সত্যি বলতে আমি শনিবারের অপেক্ষায় থাকি কেবল উইকএন্ড বলে নয়, অলিভিয়ার সাথে কিছু সময় কাটানোর চিন্তা আমাকে বেশ আনন্দিত করে। শনিবারে সে আসে একটু দেরী করে আটটার দিকে।
আজ দরজা খুলে দেখি অলিভিয়া জ্যাকেটে মুড়ে এসেছে। উগান্ডায় বর্ষা শুরু হয়েছে, চির বসন্তের এই দেশে বৃষ্টি প্রায় সারা বছর ধরে হয় কিন্তু মার্চ থেকে জুন আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই দুই দফায় নিয়মিত বৃষ্টি হয়। গত বছর তুলনামূলকভাবে ড্রাই ছিলো, এবছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এমন বর্ষা শুরু হয়েছে যে মনে হয় বাংলাদেশের বর্ষাকেও ছাড়িয়ে যায়।উগান্ডাতে তাপমাত্রা এমনিতে বেশ আরামদায়ক মোটামুটি ১৮ থেকে ২৬ এর মধ্যে উঠা নামা করে কিন্তু বৃষ্টির সময় নেমে যায় ১৫-১২তে আর আফ্রিকার বৃষ্টির সাথে একটা কনকনে হাওয়া আসে যেটা কাবু করে ফেলে। অলিভিয়াকে দেখে হেসে ফেলি আমি, এতো ঠাণ্ডা নাকি? অলিভিয়া রাগ দেখিয়ে বলে, বাইরে গিয়ে দেখো! তোমাকে তো আর বৃষ্টি মাথায় সাত সকালে হেঁটে হেঁটে কাজে আসতে হয় না, গাড়িতে যাও, তাই বোঝো না!’ আমি খানিক থমকে যাই, তাইতো, হাসা অন্যায় হয়েছে আমার। কিন্তু এই কথাতে তো অলিভিয়ার মেজাজ এতো গরম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কিছু বলি না, চুপচাপ কফি বানাই, নিজেরটা কালো আর অলিভিয়ার জন্য দুধ চিনি দিয়ে (এসব সময়ে আমার ঢাকার বাসার সহকারী সাহেরার কথা মনে পড়ে যায়। সাহেরা দুধ চিনিতে ডুবিয়ে চা পান করতে ভালোবাসে!)। দেশ থেকে আনা টোস্ট বিস্কুট দেই, অলিভিয়া খাবে না, তার খেতে ইচ্ছে করছে না। ডেকে বলি, ও অলিভিয়া, আসো তো বাছা, বসো এখানে, কফিতে চুমুক দাও আর বলো কি হয়েছে, মেজাজ কেনো এতো তিরিক্ষি আজ?
গত রাত থেকে অলিভিয়ার মাসিক শুরু হয়েছে। অনিয়মিত মাসিকের নানা ধরনের যন্ত্রনায় মেয়েটি ভোগে, স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারের কাছে সে কোনোদিনই যায় নাই। এর আগে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিলাম, কিছুটা ভালো ছিলো সে। কিন্তু আবার মাসিকজনিত প্রচন্ড পেট ব্যথা, বমি ভাব, খাওয়ার অরুচি, মাথা ব্যথা সব ফিরে এসেছে। সবথেকে বেশি কাতর করে তাকে প্রচন্ড পেটব্যথাসহ ক্র্যাম্প বা খিঁচুনি। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে, তাকে তো এই সময়ে প্রায় কোলের মধ্যে নিয়ে রাখতাম। অলিভিয়াকে বলি, আজ আর কাজ করতে হবে না। ব্যথা কমার জন্য ওষুধ দেই আর বলি বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে বা ইচ্ছা করলে আমার এখানেও থেকে যেতে পারে। গরম জলের সেঁক নিতে পারে, আমি বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
আমার সংস্থা উগান্ডায় কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয়াদি নিয়ে কাজ করে সেই কারনেই উগান্ডার কিশোরীদের মাসিকজনিত স্বাস্থ্য বিষয়ের মোটামুটি চিত্র জানা আছে। শতকরা ২৪% হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর এই দেশে পরিবারগুলি যেখানে দুইবেলা খাওয়া জোটাতেই হিমসিম খায়, সেখানে কিশোরীদের মাসিকজনিত স্বাস্থ্য কোনো প্রায়োরিটিতেই পড়ে না। গড়ে ছয় সদস্যের পরিবারগুলির যেখানে দুইবেলা খাওয়ার সংস্থান করতে মাসে বারো ডলারের একটু বেশি খরচ করতেই পরিত্রাহি সেখানে প্রতিমাসে কিশোরীপ্রতি স্যনিটারি ন্যাপকিন কেনার জন্য দেড় ডলার খরচ করার চিন্তা করতে পারে না। আরো উল্লেখ্য যে শতকরা ৬০% শতাংশ কুড়ি বছর বয়সের নীচের তরুণ জনগোষ্ঠীর ৫০% কিশোরী তরুণী, সেই হিসাবে প্রতি পরিবারে দুই থেকে তিন জন বয়সন্ধিকালীন মেয়ে আছে। সম্প্রতি এক সার্ভেতে জানা যায় যা, স্কুল টার্মের ৮০ দিনের মধ্যে ২৯ দশমিক সাত শতাংশ কিশোরী মাসে কমপক্ষে চার দিন স্কুল কামাই করে মাসিকজনিত কারণে। এইদিনগুলিতে পরীক্ষা বা জরুরি ক্লাস থাকলেও তারা স্কুলে আসে না। শতকরা ২৫% মেয়ে জানিয়েছে মাসিকের ব্যাপারটি একটি ভয়ানক ট্যাবু, এমনকি এমনও হয়েছে স্কুলচলাকালীন কোনো কিশোরীর হয়তো মাসিক শুরু হয়েছে আর তার জামায় রক্ত লেগে গেছে, সেই মেয়েটিকে নিয়ে এমন হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপ করা হয়েছে যে বেচারা স্কুল ড্রপ আউট হয়েছে। উল্লেখ্য উগান্ডায় শতকরা ৮০ ভাগ স্কুল কোএডুকেশন। সরকারের তরফ থেকে যদিও স্কুলগুলোতে সরকারী খরচে স্যনিটারি ন্যাপকিন দেয়ার জন্য জাতীয় বাজেটেই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে কিন্তু নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এবং দুর্নীতির কারণে মেয়েদের স্বাস্থ্যখাতের এই বরাদ্দ নয়ছয় হচ্ছে। আমার সংস্থার মতন আরো যারা এই বিষয়ে কাজ করেন, সবাই মিলে সরকারের কাছে স্বারকলিপি দেয়ার পরেও কাজ তেমন হয় নাই। ইন্ট্রাহেলথের এক রিপোর্টে দেখা যায়, মাসিকের সময় ছেঁড়া অপরিষ্কার কাপড়, ময়লা ত্যানা, গাছের পাতা এমনকি চুলার ছাই ব্যবহার করার কারনে বড় একটি অংশ নানা ইনফেকশনের শিকার হয়ে এমনকি প্রজনন ক্ষমতা হারাবার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। স্কুলগুলিতে গেলে বাচ্চা মেয়েরা অনুরোধ করে তাদেরকে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিতে, এমনকি অনেকে বলে, তাদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে হলেও যেন ন্যাপকিন দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
আমার সংস্থা বলতে গেলে গাঁটের পয়সা খরচ করে কিছু কিছু স্কুলে স্যানিটারি ন্যাপকিন সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে। এখন অবশ্য আফ্রিপ্যাড নামে একটা প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে রিউজেবল ন্যাপকিন দেয়া হচ্ছে। তবে অনেক জায়গায় এসব ন্যাপকিন পরিষ্কার করার জন্য সাবান আর জলের ব্যবস্থার অপ্রতুলতা একটা স্বাস্থ্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আমরা অবশ্য স্কুলের টিচারদেরকেও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রোগ্রামের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।
যেসব মেয়েদের মাসিকের সময় অলিভিয়ার মতন নানা উপসর্গ দেখা দেয়, এখনো গ্রামীণ জনপদে তাদেরকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয় কারণ একমাত্র ভূতপ্রেত বা অতৃপ্ত কোনো আত্মা ওই মেয়েটির উপরে ভর করেছে এমন বিশ্বাস করা হয়। উগান্ডাতে মেয়েদের মাসিকবিষয়ক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঝুঁকি গুলি মূলত কালচারাল যেখানে মাসিক অবস্থায় মেয়েদেরকে অপবিত্র মনে করা হয়, স্বাস্থ্যবিধি না জানা বা জ্ঞানের অভাব, স্যানিটারি ন্যাপকিনের অপ্রতুলতা, সবার উপরে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্যের অভাব।
মাসিকজনিত উপসর্গের কারণে অলিভিয়াকে দুইবার ওঝার কাছে নেয়া হয়েছিলো। সেই গল্প যতটুকু শুনেছি, তাতে গা শিউড়ে উঠবার মতন ঘটনা। প্রথমবার তাদের গ্রামের নারী ওঝা তাকে অনেক পিটিয়েছে যাতে অশুভ আত্মা তাকে ছেড়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় দূরের গ্রামের পুরুষ ওঝা তার নাকে কোন শিকড়বাকড়ের ধোঁয়া দিয়ে ভূত তাড়ানোর চেষ্টা করেছে। সেই দ্বিতীয় ওঝার কাছে মেয়েটি ছিলো দুরাত, এবং ঘটনা শুনে আমার কেবলি মনে হচ্ছে বোকা মেয়েটি বুঝতেই পারে নাই বদমাশ ওঝা তাকে ধর্ষণ করেছে।
আমার কাছে কাজে আসার আগে পর্যন্ত অলিভিয়া কোনোদিন দোকান থেকে কিনে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে নাই। করবেই বা কেমনে! একটি গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের পক্ষে তাদের ১০% রোজগার স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য খরচ করার কল্পনাতেই আসে না। অলিভিয়াও ছেঁড়া নোংরা কাপড় ব্যবহার করেছে এতদিন, সেগুলো পরিষ্কার করে সাবান জলে ধুয়ে রোদে শুকানোর কোনো ব্যবস্থাও নাই তার বাড়িতে। বিকালে ডাক্তার জানালো মেয়েটি ক্রমাগত অসাস্থ্যকরভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজ) করেছে বছরের পর বছর আর ফলশ্রুতিতে এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন হয়েছে তার। ভাবছি, আগামীবার মেয়েটির এইচআইভি টেস্টটা করিয়ে নিবো, কে জানে কি অবস্থা! ডাক্তার ওষুধপাতি দিলো কিছু, আমি গোটা দুই প্যাকেট ন্যাপকিন কিনে দিলাম। ফেরত আসার সময়ে সে আমার হাত ছুঁয়ে বলে ওঠে, ‘জানো, আমি কোনোদিন এসব কথা কারো সাথে বলি নাই, আমার যখন মাসিক শুরু হলো তখন আমার মা নয়, চাচাতো বোন কিছু শিখিয়েছিলো। গ্রামে থাকতে গাছের পাতার ভেতরে ছাই ঢুকিয়ে আমরা ব্যবহার করতাম, খুব চুলকাতো আর জ্বালা করতো। আমি ভেবে নিয়েছিলাম এটাই জীবনের নিয়ম। তুমি না জানালে আমি এত কিছু জানতাম না। আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারো না যখন তুমি চলে যাবে?’! আমি এই কথার উত্তরে তাকে ওষুধের ব্যবহারবিধি বোঝাতে শুরু করি।