প্রতিভা রানী

প্রবাসী প্রতিভা রানী পেশাগত জীবনে বাংলাদেশে একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বিয়ে নয়, নারীর মুক্তি স্বাবলম্বনে

বিয়ে একটা সামাজিক মর্যাদা বা স্বীকৃতি মাত্র। দু'টি মন যখন এক হয়ে যায় তখনই তাদের বিয়ে হয় তার আগে নয়। কিন্তু তার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময়টা না হলে অনেক সময় মানুষের জীবন ভুল রাস্তায় চলে যায়। যেখান থেকে অনেকেই ফিরে আসতে পারে না। আর এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলে মেয়েই, বিশেষ করে মেয়েরা এর শিকার। কারণ তাদের উপর পরিবার তথা সমাজের একটা মিথ্যা সম্মানের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়।

আরো পরিস্কারভাবে বলি, মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই এমনভাবে মগজ ধোলাই দেয়া হয়, তুমি মেয়ে এটা করতে পারবে না, ওটা করতে পারবে না। অনেকে মেয়েই পরিবারের কথা ভেবে নিজের পছন্দের বাইরে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। আমি বলছি না, পারিবারিকভাবে সব বিয়েই খারাপ হয়। কোনো বাবা-মা চায় না তার সন্তান অসুখী হোক। তারপরেও বাবা মায়ের উচিৎ ছেলে মেয়েদের মানসিক অবস্থা যাচাই করা। কারণ সংসার করবে ছেলে কিংবা মেয়ে, বাবা-মা কিংবা পরিবার নয়।

তাই প্রথমত সন্তানকে প্রায়োরিটি দিতে হবে সংগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে। মিথ্যে সমাজের দোহাই দিয়ে সন্তানদের অসুখী জীবন যাপনে বাধ্য না করানোই ভালো। সমাজতো সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পারে, মনের স্বীকৃতি দিতে পারে না। দু'টি মনের মিলন যদি না হলো সেখানে সম্পর্ক টিকে কিভাবে? অহেতুক বিয়ে নামের বোঝা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। বিয়ের আগে উভয়ের অতীত সম্পর্কে জেনে নেয়া ভালো।

পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক যৌতুকলোভী পরিবার আছে যারা যৌতুকের আশায় ছেলেকে বিবাহ দেন এবং বিয়ে পরবর্তী সময় আবারও যৌতুকের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অধিকাংশ সময়ই এর পরিণতি হয় আত্মতহ্যা নয়তো মার্ডার। যৌতুক একটা সামাজিক ব্যধি। এই ব্যাধি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে। বিত্তবান থেকে সমাজের নিম্ন আয়ের সব জায়গায় যৌতুক চালু রয়েছে।

স্থান কাল পাত্রভেদে যৌতুক চাওয়ার ধরণ ভিন্ন। বিত্তবানেরা বলেন বৌকে সাজিয়ে দিতে হবে, আর নিম্ন আয়ের লোকেরা সরাসরি টাকা গয়না-গাটি চায়। আর যদি দূর্ভাগ্যবশত কোনো মেয়ের গায়ের রং শ্যামবর্ণ বা কালো হয় তাহলে তো কথাই নেই। গায়ের রঙকে পুঁজি করে পাত্রপক্ষ একটা ফায়দা লুটতে চায়। মেয়ের পরিবারের সামর্থ্য কতটুকু সেটা বিবেচনা করার সময় পায় না, যেন টাকা দিলেই কালো মেয়ে ফর্সা হয়ে যাবে। আর ওদিকে বেচারী মেয়ে নিজের কালো রঙটির জন্য নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে থাকে।

বাবা মা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, পারলে ঘটি বাটি সব বিক্রি করে দেন মেয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। আদৌ ক'জন সুখী হয়? যৌতুক নেয়া যেমন অপরাধ তেমনি দেয়া সমান অপরাধ। কিন্তু কি করবে হতভাগ্য বাবা-মা। যৌতুক ব্যাধি যে ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ। ক্যান্সারের টিকা যদি বা আবিস্কার হয়েছে যৌতুকের টিকা অদ্যাবধি আবিস্কার হয় নি। আমি  দেখেছি অনেক মেয়ে আছে যারা শিক্ষা-দীক্ষা, নাচে-গানে অনেক পারদর্শী কিন্তু, গায়ের রঙ  শ্যামলা বা কালো। শুধুমাত্র গায়ের রং কালো বলে অনেক পাত্রের বাবা মা কিংবা স্বয়ং পাত্র বেঁকে বসেন। হয়তো এমনও দেখা যায় যে ওই মেয়েটা অনেক ফর্সা মেয়েদের (মতান্তরে সুন্দরী) চাইতেও আকর্ষনীয়। কিন্তু ওই যে আমাদের মাথায় গেঁথে আছে ফর্সা না হলে আবার সুন্দর হয় কিভাবে? শুধুমাত্র গায়ের রং দিয়ে সৌন্দর্য বিচার করা হয়, বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে। এই ধরণের বিয়েতে মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হীনমন্যতায় ভোগে।

শ্যমলা বা কালো মেয়েদেরকে উঠতে বসতে শুনতে হয়, “তোমাকে বিয়ে করে তোমাদের পরিবারকে উদ্ধার করেছি। চাইলে তোমার চেয়ে আরও ভালো মেয়ে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে পারতাম”।

তাই বাবা মায়ের উচিত মেয়েকে শিক্ষিত সাবলম্বী করে গড়ে তোলা। যাতে সে কারো বোঝা না হয়। এমন একজন কেউ অবশ্যই আছে যে বোঝা না মনে করে প্রকৃত বন্ধুর মতো হাতটি বাড়িয়ে দেবে। আর চোখ বুঝে নির্দ্বিধায় তার হাত ধরা যায় সারা জীবনের জন্য। হয়তো একটু দেরী হবে সেই হাতটির জন্য কিন্তু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সারাজীবন আফসোস করতে হবে না।

আর যদি অপরিণত বয়সে বিয়ে দেয়া হয় তাহলে তার দায় সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তাই বাবা মায়েদের বলছি, ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত সাবলম্বী করে গড়ে তুলুন। তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য গড়তে পারবে, জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে পারবে। বিশেষ করে, মেয়েদের বোঝা মনে না করে তাদেরকে সাবলম্বী করে গড়ে তুলুন, তাহলেই যদি মুক্তি মিলে।

 

2373 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।