোট্ট বালিকা, যাকে নির্মাণ কোম্পানির একজন সিকিউরিটি গার্ড ডিফাইল করেছে। হতদরিদ্র পরিবারের বারো বছরের এই বালিকার নিজের বাবা মারা গেছে, সৎ বাবার সাথে থাকে সে। অভাবের সংসারে পেটভরে খাওয়া মেলে না প্রতিদিন। উগান্ডান টাকায় পাঁচ হাজার শিলিং অর্থাৎ দেড় মার্কিন মুদ্রা বা একশত চল্লিশ বাংলাদেশী টাকা আর এক টুকরা মুরগীভাজার বিনিময়ে আঠাশ বছর বয়সী নিরাপত্তারক্ষী মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। নিরাপত্তা রক্ষী এবং মেয়েটি কেউ কারো ভাষা জানে না, তাতে কি, একদিকে ক্রেতা জানে সে কি কিনতে চায় আর অন্যদিকে পেটের ক্ষুধার তীব্রতার কাছে কোনো বোধ কাজ করে না। বালিকাটি  আঘাত পেয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে, বিষয়টি মায়ের কাছ থেকে লুকাতে চেয়েছে।

মা টের পেয়ে আমাদের মাঠ কর্মীকে জানিয়েছে, ইন্সিডেন্ট রিপোর্ট হয়েছে, ডিফাইলমেন্টের দায়ে রক্ষীটিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, ঠিকাদার কোম্পানির সাথে আমরা বৈঠক করেছি মেয়েটির চিকিৎসাসহ আনুষাঙ্গিক  ব্যয় এবং জরিমানা আদায়ের জন্য। ভাগ্য ভালো যে লোকটির এইচআইভি পজিটিভ নয়। ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল, পুলিশ, সিআইডি, সড়ক অথরিটি, ঠিকাদার কোম্পানি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা সবাই মোটামুটি সন্তুষ্ট যে ব্যাপারটার সুরাহা করা গেছে, মিডিয়াকে ডেকে প্রেস ব্রিফিং করা হয়েছে।

আমার কেবলি কেমন লাগছিলো। সবকিছুর শেষে, গেলাম মেয়েটির বাড়িতে। শুকনো প্যাঁকাটি প্রায় ন্যাড়া মাথার বালিকাকে পাশে বসিয়ে জানতে চাইলাম, সে ঠিক কি কারণে ব্যাপারটিতে রাজি হলো। মাথা নিচু করে পা দিয়ে মাটি খুঁটতে খুঁটতে নিজের ভাষায় কিছু বললো সে। আমার মাঠকর্মী অনুবাদ করে দিলো, “ক্ষুধা ছিলো অনেক, দুদিন ধরে এক টুকরো ইয়াম (এক ধরনের শেকড়) ছাড়া আর কিছু খাইনিতো। আর মুরগীর মাংস শেষ কবে খেয়েছিলাম মনে করতে পারি না, লোকটি বলেছিলো কিছু হবে না বরং আমি টাকা পাবো আর মুরগীর মাংস খেতে পারবো।!’ 

আমার কেমন লাগে সে আমিই জানি, হাত ধরি টেডির, সারা শরীরের মধ্যে তার ডাগর চোখগুলিই কেবল নজরে আসে, সেই চোখ তুলে আমার দিকে চায় সে। আমি তার চোখের তারায় ধিক্কার দেখি, যেন সে আমাকে বলে, “মুজুঙ্গু (বিদেশী) কি সোশ্যাল রিস্ক ম্যানেজ করো তোমরা, পেটের ক্ষুধার কষ্টের কাছে আর কোনো কষ্টই কষ্ট নয়!”

ফিরতিপথে আমার পা চলে না, মন টানে না, চোখ জলে ভরে উঠে, খালি মনে হতে থাকে পভার্টি ইজ দি ওয়ার্স্ট ফর্ম অফ ভায়োলেন্স ইন হিউম্যান বিয়িংস লাইভস!

2146 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।