জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

কথা সাহিত্যিক

সৌন্দর্য্য যোনীতে থাকারও বিষয় নয, বিক্রির বিষয়ও নয়

তসলিমা নাসরিন যখন ‘বুড়ো বয়সের রাজ্জাক কুৎসিত ছিলেন’ জাতীয় কথা বলেছিলেন তখন আমি তীব্র বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ আমি মনে করি পৃথিবীতে প্রতিটি বয়সের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে। সেটা রাজ্জাক হন বা আমার মা-বাবা। শিশুর সারল্য, কিশোরীর চপলতা, তরুণীর সতেজতা, প্রবীণের চাহনি- প্রতিটা সৌন্দর্যই আলাদা। কাজেই মিস ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশানের কোনো মানে আমি দেখিনি। সৌন্দর্য মাপার বিষয় না। জোছনার আলো কি আমরা দাঁড়িপাল্লায় তুলে মাপতে পারবো কতটুকু সুন্দর? ঘষেটি বেগমের চেহারা বিরাট সুন্দর হলেও বাংলার লোকের কাছে সে বিরাট বিশ্বাসঘাতক!

আমি বলি লাক্স কোম্পানি কখনো সুন্দর হয়ে ওঠার সাবান বিক্রি করেনা। তারা বিক্রি করে দীপিকা পাড়ুকোন, ঐশ্বরিয়া রায়, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নামের ব্র্যান্ড এম্বাসেডরদের সৌন্দর্য। আপনি ওদের দেখে সাবান কেনেন, সাবান মাখলে আপনি দেখতে হবেন ওদের মতন- এই ভ্রমে।

কর্পোরেট দুনিয়া চলছেই এভাবে। আমি মাইক্রোসফটের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর। একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এরা জানাতে চায় মাইক্রোসফট পৃথিবীসেরা বুদ্ধিমান তরুণদের তাদের প্লাটফর্মে জায়গা দিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য বিশ্বমঞ্চে যখন তাদের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে যাবো, তখন তারা বলতে পারবে- আমরা তাকে সাহায্য করেছি। উদ্দেশ্যটা মূল।

মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ নাম দিয়ে যখন গায়ের রঙ, বুকের প্রশস্ততা, চুলের ঘনত্ব মাপার একটি প্রয়াস দেখি তখন ব্যথিত হই। একটি মেয়ে কি সহজেই তাকে অবমাননা করার সুযোগ একদল ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিয়েছে ভেবে দুঃখিত হই। নতুন যোগ হয়েছে মেয়েটি কুমারী কিনা- এই শর্ত। 


একজন রেপড মেয়ে যদি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতো, তখন কি হতো? সে তো কুমারী নয়! তাহলে? রেপড হলে কেউ অসুন্দর হয়ে যায়? তারপর একজন ডিভোর্সি, সেও তো ‘মিস’, কিন্তু ভার্জিন নয়, তার কি হবে?

একবার নাইজেরিয়ার একটা মেয়ে বিশ্বসুন্দরী হলো। আমি তখন ফোর ফাইভে পড়ি। আমার এক বান্ধবী গজগজ করে জানালো- একটা কালো, বড় দাঁতওয়ালা মেয়ে বিশ্বসুন্দরী হয়েছে। এটা কিছু হলো? সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছি সৌন্দর্য গায়ের রঙে নেই, সৌন্দর্য আছে যা ভালো লাগে তাতে! বিশ্বাস না হলে তিনটি দেশের তিনজন মানুষকে তিনটি ছবি আলাদা আলাদা করে দেখান, একেকজন আলাদা আলাদা করে একেকটা বেছে নেবেন, কিন্তু কখনোই তিনজনের চয়েস এক হবেনা- গ্যারান্টি!

পারস্যের সম্রাট খলিফা হারুন ‘লাইলি-মজনু’ জুটির লাইলিকে দেখে বলেছিলেন- এর জন্য মজনুর এতো প্রেম? লাইলি হাসতে হাসতে জানিয়েছিল- আপনি মজনুর চোখে দেখলেই কেবল সেটা বুঝতে পারতেন! অর্থাৎ, আপনাকে তাকাতে হবে মজনুর চোখ নিয়ে, তাহলেই কেবল লাইলিকে অসামান্য সুন্দর লাগবে!

আমার বোন যখন প্রেগন্যান্ট ছিল, পেটটা ছিল ফোলা। সেই সৌন্দর্যও আলাদা, যে দেখেনি সে কখনো বুঝবেনা! 


তাই বলি- সৌন্দর্য্য মাপার বিষয় না, সৌন্দর্য যোনিতে থাকার বিষয় না, বিক্রির বিষয়ও না। যারা সৌন্দর্য দাঁড়িপাল্লায় তুলে দেয় তাদের জন্য আমার দুঃখ ও করুণা হয়। যারা সৌন্দর্য মাপার দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আসে, তাদের জন্যও আমার করুণা হয়! আপনার হয়না?

 

7566 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।