চৈতী আহমেদ

প্রধান সম্পাদক, নারী

প্রিয় নারী, আপনার লড়াই আপনাকেই লড়তে হবে!

জেলার নাম কি মানুষ তাবিজ বানিয়ে গলায় পরবে যে সব কিছুকে উপেক্ষা করে জেলার নাম শুদ্ধ করার জন্য দেশের মানুষ উন্মাদের মতো আচরণ করছে! প্রিয় জেলাবাসী আপনাদের জেলায় জেলায় নারী/শিশু ধর্ষণের হিড়িক পড়েছে। এটা কি আপনার চোখে পড়েছে? 
গতকালও একটা নারীকে ধর্ষণের পর বিভৎসভাবে খণ্ড বিখণ্ড করে রেললাইনের উপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার লাশ। এর পরেও আপনার বিবেকে সাড়া জাগে না? এর পরেও আপনি কিভাবে জেলার নাম নিয়ে ট্রলে মেতে উঠতে পারেন? এর পরেও আপনারা কিভাবে ফেসবুকে সেল্ফি পোস্টাতে পারেন?
 
জানি আপনি বলবেন এটা আপনার আত্মপ্রেম! না আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনার আত্মপ্রেম হলো মিথ্যা প্রেম। যেখানে আপনার নিরাপত্তাই গড়ের মাঠ- আপনি তার বিরুদ্ধেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না সেখানে আপনি একের পর এক ফেসবুকে সেল্ফি দিয়ে মিথ্যে আত্মপ্রেমের অভিনয় করছেন এটা আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন না! সেল্ফি সুখের কোনো পরিমাপক নয় পাগল! ঘন ঘন সেল্ফি হলো আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। যা আপনাকে আপনার পরিপার্শ্ব থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এই ফাঁকে আপনার সমাজ রাষ্ট্র নিমজ্জিত হচ্ছে সীমাহীন অনাচারে অবিচারে। প্রিয় ফেসবুকবাসী আপনাদের দেখে মনে হয় না, আপনারা এতোটা সমস্যা জর্জরিত একটা দেশের নাগরিক। যে দেশে প্রতিদিন তিন চারটি ধর্ষণ, হত্যা সংবাদ শিরোনাম হয়। আপনাদের এই সুখ সুখ অভিনয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের, প্রশাসনের সীমাহীন ব্যর্থতার চিত্র!
 
যেখানে আপনি আজ জানেন না কাল আপনারও লাশ কোনো রেল লাইনে পড়ে থাকবে না বা কোনো খালে ভেসে উঠবে না সেখানে আপনার এই সুখের অভিনয় কি কঠিন কোনো অসুখ বলে আপনার মনে হয় না? কিভাবে একটি নারীর খণ্ড বিখণ্ড লাশের চিত্র দেখার পর, বা একটি শিশুর বস্তাবন্দি লাশ দেখার পর আপনার রুচি হয় নিজের আত্মপ্রেমের সেল্ফি প্রদর্শনের?
 
যেমন আপনারা তেমন আপনাদের প্রশাসন, তেমন আপনাদের সরকার তেমন আপনাদের সেকুলার সরকার প্রধান! রাষ্ট্রকাঠামোর নির্বিকারত্ব দেখে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকায়, ধর্ষণ এবং হত্যার জন্য নারীপ্রজাতির উপর বিশেষ সেল টাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। পুরুষকুল তাই ব্যায়াকুল হয়ে ধর্ষণ, হত্যায় নেমে পড়েছেন। প্রতিদিন গড়ে তিন চারটি করে নারী ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনা সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। প্রশাসনও যেনো অসহায় এখানে। তাদের নির্লিপ্ততা অন্তত তাই বলছে। আপনারাও যেনো মোবাইল স্কীনে ভেসে আসা লিঙ্কটি ক্লিক করে দেখে নিচ্ছেন যে ধর্ষণের শিকার নারীটি আপনার পরিবারের কেউ কিনা। নিশ্চিত হয়ে আবার ডুব দিচ্ছেন আত্মপ্রেমে!
প্রিয় পুরুষ, আপনি কি ধর্ষণ করেছেন নাকি লাইনে আছেন?
 
দু’টোর কোনোটির জন্য যদি আপনি কোয়ালিফাইড না হয়ে থাকেন আজ বিকাল পাঁচটায় শাহবাগে চলে আসেন। বিউটি ধর্ষণের এবং হত্যার বিচারের দাবিতে আজ ধর্ষণ, হত্যা নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের সহযোদ্ধারা সেখানে বিক্ষোভ জানাবেন।
 
প্লিজ এড়িয়ে যাবেন না, এরপরের ধর্ষণটি যে আপনার বা আপনার পরিবারের কারো সাথে হবে না কে বলতে পারেন? প্রশাসন যে বলতে পারেন না এটা নিশ্চিত। তারা অনলাইনে নাস্তিক ধরার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তাই নারীরা ঘরে বসে থাকবেন না। শাহবাগে এসে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিন। প্রশাসনকে অন্তত এভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দিয়েন না। চিৎকার করে তাদের কুম্ভকর্ণঘুম ভাঙ্গিয়ে দিন।
 
আপনি হিজাব পড়েন? ও তাহলেতো আপনি ভালো মেয়ে? ভালো মেয়ে হলে কি আপনার ধর্ষণ হবে না? আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। হিজাব পড়ে তনু বাঁচতে পারে নি। সংসারের হাল ধরা ভালো মেয়ে রূপা বাঁচতে পারে নি। ভালো মন্দের উর্ধে ৮ বছরের শিশু নুসরাত বাঁচতে পারে নি। অপহরণের তিনদিন পর তার বস্তা বন্দী লাশ পাওয়া গেছে খালের পানিতে। বাঁচতে পারে নি ১ বছর ১০ মাসের শিশুটিও, তাকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। সে শুয়ে আছে হসপিটালে, রক্তাক্ত!
 
গতকাল ভাইরাল হওয়া তাসকিরা হক তান্নির হত্যাকাণ্ডের খবরটি হয়তো এখনো আপনার সেল্ফির ভিড়ে নিউজ ফিডে ভেসে উঠতে পারে নি? তার আদরের ভাইটি বোনকে হারিয়ে বিলাপ করছে আর হত্যার বিচারের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। এই ছেলেটিও হয়তো এর আগে কখনওই কোনো ধর্ষণ হত্যার প্রতিবাদের কথা স্বপ্নেও ভাবে নি। কারণ তারও হয়তো ধারণা ছিলো ধর্ষণ হত্যাতো খারাপ মেয়েদের হয়। বেপর্দা মেয়েদের হয়। পশ্চিমা পোষাক পরা মেয়েদের হয়। বুক, পেট, বগল দেখানো শাড়ি পরা মেয়েদের হয়।
 
তার ভাইয়ের ভাষ্যে পাওয়া তথ্য মতে তাসকিরা হক তান্নি কিন্তু খুবই ভালো মেয়ে ছিলো, হিজাব পরতো, কোনোদিনই নারীবাদের একটা লাইনও হয়তো সে সচেতন ভাবে পড়ে নি। কারণ তান্নিও হয়তো কোনোদিন ভাবেই নি যে, কোনো একদিন কথিত নষ্ট নারীবাদীরাই রেললাইনের উপর পড়ে থাকা তারই খণ্ড বিখণ্ড লাশের ছবি সামনে নিয়ে রাগে, দুঃখে, ভয়ে, বিক্ষোভে কাটাবে নির্ঘুম রাত!
 
প্রিয় ভালো নারী সমাজ! আপনারা জেনে অবাক হবেন, তান্নি কিন্তু পরিপূর্ণ হিজাব পরতো। ঘটনা স্থলের পাশেই পাওয়া গেছে তার হিজাবটি।
 
জানি না এই সমাজ কবে বুঝবে- পুরুষ যদি মনে করে কোনো নারীকে সে ধর্ষণ করবে তাহলে সে হিজাব পরলো কি ন্যাংটা থাকলো তাতে কিছু আসে যায় না। তার জন্য আপনার একটি ভ্যাজাইনা থাকাই যথেষ্ট। আচ্ছা.. আচ্ছা... আপনি সমাজের উপরতলার নারী? তাহলেতো আমি আপনাকে শাজনীনের কথা মনে করতে বলবো। তার বাড়ির গৃহকর্মী তাকে তার বেডরুমে হত্যা করে তারপর ধর্ষণ করেছিলো। এর বিচার পেতে শাজনীনের শিল্পপতি পিতার কেটে গেছে যুগের বেশি সময়।
 
প্রিয় নারী, আপনি সমাজের যে স্তরেরই বাসিন্দা হন না কেনো, যে মর্যাদার আসনেই আপনি আসীন হন না কেনো, পুরুষ সে যদি রাস্তার ভবঘুরেও হয়, কৈশোর উত্তীর্ণ আপনার গৃহকর্মীও হয় আপনি তার কাছে ভাজাইনাওয়ালা নারীর বেশি নয়। ভবঘুরেটি যদি কোনো শপিংমল থেকে কোনো স্বল্পবসনা নারীকে বেরোতে দেখে উত্তেজনা বোধ করে সে তখন সুযোগ মতো পাওয়া যে কোনো নারীর উপর চড়াও হবে। হোক সে ১ বছর দশমাসের শিশু। হোক সে তার নিজের ঔরসজাত কন্যা। কারণ ধর্ম পুরুষকে দিয়েছে নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব। তার লিঙ্গ হলো যাবতীয় ক্ষমতার আধার।
 
আপনার কৈশোর উত্তীর্ণ কাজের ছেলেটি যদি টিভিতে বাংলা সিনেমায় দেখতে বসে দেখে মিশা সওদাগরকে নায়িকা মুনমুনকে ধর্ষণে উদ্যত হয়েছে সে তখন তক্কে তক্কে সুযোগ খুঁজতে থাকবে আপনার উপর চড়াও হওয়ার জন্য। সেও জানে এই দেশে নারী ধর্ষণ, হত্যা করলে কিছুই হয় না। আশা করি বুঝবেন আপনার কেনো শাহবাগে এসে প্রতিবাদে শামিল হওয়া উচিত। সরকার বা রাষ্ট্র যে এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না সেটা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
 
সরকার, রাষ্ট্র, ধর্ম হলো লিঙ্গওয়ালা পুরুষদের রক্ষক। ধর্মতো রচিতই হয়েছে আপনাকে ধর্ষণ করাকে জায়েজ করতে। প্রিয় নারী, নিরাপত্তার দাবিতে আওয়াজ আপনাকেই তুলতে হবে। আপনার কান্না, প্রতিবাদ আর কেউ এসে করে দেবে যদি ভেবে থাকেন তাহলে আপনি খুব ভুল কিছু ভাবছেন। আপনার নিজের ব্যথার চিৎকার আপনি নিজেই করেন প্লিজ!
 

1943 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।