পৃথু স্যন্যাল

জার্মান প্রবাসী পৃথু স্যন্যাল আপাদ মস্তক একজন স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি, ব্লগার। বর্তমানে নারী'র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ভোট কাকে দিবেন?

স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে এই প্রশ্নটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একথা বলা বাহুল্য যে একজন বাংলাদেশী হিসেবে আপনার ভোট স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই দিতে হবে। এছাড়া আপনার আমার সামনে অন্য কোনো অপশন নাই।

এই অপশন না থাকাটা একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের এগিয়ে যাবার কথা ছিলো অনেক আগেই। প্রায় অর্ধশতক পেরিয়ে এখন আমাদের ভাবার কথা ছিলো, কোন দল দেশের উন্নয়নে আরও ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে, কোন দল দেশের মানুষকে আরও ভালো রাখতে পারবে। কিন্তু আমরা তা পারি নি। আমরা এখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে পারি নি। এতোদিনে আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটা রাজনৈতিক দলই হওয়া উচিৎ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। কিন্তু তা হয় নি।

তাই আমাদেরকে প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের কাছে ফিরে ফিরে যেতে হচ্ছে। ফিরে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু করার প্রয়াস খুঁজতে হচ্ছে। আর এই ফিরে যাবার পথেও আমাদেরকে বইতে হচ্ছে এক নির্মম সত্যের জ্বালা। এতদিন পরে এসে আমরা আসলেই বুঝতে পারছি না কে যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর কে যে স্বাধীনতার পক্ষের।

হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিলো, মুক্তযুদ্ধের প্রাণভোমরা এবং অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আওয়ামীলীগের এবারের নির্বাচনী সঙ্গীতে জাতির জনককে উপেক্ষা করা হয়েছে। তার নাম কিংবা বঙ্গবন্ধু শব্দটি একটি বারের জন্যও উচ্চারিত হয় নি সে সঙ্গীতে। তাহলে, যে দল তাদের নির্বাচনী সঙ্গীতে বঙ্গবন্ধুকে উপেক্ষা করতে পারে, তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কীভাবে বলি?

বাদ দেন, সামান্য একটি নির্বাচনী সঙ্গীত। একটি সঙ্গীত হয়তো বা আদর্শকে ধারণ নাও করতে পারে। কিন্তু দলটি কি আদর্শকে ধরে রাখতে পেরেছে? এরা কি মুক্তিযুদ্ধের ধারে কাছেও আছে?

আওয়ামি লীগের একচেটিয়া একটা সুনাম ছিলো অসাম্প্রদায়িক হিসেবে, সংখ্যালঘু হিন্দুদের (অন্য সংখ্যালঘুদের জন্য কেউ নাই) রক্ষক হিসেবে। এদের বিগত দশ বছরের সময়ে কি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপদে ছিলেন? কমেছে কী সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের হার? সত্য হলো, তা আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। মুক্তমনা নাস্তিক ব্লগার হত্যার কথাগুলো নাই বা বললাম, নাই বা বললাম মিথ্যে উস্কানীতে নির্যাতনের শিকার রসরাজের কথা।

কথা ছিলো, আওয়ামি লীগ ক্ষমতায় গেলে বাহাত্তরের সংবিধান পূনর্বহাল করা হবে বাংলাদেশে। এই পুনর্বহালে মূর্খ মুসলমানদের বিসমিল্লাহর দাবি বাদ দিলেও আওয়ামি লীগ কি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে সেই সংবিধানের মূল চার নীতি? পেরেছে কি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে?

উপরন্তু আমরা দেখেছি, এই আওয়ামীলীগের হাত ধরে বাংলাদেশে মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সারাদেশে ঘৃণিত তেঁতুল হুজুরকে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রীয় খরচে প্রমোট করেছে, তাদেরকে মাথায় তুলে নেচেছে।

বাদ দেন ধর্মীয় উন্মাদনার কথা। গত দশ বছরে দেশে কি আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? আমরা তো বরং দেখেছি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামীলীগ কায়েম করেছে একচেটিয়া স্বৈরতন্ত্র। তাহলে, আওয়ামীলীগকে কেনো ভোট দেবেন?

এভাবে একশো একটা কারণ দেখানো যাবে নৌকায় ভোট না দেবার। তাহলে, বাকী থাকে জামাত বিএনপি জোট। না, জামাত বিএনপিকে ভোট দেবার প্রশ্নই আসে না কারণ, এরা তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি না। এরা বরং বাংলাদেশ বিরোধী, এরা স্বাধীনতা বিরোধী। এদের দলে মনোয়নন পেয়েছে সরাসরি রাজাকাররা। এদেরকে ভোট দেবার প্রশ্নই আসে না। ও হ্যাঁ, রাজাকার প্রসঙ্গে আওয়ামিলীগও ছাড় পায় না এবারের নির্বাচনে। চিহ্নিত রাজাকারদের অন্তত জনা পচিশেক নৌকা নিয়ে এবারের নির্বাচন করছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।

তাহলে, ভোটটা আপনি দিবেন কাকে? জামাত বিএনপি আর আওয়ামি লীগের বাইরে কি আর কোনো দল বাংলাদেশে নেই? না তো, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা তো কম না। তাহলে, আপনি আমি কেনো বারবার দ্বি-দলীয় বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি! আমাদের চোখ কি খোলার প্রয়োজন নেই? বাদ দিন, নিবন্ধিত অসংখ্য দলের কথা। এরাও ঘুরে ফিরে দ্বি-দলীয় বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঐক্যজোট, মহাজোট গড়ছে।


এবার তবে চোখ খুলুন, খুলে দেখুন। দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আছে, আছে সত্যিকারের প্রগতিশীল দল। আমাদের শুধু বুঝে নিতে হবে। হ্যাঁ, আমি বাম দলগুলোর কথা বলছি। এখন পর্যন্ত তো আমরা বাম দলগুলোর শাসনের কোনো প্রমান পাই নি। আমরা কি ভাবতে পারি বামদেরকে ভোট দেয়ার কথা?

হ্যাঁ, বাম জোটগুলোকে আপনি ভোট দিলে হয়তো তারা সরকার গঠন করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। এতে কি আপনার ভোটটি নষ্ট হবে? হ্যাঁ, হতে পারে এবারের মতো নষ্ট হবে। কিন্তু, যদি কিছু সংখ্যক আসনেও তারা পায়, অন্তত আমরা এটা তো বুঝতে পারবো এদেরকে আমরা চাইছি। সাধারণের মাঝে এ বার্তাটা পৌছাতে পারবো বামরা একটা শক্তি হয়ে উঠছে। সূচনাটা তো আমরা করতে পারি।

এবারের নির্বাচনে বামজোটের কাস্তে, কোদাল এবং মই মার্কায় মোট প্রার্থীর সংখ্যা ১৭০। আর সরকার গঠন করতে লাগে মাত্র ১৫০ টি আসন। যারা আওয়ামীলীগের বিকল্প খুঁজছেন তাঁদের জন্য তো এই মার্কাগুলো একটা সুন্দর বিকল্প হতে পারে। এটা তো সত্য যে দেশের জাতীয় বিষয়গুলোতে এখন পর্যন্ত বামেরাই কথা বলছে নিয়মিত। জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যত চিৎকার চেচামেচি এখন পর্যন্ত বামরা করে যাচ্ছে। অন্য দলগুলো তো দৌড়াচ্ছে শুধুই তাঁদের ক্ষমতার পেছনে।

সে যাই হোক, আসুন আপনার আমার এবারের ভোটটি নষ্ট করি। ভণ্ডামীপূর্ণ দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে দেশের বাম জোটের প্রার্থীদেরকে ভোটটি দিয়ে নষ্ট করি। নষ্ট করার মাধ্যমে বাম জোটকে অন্তত শক্তিশালী বিরোধী জোট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালাই। একটা ভোট নষ্ট করার মধ্য দিয়ে আসুন সূচনা করি একটি তৃতীয় শক্তির, যে শক্তিটি এক সময় সত্যিকারের বাংলাদেশের কথা বলবে, বলবে মানুষের মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা।

সাতচল্লিশ বছরে যে দেশটার কিছুই পরিবর্তন হয় নি, আসুন আরও সাত কিংবা সতের বছর অপেক্ষা করি একটা প্রগতিশীল তৃতীয় শক্তির উত্থানের আর শুরুটা করি বিজয়ের মাসের ত্রিশ ডিসেম্বরে। আসুন বাম জোটের মার্কা কাস্তে, কোদাল কিংবা মই মার্কায় আমাদের ভোট দিই।

1749 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।