প্রাচীন কাল থেকে দু’একটা সমাজ ব্যবস্থা ব্যতীত, পৃথিবীর সকল অঞ্চলেই নারী বঞ্চনার স্বীকার হয়ে আসছে। নারীকে পুরুষ বানিয়ে রেখেছে তার অধীনস্থ দাস। গৃহপালিত আট দশটা প্রাণীর মতোই নারীকে ব্যবহার করেছে, করছে। দুগ্ধবতী একটি গাভী যতটুকু মর্যাদা একটা কৃষক পরিবারে পেয়ে থাকে, পৃথিবীর ইতিহাসে নারী তার থেকে বেশি মর্যাদা কখনও পেয়েছে বলে মনে হয় না। বেশি দুধের প্রয়োজনে গাভীকে ঘাসের সাথে খৈল ভুষি ইত্যাদি দ্রব্য খেতে দেয়া হয়। কিন্তু নারীর জন্য এমন কিছু বেশি সুবিধা প্রয়োজনের সময়ও দেয়নি পুরুষ, পুরুষ শাষিত সমাজ। বরং, নারী যখন পুরুষের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে, প্রজাতি রক্ষার প্রয়োজনে সন্তানকে ধারণ করেছে, তখন বরং উল্টো তাকে আরও বেশি বঞ্চনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে যুগ যুগ ধরে। সন্তান প্রসবে যেন সুবিধা হয়, বাচ্চার আকৃতি যেন ছোট হয়, সেই চিন্তা থেকে নারীর গর্ভধারণকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় খাবারও কমিয়ে দেয়া হয়েছে এক সময়। মজার বিষয় হলো, সন্তান উৎপাদনের জন্য গর্ভ ধারনের মতো বিষয়টিকে সকল সমাজেই নারীর অসুস্থতা বলে আখ্যায়িত করেছে। এটাকে একটা লজ্জার বিষয় বলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখনো, আমাদের দেশে কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে তার আত্মীয় স্বজনরা লুকিয়ে লুকিয়ে, কানে কানে খবর দেয় যে অমুক অসুস্থ। যেনো গর্ভধারণ করে মেয়েটি এক লজ্জাজনক অপরাধ করে ফেলেছে।
তবে, নারীকে যে পুরুষ একদম কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়নি, তা নয়। কিন্তু আরও মজার বিষয় হলো, এটিও পুরুষ করেছে তার নিজের প্রয়োজনে। নারীটি যেনো পুরুষটির কাছে আরও আকর্ষনীয়, আরও কমনীয়, আরও কামনার বস্তু হয়ে উঠে এর জন্য পুরুষ নারীকে দিয়েছে সাজ সজ্জার ব্যবস্থা। বিকৃত চায়না পুরুষদের কাছে নারীর ছোট পা ছিলো আকর্ষনীয়, তাই তারা নারীর পায়ে পড়িয়ে দিয়েছে লোহার জুতো। নারীকে যেনো আরও কামনার বস্তু দেখায়, তার ঠোট যেনো পুরুষের কামনাকে জাগিয়ে দিতে পারে, এজন্য দিয়েছে লিপস্টিক, কানের লতিকে চোখ দিয়ে ভোগ করার জন্য পরতে দিয়েছে দুল, গলাকে ভোগ করার জন্য দিয়েছে কণ্ঠহার। এসবই পুরুষেরা নারীর জন্য বানিয়েছে, যেনো নারীকে একটা আকর্ষনীয় যৌনযন্ত্র হিসেবে দেখায়।
প্রাচীন কাল থেকে হালের আধুনিক কালেও নারী পুরুষের যৌনযন্ত্র হিসবেই তার গৃহে পালিত হয়ে আসছে। যদিও আধুনিক সমাজ নারীকে পুরুষের পাশাপাশি ঘরের বাইরে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, তথাপি নারীর যৌনযন্ত্রের ভূমিকাই এখনো পুরুষ শাসিত সমাজে মূখ্য রয়ে গেছে। এখনও অফিস পাড়ায় নারীকে একজন সহকর্মী হিসেবে দেখার চেয়ে, তার দক্ষতার মূল্যায়ন করার চেয়ে, যৌন সামগ্রী হিসেবে দেখেই পুরুষেরা আনন্দিত হয়। একজন নারী কর্মীকে নিয়ে রসালো আলোচনা, কোনো নারী কতটুকু কামুক হবে, কোন নারীটির স্তনের আকৃতি কেমন, কার নিতম্ব পুরুষের মনে কামনার উদ্রেক ঘটায়, বিছানায় কে কতটুকু ভালো হবে তা নিয়ে আলোচনা করতেই পুরুষগণ পছন্দ করেন। কোনো নারী যদি অফিসে মিশুক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাহলে তার চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে পুরুষেরা বেশি আনন্দ পান। সেই নারীটিকে মনে মনে ধর্ষণ করে পুলক অনুভব করেন। সোসাইটি গার্ল বলে একটা টার্ম তারা বানিয়েছে এমন নারীর জন্য।
আমি এখনও পর্যন্ত কোনো সোসাইটি গার্লের দেখা পাইনি, জানি না, এমন নারী আদৌ আছেন কি না। যদিও থেকে থাকেন, তাও কিন্তু সে-ই পুরুষের প্রয়োজনে, তার মনোরঞ্জনের জন্য। প্রাচ্যে কি পাশ্চাত্যে সবখানেই রিসেপশনিষ্ট, ফোন এটেন্ডেন্স, কল সেন্টারের মতো জায়গাতে এখনও নারী, এসব জায়গাতে নারী কন্ঠের চাহিদাই বেশি। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আকর্ষণ করার জন্য, কাউকে কনভিন্স করার জন্য নারীই এখন পর্যন্ত সকল শ্রেণির ভোক্তার কাছে একমাত্র পণ্য।
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, নারীর স্বাধীনতা আসলে কি? কোথায়?