প্রমা ইসরাত

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

মানবতার কোন সিলেবাস নেই

ডিসকভারি চ্যানেল দেখেন অথচ বেয়ার গ্রিল কে চেনেন না, এমন হবার কথা না। বেয়ার গ্রিল এর প্রোগ্রাম দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। বাংলায় ডাবিং করেছেন যিনি, তার কণ্ঠ বেয়ার গ্রিল এর গলায় এতই মানিয়েছে যে মনে হয় বেয়ার গ্রিল বাংলায় কথা বলেন, আর এই জন্যই তাকে আরো আপন মনে হয়।

তো বেয়ার গ্রিল বন জঙ্গল ছাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, জঙ্গল থেকে বের হতে হবে তাকে। অনেক হিংস্র পশু আছে জঙ্গলে যা তাকে আক্রমণ করতে পারে। হঠাৎ তাঁর গলায় উচ্ছাস, “এইতো, এসে গেছি, এখন আর কোন ভয় নেই, ওই তো দূরে মানুষের ঘর দেখা যাচ্ছে, আগুনের কুণ্ডলী উঠছে, হ্যাঁ হ্যাঁ এইখানে মানুষ আছে”। প্রোগ্রাম টা শেষ হল। বেয়ার গ্রিল এর শেষ ডায়লগ “হ্যাঁ হ্যাঁ এইখানে মানুষ আছে”।

এই পৃথিবীতে, আমি প্রমা ইসরাত নামের মানুষ টা যে আছি, এইটা আসলে আমি জানি আরেক জন মানুষের জন্য। আমার অস্তিত্বের স্বীকৃতি আছে, কারণ আরেকজন মানুষ আমার সেই অস্তিত্ব স্বীকার করছে।

এখন চরম অস্তিত্বের সংকটে আছে, মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা রা যে এই কয়েকদিনের গণহত্যায় পালিয়ে এসেছে তা না, বাংলাদেশে তারা পালিয়ে আসছে অনেক বছর আগে থেকেই। আমি সেই ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে আসলে আগ্রহী না। কারণ মানব সভ্যতার ইতিহাস মানেই, রক্তক্ষয়ী কিছু ব্যাপার। এই যে দেখুন, ১৯৭১ এর ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস, এই ২০১৭ সালও গণহত্যার ইতিহাস, পূর্বে ভারত পাকিস্তান ভাগাভাগির ইতিহাসও গণহত্যার ইতিহাস। মানব সভ্যতার কপালে কলঙ্কিত ভাবে লেখা আছে মানুষ হত্যার ইতিহাস।

এখন ব্যাপার হচ্ছে, এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একটি অস্বীকৃত জনগোষ্ঠী। তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই নিজ ভূমে পরবাসী। তাদের ভূমি নেই, তাদের জমি নেই, তাদের কোন পরিচয় নেই। ভাবতে পারেন কত বৃহৎ সংখ্যার একটি জনগোষ্ঠী তাদের এই পৃথিবীতে অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই।

আমি প্রমা ইসরাত, এই দেশের আমি একজন নাগরিক, আমার একটি ভোটার আইডি কার্ড আছে, আমার ব্যাংকে একাউন্ট আছে, আমার পাসপোর্ট আছে, আমার পৈত্রিক ভিটা আছে, আমি সরকারকে ট্যাক্স দেই, আমার বায়োমেট্রিক করা দুটি সিম কার্ড আছে। আমি এই পৃথিবীর কাছে স্বীকৃতি পেয়েছি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে। আমার মৌলিক অধিকার আছে, আর এই অধিকার দিয়েছে আমাকে এই দেশের সংবিধান।

কিন্তু কি ভয়াবহ ট্র্যাজেডি , হাজার বছরের ইতিহাসে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, নিগৃহীত, নিপীড়িত, অস্বীকৃত। তাদের কোন মৌলিক অধিকার নেই, তাদের কোন সরকারি পরিচয় নেই, এবং যেহেতু আইনের মাধ্যমে তারা স্বীকৃত নয়। মরে যেতে যেতে তারা অভ্যস্ত।

জানেন, একটা হিন্দী মুভি, আমির খানের “তালাশ”, কারিনা কাপুর থাকে যৌনকর্মীর চরিত্রে, মুভিতে তাঁর একটা ডায়লগ, “ দেখা সাহাব, এক লাড়কি মার গ্যায়ি, অউর কিসিকো পাতা ভি ন্যাহি চালা” ,(দেখলেন সাহেব, একটা মেয়ে মারা গেল আর কেউ জানতেও পারলো না” ) কারণ আইনের চোখে তাঁর কোন স্বীকৃতি নেই।

রোহিঙ্গা মুসলিমরা এই দেশে বানের পানির মতো এসে ঢুকছে, হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে বাঁচতে, এবং বহু বহু কাল থেকেই তাদের পুশ ইন করা হচ্ছে, তাদের অত্যাচার করা হচ্ছে, যেন তারা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। আমাদের দেশ, এই যে বাংলাদেশ, যে দেশের অবস্থাটাই খুব একটা সুবিধার না, সেই দেশকেই দাঁড়াতে হচ্ছে, রোহিঙ্গা দের পাশে, মানবতা দেখাচ্ছেন অনেকে, “ছাল নাই কুত্তার নাম রেখেছে বাঘা” এইরকম একটা প্রবাদ মাথায় চলে আসে মাঝে মাঝে। কিন্তু আবার বেয়ার গ্রিল এর কথা মনে পড়ে, “হ্যাঁ হ্যাঁ এইখানে মানুষ আছে” । আমার মনটা কেমন করে।

আমাদের দেশের হিপোক্রেট মুসলিম বাঙ্গালিরা, নানান জায়গায় “মুসলিম রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াই, মানবতার হাত বাঁড়াই”, এইরকম স্লোগান লিখে চাঁদা তুলছে। তাদের মানবতার একটা সিলেবাস আছে, এই সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন আসলে তারা উত্তর করতে পারে না, তখন টিচার কেই বকে, যে কেন এইসব সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করল। মুখস্থ বিদ্যা তো।

এইসব মানুষ গুলোকে দেখলেই একদলা থুতু ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছা করে। এই যে এইসব হিপোক্রেট শয়তান গুলা মানবতা দেখাচ্ছে, এদের এই মানবতা গুলোই আবার কয়েকদিন পর উধাও হয়ে যাবে, তখন তারা বলবে, আমরা বাঙালি মুসলিম, আর তোরা রোহিঙ্গা মুসলিম। ঠিক যেমন পাকিস্তানিরা বলেছিল, “আমরা পাঞ্জাবী মুসলিম, আর তোরা বাঙালি মুসলিম, তোদের মুসলমানিত্ব সহিহ নয়”।

রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী, অশিক্ষিত, অন্ধকারে থাকা পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী। যারা নানান অপরাধে জড়িত, কারণ অন্ধকার জগতে তাদের ব্যাবহার করা সবচেয়ে সহজ। তারা এই সময়ের দাস। ধর্মের নামে, ব্যাবসার নামে, এমনকি মানবতার নামেও এদের ব্যাবহার করা হবে, হচ্ছে।

অং সান সু চি’ র জঘন্য মুখটা যখন দেখায় অসহ্য লাগে, একদিন তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস জেনে তাকে শ্রদ্ধা করেছিলাম। নোবেল কমিটিও একই ভুল করেছিল বোধ হয়।

এই দেশে যে সকল নারী এবং শিশুরা এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের জীবনও মানবেতর। শুধু মাত্র একটাই চাওয়া, কোনমতে প্রাণে বেঁচে থাকা। ভাবতে পারেন, এমন অস্তিত্বহীন, দিনের পর দিন নৃশংসতা দেখে অভ্যস্ত, উদ্বাস্তু, অন্ধকারে থাকা অস্বীকৃত মানুষ গুলোর মানসিক স্বাস্থ্য কেমন হতে পারে?

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা সবাই চিন্তিত, কারণ একটা জাতীয় সংকটে থাকা মানে, এর প্রভাব আমাদের সবার উপরেই পড়বে। এবং ভবিষ্যতে দিন শেষে সেটার মুখোমুখি হতে হবে সাধারণ মানুষকেই। তবে কি জানেন তো, যত কিছুই হোক, আমার বেঁচে থাকার অধিকার আর একজন রোহিঙ্গা নারীর বেঁচে থাকার অধিকার একই। এই অধিকার কেউ কোনদিন অস্বীকার করতে পারবে না। মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়া মাত্রই এই অধিকার তাদের আছে। আর এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় মায়ানমার কে নিতে হবে। মানুষ হত্যার দায় মায়ানমার কে নিতেই হবে।

কিছু থুতু সহ ধিক্কার জানিয়ে লেখাটা শেষ করি, বাংলাদেশের হিপোক্রেট গুলোকে যারা মানবতার একটা সিলেবাস মুখস্থ্য করে বসে থাকে। যাদের প্রশ্ন কমন না পড়লে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায় যে কোন ইস্যুতে। যারা রোহিঙ্গা নারী বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেলেও, এই দেশের তনু, রূপা, আফসানা,বা শিশু তানহার জন্য কোন প্রতিবাদ করে না।সংখ্যালঘুদের উপর নৃশংসতা হলে প্রতিবাদ করে না, ব্লগার, লেখক, বিদেশী নাগরিক খুন হলে প্রতিবাদ করে না, রাস্তায় কেউ ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদের জন্য দাঁড়ালে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে, আর ফিচেল একটা হাসি মেরে চলে যায়। তাদের কে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধিক্কার। এই হিপোক্রেট গুলো কোনদিন বুঝবে না যে, মানবতার কোন সিলেবাস হয় না, যেখানে মানুষ আছে, সেখানে আসলে মানুষই আছে।

2788 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।