পৃথিবীর মহান কিছু বিপ্লবী নারী যুগ যুগ ধরে নারীরা ও পুরুষের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে, শোষিত নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এমন অনেক ব্যক্তিত্ব বাংলায় জন্মেছে যাদের নাম বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা চট্টগ্রামের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, রক্তক্ষয়ী কৃষক আন্দোলনের নেতা ইলা মিত্র। তাঁদের কথা প্রগতিশীল বাঙালীরা জানে। ফিলিস্তিন আন্দোলনের অন্যতম এক লড়াকু সৈনিক, লায়লা খালেদ এর কথা, সত্তরের দশকের যুবকদের অজানা নয়। সেদিন ছিলো ২৯ অগাস্ট ১৯৬৯ প্রথম নারী বিমান ছিনতাইকারি লায়লা খালেদ পত্র পত্রিকায় ছবিসহ খবর, রোমান হলিডে খ্যাত বিখ্যাত অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের সাথে চেহারার সাদৃশ্য ছিলো তাঁর। অমনই উঁচু হয়ে থাকা ধারালো চোয়ালের হাড়, উজ্জ্বল চুল, ঝিলিক দেওয়া চোখ। হেপবার্নের মতোই অভিজাত সৌন্দর্য তাঁর। তাঁর মতো করেই পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবিসহ খবর হতেন তিনি সে সময়।
শুধু বিপ্লবী যোদ্ধাই নয় সমাজের অবহেলিত নিগৃহীত এক বেশ্যার অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে দস্যু সর্দার ও পরে ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য ফুলান দেবীর কথা কে না জানে? ১৯৬৩ সালে তিনি একজন ভারতীয় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথম বার ধর্ষিত হলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো, সে অসম্মানিত হয়ে পড়েছিলো, পুরুষরা তাকে ন্যায্য খেলা বলে দেখেছিলো। একজন দস্যু রানী হিসাবে, ফুলন দেবী ফিরে আঘাত। ফুলন দেবী যখন প্রথমবারের মতো প্রতিরোধের আঘাত হানে তখনও তিনি ১৬ বছর বয়সী এক তরুণী, তার আগে ১২ বছর বয়সে তিনি ধর্ষিতা হন। ভারতের উত্তরপ্রদেশের এই মেয়েটি এইতো সেদিন ইতিহাস সৃষ্টি করে।
পৃথিবীতে বড় বড় যে সশস্ত্র যুদ্ধ বা বিপ্লব ঘটে গেছে তাতেও নারী জাতিকে একটা বিশেষ চরিত্রে দেখানো হয়েছে। ইঙ্গ-ফারসি শতবর্ষের যুদ্ধে (১৩৩৮ থেকে ১৪৫৩) 'জোন অফ আর্ক' এর কথা নিশ্চয়ই ইতিহাসে পড়েছেন। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড হঠাৎ করেই অবৈধ ভাবে ফ্রান্সের সিংহাসন দাবি করলে এই যুদ্ধ শুরু হয়। এটি ছিলো ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ। যুদ্ধে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপে-৬ প্রথমে পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। পরবর্তীতে ফরাসি বীর কন্যা জোন অফ আর্ক অথবা জেনি দো'অর্লিয়েন্স এর বীরত্বের কৌশলের মাধ্যমে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। যুদ্ধ সমাপ্ত হয় ১৪৫৩ সালে।
জোন অফ আর্ক ফরাসি জাতীয় বীরাঙ্গনা, ফ্রান্সের সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। তাঁর স্মরণে ফ্রান্সে অনেক স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, তাঁকে রোমান ক্যাথলিক চার্চে একটি কুমারী এবং হলি সেন্ট হিসাবে উপাসনা করা হয়। মাত্র ১৯ বছর বয়েসে কুমারী জেন শহীদ হয় এবং বহুবছর পর ক্যাথলিক চার্চ তাঁকে 'হলি সেন্ট' উপাধি দেয়। আর একজন বিপ্লবী নারী, ফরাসি বিপ্লবে, ১৭৮৯ সালে, মারিয়েন, তিনি স্বাধীনতা এবং একই সঙ্গে ফরাসি প্রজাতন্ত্র ও গনতন্ত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। তিনি ফ্রান্সের বিপ্লবের রূপক, যিনি শিষ্ট ইমেজ উপস্থাপনা করে ফরাসি রাজার দুর্ভেদ্য দুর্গ বাস্তিলের পতনের পর ফরাসি ঝান্ডা হাতে প্রথম প্রবেশ করেন। এজন্যই মারিয়েনের ভাস্কর্য ও ছবিগুলিতে, হাতে ঝান্ডা আর মাথায় সাধারণত ফরাসি টুপি দিয়ে আবৃত থাকে, বিপ্লব ও সৌন্দর্যের প্রতিক তাই একটি উন্মুক্ত স্তন, যা বিপ্লবীদেরকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। রাশিয়ান অক্টোবর বিপ্লবের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী নেতৃত্বের নাম নাতাশা ক্রুপস্কা, অসাধারণ এক নারী, প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে, বিপ্লবী ঘটনাগুলিতে তাদের অংশগ্রহণ কেবল সর্বহারা শ্রেণীর নেতা নয়, তার ভূমিকা ছিলো বিপ্লবের শীর্ষে থেকে মার্ক্সবাদ লেলিনবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
আজ ৯ ডিসেম্বর, বাংলার আর এক নারী আন্দোলনের পুরোধা বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী, এই দিনে তাই সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৪৬ বছর পরে 'গণতন্ত্রের মানসকন্যা' অথবা 'মাদার অফ হিউম্যানিটি' উপাধিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা দানকারী হিসেবে ভূষিত করেন তখন কি মহীয়সী নারীদের সাথে কোনো যোগ সুত্র খুজে পান? ৪ দশক পরে, যখন বাংলার নতুন নারী নেতৃত্ব দেশটাকে যেভাবে সভ্যতার পথে এগিয়ে যাওয়ার সাধনায় এগুচ্ছেন তাতে তাঁকে হয়তো কোনোদিন 'জোন অফ আর্ক' হিসেবেই বাংলার ইতিহাসে দেখানো হবে কি?