
আমাদের উপমহাদেশে গর্ভবতী তবু খানিকটা গুরুত্ব এবং যত্নআত্তি পেয়ে থাকেন, কিন্তু চরম অবহেলার শিকার হন প্রসূতি, যেখানে সদ্যপ্রসবিনীর যে যত্ন দরকার তা গর্ভাবস্থার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। প্রথমত তার নিজের শরীরের ওপর দিয়ে গর্ভবহন ও প্রসবের মতো গুরুতর বিষয়ের ধকল যায় সদ্য, তার ওপর ন্যূনতম ছয়টি মাস সদ্যোজাতকে কেবল মাতৃদুগ্ধের ওপর রাখাই চিকিৎসকরা উত্তম বলে থাকেন। এই দুই কারণেই প্রসূতি মায়ের পুষ্টিকর ও সুষম আহার, বিশ্রাম এবং মানসিক স্বাস্থ্য- সমস্তটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসূতির যত্নের মধ্যে সুষম আহার এবং যথাযথ বিশ্রাম দু‘টিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে গর্ভাবস্থার মতোই প্রসূতির শরীরের প্রয়োজন আয়রণ ও ক্যালশিয়াম সাপ্লিমেন্ট, বিভিন্ন ভিটামিন ও প্রোটিন, দুগ্ধ উৎপাদনে সহায়ক খাবার এবং ঔষধপত্রের। গর্ভাবস্থা ও প্রসবের কারণে শরীরে তৈরি হওয়া ঘাটতি পূরণ এবং সাথে সাথেই শরীরে শিশুর প্রয়োজনীয় দুগ্ধ উৎপাদন, এই দুই গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রামের মাধ্যমে পূর্ণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাড়িতে তৈরি সাধারণ কম তেল মশলাযুক্ত খাবার, প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, সামুদ্রিক ও ছোট মাছ, তাজা মাছের ঝোল, মুরগির স্যুপ, দুধ, ছানা, ডিম, ফল ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় থাকা জরুরি। শাকে থাকে প্রচুর আয়রণ, বিভিন্ন সবজিতে মেলে বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন, সামুদ্রিক মাছে মেলে ভরপুর ক্যালশিয়াম, মাছ মাংস ডিম ইত্যাদিতে মেলে প্রোটিন, দুধ ও ছানাতেও মেলে ক্যালশিয়াম প্রোটিনসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর উপাদান। মৌসাম্বি, কমলালেবু জাতীয় রসালো ফলে মেলে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অ্যাসিড এবং প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি । অন্যান্য ফল নিয়মিত খাওয়াও জরুরি। এছাড়া লাউ, সাবু, খেজুর ইত্যাদিতে মেলে দুগ্ধ উৎপাদনকারী উপাদান। এসময়ে প্রসূতির ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা একেবারেই ত্যাগ করতে হবে, মা ও শিশু উভয়ের জন্যেই এটা ক্ষতিকারক, গর্ভাবস্থার মতোই।
এসময়ে মা ও শিশুর প্রয়োজন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিভিন্ন সাপ্লিমেন্টারি ওষুধ ও পথ্য। প্রয়োজন ভারি ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ থেকে প্রসূতির বিরত থাকা। সাধ্য অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা শরীরচর্চা বা নিয়মিত হাঁটা। এবং নিজের ও শিশুর পরিচ্ছন্নতার পরিপূর্ণ খেয়াল রাখা। প্রসূতির কষ্ট হলেও এসময়ে নখ সম্পূর্ণ ভাবে কেটে ফেলতে হবে, যতদিন স্নান না করা যায়, শরীর এবং হাত পা ডিসইনফেকট্যান্ট দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। নিয়মিত ড্রেসিং করা ও ওষুধ লাগানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে যা প্রসূতিকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কারোর সাহায্য নিয়ে হলেও, যখন থেকে চিকিৎসক স্নানের অনুমতি দেবেন, রোজ ভালো করে স্নান করতে হবে ।
সদ্যোজাত শিশু সাধারণত সারারাত জেগে থাকে, ফলে প্রসূতির ঘুম হয় না, এর ফলে শরীরের ঘড়ি ওলোটপালট হয়ে যায় যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উচিত এসময়ে পালা করে রাত জেগে শিশুর দেখভালের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া। প্রসবের পরপর প্রসূতির শারীরিক সামর্থ্যে যথেষ্ট ভাটা পড়ে, একা একা রাত জেগে শিশুর দেখভাল, ন্যাপি পাল্টানো ইত্যাদি করা তাঁর জন্য যথেষ্ট দুরুহ। একান্তই এসব সম্ভব না হলে দিনের কোনো একটি সময়ে সে দায়িত্ব নিয়ে প্রসূতিকে ঘুমোনোর সুযোগ করে দিতে হবে। এসময়ে শরীর ক্লান্ত থাকে বলে পর্যাপ্ত ঘুম দরকার, নইলে সারাদিন ধরে প্রসূতি ঝিমোতে থাকবেন এবং দুর্বল হয়ে পড়বেন। মনে রাখতে হবে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে পড়লে শিশুর যত্নেরও ত্রুটি হবে, এছাড়াও এসময়ে প্রসূতির শরীরে কোনো ত্রুটি হলে তা স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে।
শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রসূতির মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। এসময়ে অনেক প্রসূতিই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, হতাশায় ভোগেন। বিশেষত নতুন দায়িত্ব, নতুন জীবন, নতুন চ্যালেঞ্জ, সব মিলিয়ে অনেক সময় ভীতি কাজ করে ভেতরে, ইনসিকিওরিটি ফীল করেন। এসময়ে কাছের মানুষ বা পরিবারের লোকজন সংবেদনশীল না হলে, পাশে না থাকলে খুব মুশকিল। দৈনন্দিন সংসারের কাজ হোক বা শিশুর নিজস্ব কাজ, অথবা প্রসূতির কিছু নিজস্ব কাজ ভাগ করে নেয়ার পাশাপাশি প্রসূতির কাছাকাছি থাকা, তার সাথে গল্প করা, তাকে সাহস দেয়া, শারীরিক কষ্টে একটু নিরাময় দেয়ার চেষ্টা করা, তার খাওয়াদাওয়া বা যত্নের বিশেষ খেয়াল রাখা, তিনি যেন হাসিখুশি বা ভারমুক্ত থাকেন সেদিকে খেয়াল রাখা, কেবল যে শিশু নয় পরিবারের জন্য প্রসূতি নিজেও গুরুত্বপূর্ণ এটা তাকে অনুভব করতে সাহায্য করা। তার কী খেতে ইচ্ছে করছে, কী বই পড়তে বা গান শুনতে ইচ্ছে করছে একটু খোঁজ রাখা ইত্যাদি করলেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ বোধ করবেন নিজেকে। তিনি নিজেও বন্ধুবান্ধবের সাথে ফোনে আড্ডা, প্রিয় মানুষদের সাথে গল্প, প্রিয় কোনো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিজের শরীরের বিশেষ যত্ন, নিজের ভালোলাগার কোনো কাজ করতে পারেন। নিজেকে প্যাম্পার করতে পারেন। শিশুর আগমনে তাঁর জীবন কেবল শিশুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে, এটা ভেবে নিজের যাবতীয় সবকিছু ওই আবর্তে তলিয়ে যেতে দিলে ভবিষ্যতে তা আদৌ সুখকর হবে না। অনেকেরই এসময়ে ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, প্রয়োজনে হেলাফেলা না করে অবশ্যই মনোবিদদের সাহায্য নিতে হবে।
আমাদের উপমহাদেশে প্রসূতির জীবনযাপনের সাথে কিছু কুসংস্কার অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে। প্রসূতির শারীরিক কোনো সমস্যা হলে শিশুর সেই সমস্যা হবে, যেমন পেটের গোলযোগ বা সর্দিকাশি । আসলে ঘটনা হলো এরকম কিছুই ঘটেনা , সর্দিকাশি ছড়াতে পারে শ্বাসের মাধ্যমে, তাই ব্রেস্টফিড করানোর সময়ে নাকেমুখে কাপড় বা মাস্ক পেঁচিয়ে নিলে এটি সংক্রমিত হয় না। প্রসবের পরেই পেটের গোলযোগ হলে প্রসূতি শারীরিক কষ্টে ভুগবেন বলেই হালকা খাবার খেতে বলা হয়, পেটের গোলযোগ মায়ের থেকে শিশুর কখনোই হয় না। অনেক পরিবার প্রসূতিকে কম পরিমাণে খেতে দেয়ার ভুল করেন, প্রসূতি মোটা হয়ে যাবেন ভেবে, এটি একটি মারাত্মক ভুল যাতে করে সারা জীবনের জন্য প্রসূতির শরীরে অপুষ্টি এবং ক্যালশিয়ামের অভাবজনিত ভঙ্গুর হাড়, রক্তাল্পতা ইত্যাদি সমস্যার ছাপ রেখে যায়। অনেক প্রসূতি যথাযথ বিশ্রাম পান না, সংসার বা রান্নাঘরের কাজে ফিরতে হয় প্রসবের পরে যথাসম্ভব দ্রুত। এর ফলে স্বাভাবিক প্রসূতিদের ক্ষেত্রে জরায়ু নীচের দিকে নেমে আসা, পোস্ট ন্যাটাল ব্লিডিংসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। সি সেকশান ডেলিভারির প্রসূতিদেরও পোস্ট অপারেটিভ জটিলতা দেখা দিতে পারে ।
সি সেকশান ডেলিভারির প্রসূতিদের প্রসবকালীন মেরুদণ্ডে পুশ করা ইনজেকশানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নার্ভের চিরস্থায়ী সমস্যা, ঘাড় বা কোমরের যন্ত্রণা, ভারি কাজ করবার এমনকী স্বতস্ফূর্ত চলাফেরা করবার ক্ষমতা চিরদিনের মতো চলে যেতে পারে। এজন্য কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়ামের মধ্যে থাকা যেতে পারে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। এছাড়া প্রসবের পর পেটের অবশভাব, ফাটা দাগ, ঝুলে পড়া চামড়া, পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি নানান সমস্যা হতে পারে। মুডস্যুইং তো অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা এসব ক্ষেত্রে। চিকিৎসা, ওষুধ পথ্য, ব্যায়াম ইত্যাদির পাশাপাশি সবচেয়ে যেটা জরুরি, পরিবারের লোকের একটু প্রসূতির মুডের বিষয়টিকে বুঝে, মানিয়ে নিয়ে চলা, তার মনে যাতে আঘাত না লাগে সেটির খেয়াল রাখা।
আমাদের উপমহাদেশের বাস্তবটা প্রসূতির জন্যে খুব কঠিন। শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের জন্যে বিষয়গুলো একরকম, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষায় সচেতনতায় ব্যাকফুটে থাকাদের জন্য আরেকরকম। অনেক প্রসূতিই দিনমজুরের কাজ করেন, প্রসবের পর প্রয়োজনীয় আহার বা বিশ্রাম তো দূরে থাক, নিরুপায় হয়ে পেটের টানে কাজে ফিরে যেতে হয় বিক্ষত ধ্বস্ত অসুস্থ জরায়ু নিয়ে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই পরিণতি হয় সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ, মৃত্যু। মধ্যবিত্ত সমাজে তুলনামূলক ভাবে এমন ঘটনা অনেক কম।
পরিশেষে, সন্তানটি যৌথভাবে যার, তাকে এটাও বুঝতে হবে যে তার স্ত্রীটি কেবল যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করবার যন্ত্র মাত্র নয়। সবার শরীর সমান হয় না, তাই প্রসবের পরে চিকিৎসক যতোদিন অনুমতি না দেবেন, স্ত্রীর সাথে যৌনতায় যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই নিষেধটি না মানার ফলে সংক্রমিত হয়ে ভয়াবহ অসুস্থতার শিকার হয়েছেন বা হয়ে চলেছেন, এমন প্রসূতির সংখ্যা কম নয়।
পরিবারের মানুষ যতোটা পারবেন করবেন, প্রসূতির নিজেকেও নিজের ভালো রাখবার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে নিজে সুস্থ থাকলেই কষ্ট করে জন্ম দেওয়া সন্তানকে সুস্থ রাখা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়। সুতরাং শিশুর ও নিজের ভালোর জন্য নিজের ভালোটুকু নিজেকেও যথাসম্ভব বুঝে নিতে হবে বৈকি! এটাই হোক একজন নতুন মায়ের ভালো থাকার পাসওয়ার্ড।
প্রসূতির যত্নের মধ্যে সুষম আহার এবং যথাযথ বিশ্রাম দু‘টিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে গর্ভাবস্থার মতোই প্রসূতির শরীরের প্রয়োজন আয়রণ ও ক্যালশিয়াম সাপ্লিমেন্ট, বিভিন্ন ভিটামিন ও প্রোটিন, দুগ্ধ উৎপাদনে সহায়ক খাবার এবং ঔষধপত্রের। গর্ভাবস্থা ও প্রসবের কারণে শরীরে তৈরি হওয়া ঘাটতি পূরণ এবং সাথে সাথেই শরীরে শিশুর প্রয়োজনীয় দুগ্ধ উৎপাদন, এই দুই গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রামের মাধ্যমে পূর্ণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাড়িতে তৈরি সাধারণ কম তেল মশলাযুক্ত খাবার, প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, সামুদ্রিক ও ছোট মাছ, তাজা মাছের ঝোল, মুরগির স্যুপ, দুধ, ছানা, ডিম, ফল ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় থাকা জরুরি। শাকে থাকে প্রচুর আয়রণ, বিভিন্ন সবজিতে মেলে বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন, সামুদ্রিক মাছে মেলে ভরপুর ক্যালশিয়াম, মাছ মাংস ডিম ইত্যাদিতে মেলে প্রোটিন, দুধ ও ছানাতেও মেলে ক্যালশিয়াম প্রোটিনসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর উপাদান। মৌসাম্বি, কমলালেবু জাতীয় রসালো ফলে মেলে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অ্যাসিড এবং প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি । অন্যান্য ফল নিয়মিত খাওয়াও জরুরি। এছাড়া লাউ, সাবু, খেজুর ইত্যাদিতে মেলে দুগ্ধ উৎপাদনকারী উপাদান। এসময়ে প্রসূতির ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা একেবারেই ত্যাগ করতে হবে, মা ও শিশু উভয়ের জন্যেই এটা ক্ষতিকারক, গর্ভাবস্থার মতোই।
এসময়ে মা ও শিশুর প্রয়োজন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিভিন্ন সাপ্লিমেন্টারি ওষুধ ও পথ্য। প্রয়োজন ভারি ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ থেকে প্রসূতির বিরত থাকা। সাধ্য অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা শরীরচর্চা বা নিয়মিত হাঁটা। এবং নিজের ও শিশুর পরিচ্ছন্নতার পরিপূর্ণ খেয়াল রাখা। প্রসূতির কষ্ট হলেও এসময়ে নখ সম্পূর্ণ ভাবে কেটে ফেলতে হবে, যতদিন স্নান না করা যায়, শরীর এবং হাত পা ডিসইনফেকট্যান্ট দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। নিয়মিত ড্রেসিং করা ও ওষুধ লাগানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে যা প্রসূতিকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কারোর সাহায্য নিয়ে হলেও, যখন থেকে চিকিৎসক স্নানের অনুমতি দেবেন, রোজ ভালো করে স্নান করতে হবে ।
সদ্যোজাত শিশু সাধারণত সারারাত জেগে থাকে, ফলে প্রসূতির ঘুম হয় না, এর ফলে শরীরের ঘড়ি ওলোটপালট হয়ে যায় যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উচিত এসময়ে পালা করে রাত জেগে শিশুর দেখভালের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া। প্রসবের পরপর প্রসূতির শারীরিক সামর্থ্যে যথেষ্ট ভাটা পড়ে, একা একা রাত জেগে শিশুর দেখভাল, ন্যাপি পাল্টানো ইত্যাদি করা তাঁর জন্য যথেষ্ট দুরুহ। একান্তই এসব সম্ভব না হলে দিনের কোনো একটি সময়ে সে দায়িত্ব নিয়ে প্রসূতিকে ঘুমোনোর সুযোগ করে দিতে হবে। এসময়ে শরীর ক্লান্ত থাকে বলে পর্যাপ্ত ঘুম দরকার, নইলে সারাদিন ধরে প্রসূতি ঝিমোতে থাকবেন এবং দুর্বল হয়ে পড়বেন। মনে রাখতে হবে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে পড়লে শিশুর যত্নেরও ত্রুটি হবে, এছাড়াও এসময়ে প্রসূতির শরীরে কোনো ত্রুটি হলে তা স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে।
শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রসূতির মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। এসময়ে অনেক প্রসূতিই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, হতাশায় ভোগেন। বিশেষত নতুন দায়িত্ব, নতুন জীবন, নতুন চ্যালেঞ্জ, সব মিলিয়ে অনেক সময় ভীতি কাজ করে ভেতরে, ইনসিকিওরিটি ফীল করেন। এসময়ে কাছের মানুষ বা পরিবারের লোকজন সংবেদনশীল না হলে, পাশে না থাকলে খুব মুশকিল। দৈনন্দিন সংসারের কাজ হোক বা শিশুর নিজস্ব কাজ, অথবা প্রসূতির কিছু নিজস্ব কাজ ভাগ করে নেয়ার পাশাপাশি প্রসূতির কাছাকাছি থাকা, তার সাথে গল্প করা, তাকে সাহস দেয়া, শারীরিক কষ্টে একটু নিরাময় দেয়ার চেষ্টা করা, তার খাওয়াদাওয়া বা যত্নের বিশেষ খেয়াল রাখা, তিনি যেন হাসিখুশি বা ভারমুক্ত থাকেন সেদিকে খেয়াল রাখা, কেবল যে শিশু নয় পরিবারের জন্য প্রসূতি নিজেও গুরুত্বপূর্ণ এটা তাকে অনুভব করতে সাহায্য করা। তার কী খেতে ইচ্ছে করছে, কী বই পড়তে বা গান শুনতে ইচ্ছে করছে একটু খোঁজ রাখা ইত্যাদি করলেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ বোধ করবেন নিজেকে। তিনি নিজেও বন্ধুবান্ধবের সাথে ফোনে আড্ডা, প্রিয় মানুষদের সাথে গল্প, প্রিয় কোনো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিজের শরীরের বিশেষ যত্ন, নিজের ভালোলাগার কোনো কাজ করতে পারেন। নিজেকে প্যাম্পার করতে পারেন। শিশুর আগমনে তাঁর জীবন কেবল শিশুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে, এটা ভেবে নিজের যাবতীয় সবকিছু ওই আবর্তে তলিয়ে যেতে দিলে ভবিষ্যতে তা আদৌ সুখকর হবে না। অনেকেরই এসময়ে ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, প্রয়োজনে হেলাফেলা না করে অবশ্যই মনোবিদদের সাহায্য নিতে হবে।
আমাদের উপমহাদেশে প্রসূতির জীবনযাপনের সাথে কিছু কুসংস্কার অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে। প্রসূতির শারীরিক কোনো সমস্যা হলে শিশুর সেই সমস্যা হবে, যেমন পেটের গোলযোগ বা সর্দিকাশি । আসলে ঘটনা হলো এরকম কিছুই ঘটেনা , সর্দিকাশি ছড়াতে পারে শ্বাসের মাধ্যমে, তাই ব্রেস্টফিড করানোর সময়ে নাকেমুখে কাপড় বা মাস্ক পেঁচিয়ে নিলে এটি সংক্রমিত হয় না। প্রসবের পরেই পেটের গোলযোগ হলে প্রসূতি শারীরিক কষ্টে ভুগবেন বলেই হালকা খাবার খেতে বলা হয়, পেটের গোলযোগ মায়ের থেকে শিশুর কখনোই হয় না। অনেক পরিবার প্রসূতিকে কম পরিমাণে খেতে দেয়ার ভুল করেন, প্রসূতি মোটা হয়ে যাবেন ভেবে, এটি একটি মারাত্মক ভুল যাতে করে সারা জীবনের জন্য প্রসূতির শরীরে অপুষ্টি এবং ক্যালশিয়ামের অভাবজনিত ভঙ্গুর হাড়, রক্তাল্পতা ইত্যাদি সমস্যার ছাপ রেখে যায়। অনেক প্রসূতি যথাযথ বিশ্রাম পান না, সংসার বা রান্নাঘরের কাজে ফিরতে হয় প্রসবের পরে যথাসম্ভব দ্রুত। এর ফলে স্বাভাবিক প্রসূতিদের ক্ষেত্রে জরায়ু নীচের দিকে নেমে আসা, পোস্ট ন্যাটাল ব্লিডিংসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। সি সেকশান ডেলিভারির প্রসূতিদেরও পোস্ট অপারেটিভ জটিলতা দেখা দিতে পারে ।
সি সেকশান ডেলিভারির প্রসূতিদের প্রসবকালীন মেরুদণ্ডে পুশ করা ইনজেকশানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নার্ভের চিরস্থায়ী সমস্যা, ঘাড় বা কোমরের যন্ত্রণা, ভারি কাজ করবার এমনকী স্বতস্ফূর্ত চলাফেরা করবার ক্ষমতা চিরদিনের মতো চলে যেতে পারে। এজন্য কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়ামের মধ্যে থাকা যেতে পারে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। এছাড়া প্রসবের পর পেটের অবশভাব, ফাটা দাগ, ঝুলে পড়া চামড়া, পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি নানান সমস্যা হতে পারে। মুডস্যুইং তো অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা এসব ক্ষেত্রে। চিকিৎসা, ওষুধ পথ্য, ব্যায়াম ইত্যাদির পাশাপাশি সবচেয়ে যেটা জরুরি, পরিবারের লোকের একটু প্রসূতির মুডের বিষয়টিকে বুঝে, মানিয়ে নিয়ে চলা, তার মনে যাতে আঘাত না লাগে সেটির খেয়াল রাখা।
আমাদের উপমহাদেশের বাস্তবটা প্রসূতির জন্যে খুব কঠিন। শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের জন্যে বিষয়গুলো একরকম, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষায় সচেতনতায় ব্যাকফুটে থাকাদের জন্য আরেকরকম। অনেক প্রসূতিই দিনমজুরের কাজ করেন, প্রসবের পর প্রয়োজনীয় আহার বা বিশ্রাম তো দূরে থাক, নিরুপায় হয়ে পেটের টানে কাজে ফিরে যেতে হয় বিক্ষত ধ্বস্ত অসুস্থ জরায়ু নিয়ে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই পরিণতি হয় সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ, মৃত্যু। মধ্যবিত্ত সমাজে তুলনামূলক ভাবে এমন ঘটনা অনেক কম।
পরিশেষে, সন্তানটি যৌথভাবে যার, তাকে এটাও বুঝতে হবে যে তার স্ত্রীটি কেবল যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করবার যন্ত্র মাত্র নয়। সবার শরীর সমান হয় না, তাই প্রসবের পরে চিকিৎসক যতোদিন অনুমতি না দেবেন, স্ত্রীর সাথে যৌনতায় যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই নিষেধটি না মানার ফলে সংক্রমিত হয়ে ভয়াবহ অসুস্থতার শিকার হয়েছেন বা হয়ে চলেছেন, এমন প্রসূতির সংখ্যা কম নয়।
পরিবারের মানুষ যতোটা পারবেন করবেন, প্রসূতির নিজেকেও নিজের ভালো রাখবার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে নিজে সুস্থ থাকলেই কষ্ট করে জন্ম দেওয়া সন্তানকে সুস্থ রাখা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়। সুতরাং শিশুর ও নিজের ভালোর জন্য নিজের ভালোটুকু নিজেকেও যথাসম্ভব বুঝে নিতে হবে বৈকি! এটাই হোক একজন নতুন মায়ের ভালো থাকার পাসওয়ার্ড।
