নাদিয়া ইসলাম

নারীবাদী

প্রিয় আফ্রিদা, আপনি যেখানে থাকেন, ভালো থাকেন

আমার ঘুম সঙ্ক্রান্ত কোনো সমস্যা নাই। আমি একটানা কোনোপ্রকার বিরতি ছাড়া তিনদিন চারদিন পাঁচদিন ঘুমাইতে পারি, যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে, নৌকায়, গরুর গাড়ীতে, লন্ডনের ব্যস্ত টিউবের হাতল ধইরা ঝুলতে ঝুলতে, ভাত খাইতে খাইতে, ছবি আঁকতে আঁকতে, কানতে কানতে, হাসতে হাসতে। একবার আমি বাইসিকেল চালাইতে গিয়াও ঘুমায়ে গেছিলাম। ঘুমাইতে ঘুমাইতে বাইক নিয়া পড়ছিলাম রাস্তার পাশের ড্রেইনে।

কিন্তু আজকে আমি ঘুমাইতে পারতেছি না।

মাঝে মধ্যে মানসিক ব্যথারা এত তীব্র হইয়া উঠেন, তাদের মানুষের মতো জীবন্ত প্রাণী বইলা মনে হয়, তারা সেকেন্ড ডিগ্রি বার্নের মতো বা এ্যানেস্থেশিয়া না দিয়া ড্রিল মেশিনের কুৎসিত ঘরঘরঘরঘর আওয়াজের সাথে সাথে পেলভিসের হাড্ডি ফুটা কইরা ট্রেফিন সুঁই দিয়া খানিকটা বোন মেরো লিকুইড টাইনা বাইর কইরা নিয়া আসার মতো তীব্র শারীরিক ব্যথায় আপনারে অন্ধ কইরা দেন। আপনার শ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। আপনি আপনার বুকের ভিতরে রক্তপাত টের পান। আপনি ঘুমাইতে পারেন না।

আমার কাছে প্রায় সময়ই অনেকে ফরমায়েশী লেখা চান। আমি আমার স্বভাবসুলভ অলসতায় সেইগুলি এড়াইয়া যাই। আমার লেখা অনেকটাই ডায়েরি লেখার মতো, প্রেমপত্র লিখার মতো। লেখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি না হইলে আমি লিখতে পারি না। ফেইসবুকে Afrida Tanzim বইলা আমার এক বন্ধু ছিলেন। ২০ বছর বয়সী অসম্ভব প্রতিভাবান একজন আর্টিস্ট। মানুষ মারা গেলে আমরা যেমন ‘সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেধাবী সন্তান’ বইলা পত্রিকায় আহাউহু অবিচুয়ারি লিখি, আফ্রিদা তেমন মেধাবী মানুষ ছিলেন না। উনি সত্যি সত্যি অতি প্রতিভাবান অতি মেধাবী শিল্পী ছিলেন। আমি উনার আঁকা ছবি দেখতাম আর ভাবতাম এত কম বয়সে এত প্রজ্ঞা উনি কই পাইলেন। ভাবতাম, এই ছবিগুলি আমার আঁকা উচিত ছিলো। ভাবতাম, ২০ বছরের একটা ভাসা ভাসা চোখের বাচ্চা মেয়ে কোন চিন্তার গভীরতায়, কোন শৈল্পিক পাগলামীতে, কোন একাকীত্বের নিঃসংগতায়, কোন সৃষ্টিতত্ত্বের সন্ধানে এই জিনিস প্রোডিউস করতে পারেন? ভাবতাম আর অবাক হইতাম আমি।

আফ্রিদা আমার কাছে একটা লেখা চাইছিলেন। উনার একজিবিশান আজকে শুরু হইছে ঢাকার কলাকেন্দ্রে। উনি আমার কাছে জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখ একটা লেখা চাইছিলেন উনার একজিবিশানের প্রেস রিলিজে দেওয়ার জন্য। আমি উনারে লেখা দেই নাই।

উনি গতকাল আত্মহত্যা করছেন ফ্যানের সাথে কাপড়ের ফাঁস দিয়া। উনার মা, লেখক Rahima Afrooz Munni ও আমার ফেইসবুকের বন্ধু। আমি গতকাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাড়ীতে বইসা উনার ফেইসবুকের স্ট্যাটাস পড়তে পড়তে আবিষ্কার করলাম আফ্রিদা মারা গেছেন। আমার তখনো বিশ্বাস হয় নাই কথাটা। ভাবছি, লেখক মানুষ কত কী হাবিজাবি লিখেন ফেইসবুকে! ভাবছি, এইরকম একটা বাচ্চা মেয়ে কী কারণে মারা যাবেন? উনার একজিবিশান চলতেছে, উনার এই তো কিছুদিন পরেই পড়তে যাওয়ার কথা অস্ট্রেলিয়াতে, এই তো গতকালকেই উনার সাথে আমার ফেইসবুকে কথা হইছে, উনি কী কারণে মারা যাবেন? মারা যাওয়া কি এতই সোজা?

মুন্নী একটার পর একটা পোস্ট দিয়া যাইতেছেন ফেইসবুকে। উনার হাহাকার দেখার ক্ষমতা আমার নাই। উনার ‘সোনা বাবু’ ডাকা আদরের সন্তান হারানোর শোক দেখার ক্ষমতা আমার নাই। আমার শুধু মনে হইতেছে, আফ্রিদা আমার কাছে একটা লেখা চাইছিলেন, আমি দেই নাই। মৃত্যু আমার কাছে স্বাভাবিক বিষয়, মৃত্যু আমার পড়ালেখার এবং প্রতিদিনের অফিস যাওয়ার বিষয়। আমি নিজে মৃত্যুরে কাছ থিকা দেখছি, বহুবার, বহুবার, বহুবার, আমি আমার কাছের বন্ধুদের মারা যাইতে দেখছি, রাত দুইটায় গাড়ীর উইন্ডশিল্ড ভাইঙ্গা বাইর হইয়া আসা মুখভর্তি ফুটি ফুটি ফ্র্যকেলসওয়ালা হালকা সবুজ রঙ্গের চোখের ছেলের হা করা মুখ থিকা রক্ত গড়ায়ে নামতে দেখছি, আমার কাছে মৃত্যু পানি খাইয়া ঘুমাইতে যাওয়ার আগে পায়ে উলেন মোজা পরার মতো অতি সাধারণ দৈনন্দিন বিষয়।

কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু বুকের ঠিক মাঝখানে বড় সাইজের একটা অদৃশ্য গর্ত বানায়ে দিয়া যায়।

শিল্পীর কাছে আমাদের কত আবদার, শিল্পের কাছে আমাদের কত চাহিদা, অথচ শিল্পী তৈরির রাস্তায় আমরা যে একেকজন নিঃসঙ্গ মাথা খারাপ মাতাল প্রাণীদের তৈরি করি, তা সম্ভবতঃ আমরা নিজেরাও জানি না। যাদের সব আছে অথচ কিছুই নাই, যারা ঘর বাড়ি সংসারের ভিতর বইসা নিজেদের বৈরাগী মন নিয়া আউলায়ে যান, যারা আরেক জগতের ডাকে ঝড়ের রাত্রে জাহাজের মাস্তুলের উপর খাড়াইয়া হাহাহাহা কইরা হাসতে হাসতে অন্ধকার জলস্তম্ভের ভিতর ঝাঁপ দেন, যারা ‘রেইপ মি রেইপ মি’ গানে সুর দিতে দিতে মুখের ভিতর রাইফেলের নল ঢুকায়ে দেন, তাদের মাথার ভিতরের হাহাকার আমরা কেউ শুনি না। আমরা তাদের আঁকা ছবি দেখি, তাদের লেখা গান গাই, তাদের মৃত্যুতে আহাউহু করি, বলি, আহা প্রতিভার কী নিদারুণ অপচয়, তাদের মৃত্যুতে তাদের মায়ের শূণ্য দৃষ্টি দেখি, তাদের মায়ের হাহাকার শুনি, কিন্তু তাদের হাহাকার শোনার আমাদের সময় হয় না।

কারণ শিল্পীর চাইতে শিল্পের মূল্য বেশি।

আফ্রিদার মৃত্যুতে আমার শোক নাই। আমার ডান হাতে একটা ল্যাটিন বাক্য ট্যাটু করা। তাতে লেখা, ‘ডেফিচিত ওমনে কুদ মাসচিতুরে’ অর্থাৎ ‘যে জন্মাবে সে মারা যাবে’, আমি আফ্রিদারে তাই স্বার্থপর বলি না, বোকা মেয়ে বলি না, আমি উনারে আমার বন্ধু অমিতাভের মত তীব্র রাগে গালি দেই না, রাইসুর মতো বলি না, ‘আধুনিকতার বলি হওয়া বোকা মানুষ!’ আমি শুধু টের পাই আমার ঘুম আসতেছে না। আমার শুধু মনে হয়- উনারে লেখাটা দেওয়া হইলো না।

প্রিয় আফ্রিদা, আপনি যেখানে থাকেন, ভালো থাকেন। ঐপাশে রঙ তুলি ক্যানভাসের ব্যবস্থা থাকলে ছবি আঁকেন। অনেক অনেক ছবি আঁকেন। আমি কথা দিতেছি, আপনার নেক্সট একজিবিশানের আগে আপনারে আমি লেখাটা দিবো। প্রমিস।

এত রাগ এত অভিমান কি ঠিক, বলেন?

2789 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।