গণঅভ্যুত্থান শব্দটির সাথে পরিচয় ঘটে যখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি। পরিবেশ পরিচিত (সমাজ) বইয়ের বাংলাদেশ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করার মাধ্যমে জানতে পারি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার জন্য ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণএকটি ঘটনা। পরবর্তীতে বুঝতে পারি এই গণঅভ্যুত্থান আসলে কি, কিভাবে তা জনতার শক্তিকে প্রকাশ করেছিলো। একটি গণঅভ্যুত্থান সত্যিকার অর্থেই শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকে খর্ব করে দেয়, বুঝতে দেয় জনতার ঐক্যের শক্তিকে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো যে জনতা তখন প্রতিটা সরকারী অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে বাধ্য করেছিলো ঘুষ ফেরত দিতে, কোনো কোনো জায়গায় ছাত্ররা কৃষকদের সহযোগিতায় নায়েব, তহশিলদার, পুলিশ, দারোগা, সার্কেল অফিসারদের বিচার করে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরিয়েছে। ঊনসত্তরের গনুভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি যে শক্তিকে অনুধাবন করেছিলো তার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। আত্মবিশ্বাস এমন পর্যায়ে ছিলো যে মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাংক কামানের বিরুদ্ধে তাঁদের বাঁশের লাঠিকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রত্যয় পেয়েছিলো, এবং সফলতার মুখও দেখেছিলো, স্বাধীন হয়েছিলো বাংলাদেশ।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আবার ডুবে যায় অন্ধকারে। আবার জনতার শক্তি হারিয়ে যায় সামরিক শাসনের যাঁতাকলে। জনতা হয়ে যায় ব্লাডি সিভিলিয়ান। ব্লাডি সিভিলিয়ানরা শাষিত এবং শোষিত হতে থাকে তাদেরই নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে থাকা সেনা বাহিনীর হাতে। এই ব্লাডি সিভিলিয়ানরা আবার জেগে উঠে ৯০-এ। যদিও এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে তথাপি এই আন্দোলন আবার গণঅভ্যুত্থান কিংবা গণআন্দোলনে রূপ নেয় নব্বইয়ে। স্বৈর-শাসক এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে তখনকার জনতার গণঅভ্যুত্থান।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ভিন্ন ভিন্ন শাসকদের বিরুদ্ধে হলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই দুটি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিলো একই। ছিলো জনতার শাসন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী জনতা চেয়েছিলো নিজেদের শাসন। জনতার বিশ্বাস হয়েছিলো নিজেদের শাসন হলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে সকল সমস্যার সমাধান হয়েছিলো কি না তা নিয়ে তর্ক না করলেও এটা নিশ্চিত যে সামরিক শাসনের সময়ে মানুষ আবার উপলব্ধি করেছিলো যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সমাধান কিভাবে হবে? চাই জনতার শাসন। হটাও সামরিক শাসন, হটাও স্বৈরাচার। আবার আন্দোলন, প্রতিষ্ঠিত করো গণতান্ত্রিক শাসন।
বলা বাহুল্য দুটো গণঅভ্যুত্থানই সফল হয়েছিলো, কিন্তু এর উদ্দ্যেশ কি সফল হয়েছে? আদৌ কি মানুষের মুক্তি মিলেছে? সকল সমস্যার সমাধান কি হয়ে গিয়েছে? মাঝখানের দুই বছর অর্থাৎ ফখরুদ্দিন আহমদ আর মইন উ আহমদের সময়টুকু বাদ দিলে ১৯৯১ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে গণতান্ত্রিক শাসনে শাসিত হচ্ছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, এটি সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। তো, এই পঁচিশ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনে দেশে জনতার এখন পর্যন্ত কি লাভ হয়েছে? দেশে কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? দেশের সকল মানুষ কি তাদের মানবাধিকার সমানভাবে ভোগ করছে? অথচ, একটা দেশের পরিবর্তনের জন্য পঁচিশ বছর বেশ যথেষ্ঠ সময়।
এদিকে, দেশ স্বাধীন হবার পর প্রায় অর্ধশতক বছর হতে চললো, এখন পর্যন্ত দেশের প্রতিটি নাগরিক দূরে থাক, হাতে গোনা গুটিকয়েক রাজনৈতিক নেতা আর আমলা ছাড়া দেশের কোন নাগরিকটি স্বাধীন জীবন যাপন করছে? এই রাজনৈতিক নেতাদের জীবনও অবশ্য নিরাপদে নেই; হুটহাট খুন হয়ে যাচ্ছে কোন্দলের কারণে। এ কথা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের সংখ্যালঘু থেকে শুরু করে প্রতিটি নাগরিক এখনও অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে। বাঙলাদেশের মানুষ ঘর থেকে বের হলে সুস্থহালে ফিরতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। আজকাল গুম নামক আরেক ফ্যাসিবাদী লক্ষণ ঘরের ভেতরেও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। সোজা বাংলায়, বাংলাদেশের একটি নাগরিকও এখন আর কোনোভাবেই স্বাধীন নয়, তাদের মাথার উপর সর্বক্ষণ ঘুরতে থাকে গুম হয়ে যাবার, খুন হয়ে যাবার আতংক। দেশে দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে কোনো কিছুতেই সুস্থিরতা নেই, কোথাও নেই সত্যিকার স্বাধীন দেশের কোনো প্রতিচ্ছবি। দেশটা যেন এক মগের মুল্লুক, যার ক্ষমতা আছে সেই সবকিছুর মালিক, যার ক্ষমতা নেই তার কিছুই নেই।
বিগত দুই টার্ম জাতীয় সংসদে আছে আওয়ামীলীগ, মানে যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো অথবা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই দলটিই সবচে বেশি সমর্থন পাবার দাবীদার, এদের কাছেই জনতা আশা করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই দলটির শাসনামলেই দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে, দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঠিক বিপরীত দিকে এগিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে। যে সামরিক শাসকদের হাত ধরে যে বিষবৃক্ষের বপন করা হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে, আফসোসের বিষয় হলো সে বিষবৃক্ষের পরিপালন, পরিচর্যনের মধ্য দিয়ে এর শেকড় দেশের গভীরে প্রোথিত করে দেয়ার কাজটি বর্তমান আওয়ামীলীগের হাত ধরেই হয়েছে ঢের বেশি। ওরা শুধু শুরু করেছিলো, আওয়ামিলীগ পূরণ করছে ষোলকলা।
আমি নাস্তিক হিসেবে মুক্তমনা ব্লগার হত্যা কিংবা ৫৭ ধারা নিয়ে কোনো কথা বলবো না। এই ব্যপারগুলো বাদ দিলেও কি দেশটা সাচ্ছন্দ্য হয়ে যায়? দেশের মানুষগুলো সত্যিকারের স্বাধীন হয়ে যায়? দেশের মানুষগুলো সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করে?
আজকে সরকারের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতা কর্মী থেকে শুরু করে রাজনীতির সকল স্তরে দুর্নীতি, ক্ষমতার দাপট। প্রশাসনের একজন পিয়ন থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত প্রতিটা ব্যক্তিই দুর্নীতিতে জর্জরিত। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জনগণের কল্যাণের জন্য যে সমস্ত অফিস আদালত পরিচালিত হয় সেসব থেকে সেবা নিতে গেলে আগে ঘুষের টাকার রেডি রাখতে হয়, হয়রানী তো আছেই।
দেশের এমন কোনো খাত নেই, এমন কোনো বিভাগ নেই যা সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেছে পাসের হার বেশি দেখানোর লোভে পরীক্ষার খাতার অপমূল্যায়ণে। এখন আবার প্রশ্ন ফাস ডাল ভাত হয়ে গেছে। ভাবতে অবাক লাগে, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাস হয় নি বলে এক পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে। যে বিষয়টা স্বাভাবিক হবার কথা, সে বিষয়টাই এখন খবরে প্রকাশ করার মতো অস্বাভাবিক হয়ে গেছে!
মোদ্দা কথায়, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা নব্বইয়ের গণআন্দোলন ক্ষমতার পালাবদল ঘটালেও জনতার লাভ কিছুই হয় নি। ঊনসত্তরের পরে জনতা নিজের একটা দেশ পেয়েছে, নব্বইয়ে পেয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় নি। বরং স্বাধীনতার নামে, গণতন্ত্রের নামে কড়াই থেকে উনুনে পড়েছে। লোকের যদি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি না থাকে, না থাকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাবার নিশ্চয়তা, তাহলে দেশ দিয়ে, নামকাওয়াস্তে স্বাধীনতা দিয়ে কিংবা গণতন্ত্রের শাসন দিয়ে কি করবে?
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী তবে? তবে কি প্রয়োজন আবারও আরেকটি গণঅভ্যুত্থান? অবস্থাদৃষ্টে এ ছাড়া আর অন্য কোনো পথও খোলা দেখা যাচ্ছে না। সময়ের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।