জনৈক বঙ্গমহিলা’র কথা বলি। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী নারী "জনৈক বঙ্গ মহিলা" ছিলেন একজন প্রথিতযশা কবি, সমাজকর্মী ও নারীবাদী লেখক। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়াদের ভিড়ে বর্তমানে ঠাই হয়েছে এই "জনৈক বঙ্গমহিলা"র।
এই নারী শৈশবে খুব ভাল কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করা শিখেছিলেন তাঁর পিতামহের কাছ থেকে। খুব ভাল আবৃত্তি পারতেন বলে ধীরে ধীরে নিজেই ঝুঁকে পড়েন কবিতা লেখার দিকে। আট বছর বয়স থেকেই লিখা শুরু করেন এবং পনের বছর বয়সে ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ “আলো ও ছায়া”। সেই কাব্যগ্রন্থও তাঁর নিজ নামে প্রকাশিত হয়নি, হয়েছিল “জনৈক বঙ্গমহিলা” নামে।
এই "জনৈক বঙ্গমহিলা" জন্মগ্রহন করেন তৎকালীন বাকেরগঞ্জ অর্থাৎ বর্তমান বরিশাল জেলার বাসণ্ডা গ্রামে। তাঁর পিতা চন্ডীচরণ সেন ছিলেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক। ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দে চণ্ডীচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। পরের বছর তাঁর স্ত্রী-কন্যাও কলকাতায় তাঁর কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। চন্ডীচরণ সেন ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। আর এই “জনৈক বঙ্গমহিলা’র বোন ছিলেন ঐ সময়ের একজন প্রসিদ্ধ লেডি ডাক্তার।
পিতা আর বোনের নাম জানার পরে পাঠকরা নিশ্চয় বুঝে গিয়েছেন কে এই “জনৈক বঙ্গমহিলা”। গৃহকোনে মায়ের কাছে অক্ষরজ্ঞান এবং পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে “জনৈক বঙ্গমহিলা” অর্থাৎ কামিনী রায় বার বছর বয়সে চলে যান বোর্ডিং স্কুলে। ১৮৮০ খ্রীস্টাব্দে তিনি কলকাতা বেথুন স্কুল হতে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) পরীক্ষা ও ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দে এফ.এ বা ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বেথুন কলেজ হতে তিনি ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
শিক্ষাজীবন শেষ হতে না হতেই স্নাতক ডিগ্রী লাভের বছরই তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে যোগ দেন বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে। পরবর্তীকালে তিনি ঐ কলেজে অধ্যাপনাও করেছিলেন। যে যুগে মেয়েদের শিক্ষাও বিরল ঘটনা ছিল, সেই সময়ে তিনি নারীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধে এর প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্যও ছিলেন।
তখনকার যুগে হিন্দু পুরমহিলাগণের লেখাপড়া শিক্ষা করাকে একান্তই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু নিজের ইচ্ছেশক্তি এবং মা-বাবার সহযোগিতায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তাঁর রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার সহজ-সরল ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ “আলো ও ছায়া” এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আলো ও ছায়া (১৮৮৯), নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪) অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবন পথে (১৯৩০), একলব্য, দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন, শ্রাদ্ধিকী।
মজার বিষয় হলো, তিনি শুধু নিজেই লিখতেন না, অন্যদেরকেও লিখতে উৎসাহিত করতেন। কবি সুফিয়া কামাল তাঁর উৎসাহেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে কামিনী রায় একবার বরিশাল সফর করেন। সে সময় কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার জন্য তাগিদ দেন।
১৮৬৪ সাল অক্টোবর মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহন করে ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে মৃত্যু গ্রহন করেন এই মহান বিদুষী। জীবদ্দশায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক “জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” লাভ করেন, অলংকৃত করেন বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতির আসন। ১৯২৯ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আজ মহান বিদুষী “জনৈক বঙ্গমহিলা” ছদ্মনামের নারীবাদী লেখক কামিনী রায়’এর ১৫২তম জন্মবার্ষিকী, তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি নিরন্তর।