চৈতি চন্দ্রিকা

লেখক এবং এক্টিভিস্ট।

প্রতিশোধপরায়ণতা নারীবাদ নয়

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনে ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থী তার প্রাক্তন প্রেমিককে ছুরিকাঘাত করে। নিউজটি যখন প্রথম শুনি, খেয়াল করে দেখি মেয়েটিকে সাবাস বলা হচ্ছে, বাহবা দেয়া হচ্ছে। পুরুষদেরকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে যে, প্রতারণা করলে এরপর থেকে তাদেরকে কোপ খেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়েছিলো এখন থেকে প্রায় আট বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা। ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের চোখ তুলে নিয়েছিলো তার স্বামী প্রতারণার অভিযোগে। আমি তখন ঢাকাতে মেডিকেল ভর্তি কোচিং এর জন্য ছিলাম। আমার রুমমেটদের অভিমত ছিলো, পুরুষ মানুষ রাগের চোটে এরকম কাজ করে ফেলেছে। তারা কাজটাকে সমর্থন করছে না, কিন্তু ভদ্রমহিলারও দোষ আছে। আমি প্রতিবাদ করায় আমায় ধমক দিয়ে সিনিয়র রুমমেট বলেছিলেন, ‘তুমি দুইদিন ঢাকায় আসছো। তুমি কি জানো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কত খারাপ জানো?’ উত্তর দেই নি আমি। এজন্যে না যে উত্তর ছিলো না। এজন্যে যে অন্ধকে চাঁদ দেখাবার চেষ্টা করে কোনো লাভ হয় না। আর বড়দের সাথে তর্ক করতে না পারাও একটা কারণ ছিলো।

তো প্রথম যে পোস্টটি থেকে এই নিউজটি চোখে পড়লো সেখানে সংক্ষেপে জানালাম যে, তাহলে রুমানা মঞ্জুরের স্বামীর কাজকেও সমর্থন করতে হয়। তার কিছুক্ষণ পর দেখলাম, বাহবা প্রদানকারীরা দাবি করছেন ছেলেটি মেয়েটিকে উত্যক্ত করতো। মেয়েটি আত্মরক্ষার্থে একাজ করেছে। এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন থাকে। সেই মুহূর্তটিতে ঘটনার আকস্মিকতা এবং ভয়াবহতা কেমন ছিলো, মেয়েটি ওই মুহূর্তে পথচারী কারো সহায়তা চেয়েছে কিনা, যদি দীর্ঘদিন ধরে ছেলেটি উত্যক্ত করে তবে মেয়েটি এর আগে আইনের আশ্রয় নিয়েছিলো কিনা, মেয়েটির ব্যাগে ওই মুহূর্তে ছুরি কিভাবে আসলো ইত্যাদি আরও অনেক প্রশ্ন। ঠিক করলাম সেগুলোর উত্তর পাওয়ার আগেই মেয়েটির পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়াটা বা একতরফা মন্তব্য করাটা ঠিক হবে না। কারণ যদি মেয়েটি নিরুপায় হয়ে আত্মরক্ষার্থে কাজটি করে থাকে তবে তার বিপক্ষে অবস্থান নেয়াটা মেয়েদের আত্মরক্ষায় সাহসী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় হয়ে উঠবে। কমেন্টটি নিজেই ডিলিট করলাম।

আমরা বেশির ভাগ মানুষ খবরটা জানছি নিউজ মিডিয়া গুলো থেকে। কিন্তু কোন মিডিয়াকে বিশ্বাস করবো? না, তথ্যের ঘাটতি মেনে নেয়া যায়, কিন্তু সম্পূর্ণ দু’রকম ভাবে খবরটা উপস্থাপন করা হয়েছে। একটিতে ছেলেটির বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে। আরেকটিতে বলা হয়েছে, ‘মেয়েটি দাবি করেছে সে ইডেন কলেজের ছাত্রী।’ তার মানে মেয়েটি আসলেই ইডেন কলেজের ছাত্রী কিনা সে বিষয়ে রিপোর্টার স্বয়ং নিশ্চিত নন। এই রিপোর্টার দাবি করেছেন, মেয়েটির সাথে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ছেলেটি মেয়েটির মোবাইল কেড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। তখন মেয়েটি পেছন থেকে ছুরি চালায়। আরেকটি নিউজ মিডিয়াতে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে পাওয়া ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। এই নিউজটা সবথেকে নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে আমার কাছে।

সবগুলো মিডিয়া বলছে, ছেলেটিকে পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছিলো। সুতরাং মেয়েটির জীবন মরণ সংশয় যে ছিলো না এটা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত। দ্বিতীয়ত মেয়েটি ভ্যানেটি ব্যাগে করে ছুরি নিয়ে এসেছিলো। প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, মেয়েটি পালিয়ে যাচ্ছিলো। তাকে আটকে ফেলার পর পালাতে না পেরে মেয়েটি ছেলেটিকে ছিনতাইকারী বলে দাবী করে। সুতরাং ভালোবাসা থেকে মাথা গরম করে ঘটিয়ে ফেলা ঘটনাও এটা নয়। হ্যাঁ যদি তাও হতো তবু আমি কখনোই মেয়েটিকে সমর্থন করতাম না। মেয়েটি আত্মরক্ষার জন্য কাজটি করে নি। ব্যস, মেয়েটির পক্ষে দাঁড় করানোর আর কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না।

যেহেতু এখনো অব্দি মেয়েটির কোনো ক্ষমতাসীন আত্মীয়ের খোঁজ পাওয়া যায় নি, সুতরাং পুলিশ সঠিক তদন্তই করবে আশা করা যায়। এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া, সেই পুরনো ভিকটিম ব্লেইমিং।

বেশ কয়েকজন নারীকে ভীষণ আক্রমণাত্মকভাবে বলতে দেখলাম, দু’বছর যাবত মেয়েটি ও ছেলেটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাকি ছেলেটি মেয়েটিকে ভোগ করেছে। ছেলেটি এখন বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। তাই ছেলেটির উচিত সাজাই মেয়েটি দিয়েছে।

এক, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে! তার মানে মেয়েটির অনিচ্ছায় কিছু হয় নি। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়ায় সে রাজি হয়েছে। তাহলে ভোগটা ছেলে একা কিভাবে করলো? মেয়েটির কি বিষয়টি ভাল লাগে নি? তাহলে সে না বলতে পারতো। সে না বলে নি। সুতরাং তার সম্মতি ছিলো এবং সেও উপভোগ করেছে।

দুই, মেয়েটি যদি এতই দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হয়, তার যদি এরকম সংস্কার থাকে যে কেবলমাত্র স্বামীর সঙ্গেই সে ঘনিষ্ঠ হতে পারে, তবে সে বিয়ে অব্দি কেনো অপেক্ষা করলো না? বিয়ে তো হয়নি তাহলে সে কেনো রাজি হয়েছিলো?  

তিন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছেলেটি বিয়ে করতে চাইছে না। প্রতারণা অবশ্যই। তার শাস্তি মৃত্যু কিভাবে? বিবাহিত দম্পতিরও বিচ্ছেদ হয়। তারা একে অপরের প্রতি আগ্রহ হারায়। আজ যে ভালোবেসে কথা দিচ্ছে কালও যে সে ভালোবাসবে এই নিশ্চয়তা তাকে কে দিলো। আজকের দিনে কি আমরা সব প্রতিশ্রুতি আসলেই রাখতে পারছি? বাবা-মাও তো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। বন্ধু ভঙ্গ করে। সন্তান ভঙ্গ করে। শুধু এই একটি সম্পর্কেই কেনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সাজা মৃত্যু হয়ে যায়?

তাহলে যে সব নারী আর্থিক অনিরাপত্তা থেকে বহু বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে অপেক্ষাকৃত লাভজনক বিয়ে করতে যাচ্ছে, তাদেরকেও তাদের প্রেমিকরা কি কোপাবে? যে মানুষটি সাথে থাকতে চাইছে না, তাকে জোর করে বেঁধে রেখে লাভটা কি? একটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে তার বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়ার তুমি কে বইন? মানুষটি খারাপ। তুমি তার সাথে থেকো না। নারী-পুরুষ, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী সকলের ক্ষেত্রেই এই একই কথা প্রযোজ্য। তুমি কাউকে বাধ্য করতে পারো না তোমার সাথে থাকার জন্য।

এইসব নারীরা সেইসব পুরুষের মস্তিষ্ক বহন করে যারা বদরুলের প্রতি সহানুভূতিতে আকুল হয়ে গেছিলো। কোনোভাবে সমাজের অধিপতি যদি নারী হতো, তাহলে এই সব নারীরাই ওই পশুরুপী ধর্ষক পুরুষদের ন্যায় আচরণ করতো। এরাই সুবিধামত কখনো নারীবাদীর ভেক ধরে,আর কখনো পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে, যখন নিজের সুবিধার পাল্লাটা যেদিকে। এরাই নিজের ভাই, স্বামী, পুত্র ধর্ষক হয়ে উঠলে মেয়েটির পোশাক নিয়ে আলোচনা করবে আর নিজে তার পার্টনার কে প্রতারণা করার পর বলবে, পরকীয়া নয়, স্বকীয়া করি। এরাই ঘরের পুরুষটিকে খুশি করতে বলবে, নারীবাদী নই আমি, আমি মানবতাবাদী।

4010 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।