রাজুময় তঞ্চঙ্গ্যা

হিল ব্লগারস এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্টস ফোরাম অফ সিএইচটি' র সদস্য।

প্রতিটি হত্যায় নেতৃত্বশুণ্য হচ্ছে পাহাড়!

১.
পাহাড়ে আরেকটি প্রাণ ঝড়ে গেলো, আরেকজন নারী বিধবা হলেন, সন্তানেরা বাবা হারা হলেন। এসব কথা বলতে, শুনতে কত সহজ! সহজ বোধহয় এই কারণে, মৃত্যু উপত্যাকায় এসব প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।

ইদানিং নিজের কাছেও কেমন জানি স্বাভাবিক, সহজ মনে হয়। পাহাড়ের কত হত্যার, ধর্ষণের কথা বলবেন আপনি? কথা বলে প্রতিবাদ করে ফলটা হয়েছে কি? কার কাছে বিচার চাইবেন, কার কাছে প্রতিবাদ করবেন? পাহাড়ের মানুষজন বিভাজনে বিভাজনে বিভাজিত। অপ্রিয় নিখাঁদ সত্য পাহাড়ে মদের টেবিলে যে সংখ্যক মানুষজন পাওয়া যায়, একজন মানুষ হত্যার প্রতিবাদে এত সংখ্যক মানুষ হয় না। কেনো হয়না?
চরম হতাশার কথা হলেও বলে দিলাম।

২.
পাহাড়ে প্রতিটি খুনে কোননা কোনো দল বগল বাঁজায়, ইহি জোক- ইহি জোক বলে। আপনাদের একটা কথা বলে রাখি, একদল কিন্তু প্রতিটি খুনেই বগল বাজায়, নীরবে শকুনি হাসি দেয়। নিশ্চয়ই বলতে হবে না তারা কারা, কারা সে দল। যেই খুন হোক, প্রতিটি খুনেই অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে পাহাড়ের। পাহাড়'ই এ দায় বয়ে বেড়াবে। এবং এ ক্ষতি'র প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে পাহাড়ের প্রতিজন সন্তানের এবং তা বিভিন্ন ভাবে, হতে পারে বঞ্চনায়, ধর্ষণে, উদ্বাস্তু হয়ে, হতে পারে পোড়া আগুনে, ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা হয়ে বেঁচে এবং অবশেষে অস্তিত্ব হারিয়ে।

সে যা হোক, সামনে যে সময় বড্ড অসময় তা সহজে অনুমেয়।

৩.
আপনাদের কি মনে হয় একজন সুদীর্ঘ, একজন মিঠুন বা একজন শক্তিমান চাকমা মারা গেলে বা মেরে ফেললে প্রতিশোধ গ্রহণসহ সবকিছু শেষ হয়? আপনাদের কি মনে হয়, কাল সময় যুগে যুগে সুদীর্ঘ, মিঠুন কিংবা শক্তিমান চাকমাদের গড়ে দেয়, দিচ্ছে পাহাড়ের জন্য? পাহাড়ের সন্তান হিসেবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, পাহাড়ের অধিকজন মানুষ মানসিক ব্যাধিতে ভোগা একেকজন নিকৃষ্ট দালাল। 

এই গ্রহ'ই সবচাইতে বড় প্রমাণ, যে নিজেদের স্বার্থের জন্য, সামগ্রীক কল্যাণের জন্য একতা, সমতা গড়ে নিতে। আমরা জার্মানি দেখেছি, ভিয়েতনাম দেখেছি, হালের কোরিয়া দেখছি। আমাদের পাহাড় তার চাইতেও বেশিকিছু, তাই আমরা পারি না। আমরা একেকজন বুজনেওয়ালা আবাল পাবলিক, আমরা একেকজন ঝানু রাজনীতিবিদ যে এক টেবিলে বসতে পারি না, আমরা একেকজন বিক্রিত মাল। আমরা এতই এতই পাকা অধিকার আন্দোলন কর্মী যা প্রতিপক্ষ চিনে উঠতে পারি নি এখনো। হয়তো আন্দোলনের এজেন্ডাও ঠিক করতে পারি নি। 

একেকজন হত্যায় শুধু পরিবার অভিভাবক হারাচ্ছে তা নয় পাহাড় হারাচ্ছে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, প্রকৃত অভিভাবকদের।

মিঠুন দা ঢাকা ভার্সিটির মেধাবী ছাত্র ছিলেন, আজ যিনি খুন হলেন তিনিও ছিলেন ঢাকা ভার্সিটি পড়ুয়া একজন। একেকজন হত্যায় আপনি কি হিসাব মেলান? নিশ্চয়ই অনেকেই বলবেন উইকেট পতন বা অনেকেই শহিদ বলে ফুলের তোড়া মুড়িয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের মন্ত্রণা নেয়ার তোড়জোড় শুরু করছেন!

আমি ভাবছি এই যে একেকজন মানুষকে ঘিরে পরিবার দূরে থাক কিছু সাধারণ মানুষদের যে বলয় ছিল, সন্তান ভরণপোষণ, পড়ালেখা করানোর যে আস্থা অবলম্বন ছিলো তাঁদের কি হবে? 

আমি জানতাম মিঠুন দা খুব নীরবে অনেকজন শিক্ষার্থী'র পড়ালেখার খরচ চালাতেন, অনেকের সংসার চালানোর ন্যুনতম খরচ যোগাতেন। ঠিক তেমনি আজ যিনি খুন হলেন তার ব্যাপারে একই রকম খবর শুনেছি। আমি নানিয়ারচরে প্রায় ৫৬টি পাড়ায় ঘুরেছি। আমার কৌতুহলী মন সবসময় কিছু না কিছু জানার, শেখার, বুঝার চেষ্টা করেছে। আমি অনেকজনের কাছে শক্তিমান চাকমার কাছ থেকে সরাসরি সহযোগিতা পাওয়ার কথা শুনেছি।

এখন বলুন আপনি আবাল কারোর জন্য কিছু করেছেন? করছেন?

৪.
নানিয়ারচর বাজার বা উপজেলাটি কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ঘেরা। প্রতিটি পাড়া, বাজার দেখতে মনে হয় এক একটা দ্বীপ। মুল বাজারটি খুব বেশি বড়ও নয়। শক্তিমান চাকমা আজ যেখানে খুন হয়েছেন তার খুব কাছেই আমি মাসখানেক ছিলাম। সেখান থেকে থানা বা আর্মি ক্যাম্প খুব খুব নিকটে। এমন একটা জায়গায় দিনে দুপুরে মানুষ খুন হয়! ভাবছি, ভেবে চলেছি। খুন করার পর খুনি কিভাবে পালায়? মূল রাস্তায় এক পাশে আর্মি ক্যাম্প, অন্য পাশে থানা।

ভাবছি! সব হত্যায় খুব স্বয়ংক্রিয় ভাবে অন্যরকম গন্ধ চলে আসে।

৫.
আমি ইদানিং খেয়াল করছি, পাহাড়ে আগে নেতিবাচক ঘটনার জন্য অনলাইনে সামাজিক দুনিয়ায় যত প্রতিবাদ, লেখালেখি হতো এখন ততটুকু হয় না, হচ্ছে না। কেনো? এসব খুন কি প্রতিবাদে স্থবিরতা এনে দিচ্ছে না? এতে লাভ হচ্ছে কার? কাদের এজেন্ডা নীরবে বাস্তবায়ন হয়ে চলেছে? তরুণ প্রজন্ম কেনো প্রতিবাদে বিমুখ হচ্ছে? ভাবুন ভাইলোক ভাবুন।

৬.
সব মৃত্যু বেদনার, হারানোর। এমন হত্যা, মৃত্যুতে আমি কোনোমতেই বিজয় দেখি না। আমি দেখি অশনি সংকেত।

1599 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।