পরকীয়া একটি নিষিদ্ধ সম্পর্কের নাম। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ থাকে। বলতে গেলে এটি মানুষের প্রকৃতিজাত বা স্বভাবজাত অভ্যাস। নিষেধ করলেই আকর্ষণ বেড়ে যায়। নিষিদ্ধ বলেই পরকীয়া সম্পর্ককে অসামাজিক, অনৈতিক, অধর্মীয়, অবৈধ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কে কিভাবে এই শব্দটি আবিস্কার করেছিলো তা বলতে পারবো না। তবে নিষিদ্ধ শব্দটি ঘরেবাইরে কান ঝালাপালা করে রাখে। কেউ পরকীয়া সম্পর্কের মধ্যে পড়ুক আর না পড়ুক বিষয়টা নিয়ে বিস্তর ঘাটাঘাটি চলে। ঠিক যেভাবে এখন ফেইসবুক মাতিয়ে রেখেছে। শব্দটির প্রতি মানুষের উৎসাহ এতো বেশি থাকে যে, জানা্র আগ্রহ বেড়ে যায় দ্বিগুণ থেকে ত্রিগুণ। এই জানাজানির আগ্রহ থেকে পরকীয়া বিষয়আশয়গুলো হিতেবিপরীতে ঘটতে থাকে। বাস্তবতা বলে, এর সুন্দর কোনো সমাধান কখনো কেউ দিতে পারে নি। শুধু ভাঙ্গনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরকীয়া সম্পর্কে জড়ানোর অনেক যৌক্তিক কারণ থাকে। সেগুলো মনোবিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করে আসছে। যার মূল কারণই হলো মানসিক এবং শারিরিক ক্ষুদার তাড়না। স্বামী স্ত্রীতে যখন মানসিক এবং শারিরিক সম্পর্কের বৈষম্য দেখা দেয় তখনই কেউ না কেউ অন্য নারী বা পুরুষের উপর আসক্ত হয়। বিষয়টিকে অনেকে মানবিক দিক থেকে মূল্যায়নের চেষ্টা করে থাকেন। এদিক থেকে বিচার করলে মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিষয়টি অন্যায় বা অবৈধ নয়। এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা বা ভণ্ডামির দরকার পড়ে না। পশ্চিমা উন্নতদেশে মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে কোনো বিবাহিত নারী বা পুরুষ যদি অন্য বিবাহিত নারী বা পুরুষের কাছে ধরা দেয়, তখন তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়। কারণ, মন বলে কথা। তার উপরে আর কোনো কথা নেই। এমন কি আইনও এমন সম্পর্ককে সমর্থন করে থাকে। সংসার ভেঙ্গে তারা নতুন সংসার শুরু করে। এখানে এসব দিবালোকের মতো প্রকাশ্যে হচ্ছে। যেখানে ভণ্ডামি বা প্রতারণার কোনো অবকাশ নেই। ক্রিস্টাল ক্লিয়ারের মতো সম্পর্কের বাতাবরণগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে। তাই সংসার ভাঙ্গার পরেও কেউ কাউকে অপরাধী বা দোষী সাব্যস্ত করছে না কিম্বা প্রতিশোধ পরায়নও হচ্ছে না। এমন কি সন্তানেরাও বাবামায়ের সম্পর্কগুলো মেনে নেয়। সংসার ভাঙ্গার পরেও প্রাক্তন স্বামীস্ত্রী একে অপরের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করে থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিত্রটা ভিন্ন। এখানে পরকীয়া নিয়ে রমরমা কথা হয়। বলতে গেলে সবরকম পরকীয়া সম্পর্ক গোপনে, মিথ্যা আর প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চলে। এর শেষমেশ ভোগান্তিটা হয় একজন নারীর। পুরুষাতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরাই ভোগ করবে আর নারী হবে তার ভোগের সামগ্রী। এই মানসিকতা থেকেই বেশিরভাগ পুরুষ পরকীয়া সম্পর্কের জন্য অন্য বিবাহিত নারীকে প্ররোচিত করে আসছে। আর না্রী যদি হয় দুখী, তখন সে পরম আশ্রয় মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পর পুরুষের বুকে। পরিণতিতে নারীর কপালে জোটে হতাশা, গঞ্জনা, প্রবঞ্চনা আর কত অমানবিক, অমানসিক অতাচার। আবার অনেক বিবাহিত নারীপুরুষের সহজাত প্রবৃত্তিই আছে একের অধিক নারীপুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ানো। বলতে গেলে অতিরিক্ত আনন্দের নেশায় এরা বিভোর হয়ে এমন অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকে। এতে কোনো নৈতিকতা বা আদর্শের স্থান নেই। এখানে শুধু আনন্দ আর আনন্দ।
পরকীয়া সম্পর্ককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ধর্মীয় আনুশাসন বেঁধে দেওয়া হলো, আইন তৈরি হলো। সামাজিকভাবে ধিকৃতির ব্যবস্থা করা হলো। তারপরেও কি মানুষ এমন সম্পর্ক থেকে বিরত থেকেছে, না থাকতে পেরেছে! এক বিবাহিত নারী অন্য বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক শুধু অনৈতিক, অবৈধ বললে কম বলা হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এমন সম্পর্ক আসলে চূড়ান্তভাবে প্রতারণার সামিল বলে গণ্য করা হয়। যে বিশ্বাসের উপর স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের ভীত তৈরি হয় তা ভেঙ্গে যায় কাঁচের টুকরার মতো। সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। সেই সংসারের বেশিরভাগ সন্তানেরা বিপথে যাচ্ছে কিম্বা বাবা মায়ের পরকীয়া সম্পর্কের জন্য অনেক সন্তান অকালে প্রাণ বলিদান করছে। বাংলাদেশে পরকীয়া সম্পর্কের পরিনতি কখনই সুখকর নয় বরঞ্চ এটি দেশের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রধান ধাপ। বর্তমান ঢাকা শহরে এমন অবস্থাই পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশি। আজকের তরুণ প্রজন্মের সামনে নেই কোনো আদর্শিক আইকন বা সামাজিক অবকাঠামো যা খুবই দুঃখজনক। কারণ, এখানে পরকীয়া প্রেমের যৌক্তিক গ্রহনযোগ্যতা সবার বিবেচনায় থাকে না।
সবশেষে পরকীয়া বলি আর প্রেম বলি, বিষয়টি যদি হয় মানসিক, সেখানে কিছু বলার বা ভাবনার থাকে না। ভালোলাগার অনেকরকম রকমফের আছে। তা যদি সততা আর বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে হয়, তাহলে কারোরই কোনোকিছু করার নেই। যে কোনো সম্পর্কের খাতিরে সততার জায়গাটা হোক স্বচ্ছ এবং সূর্যের মতো জ্বলজ্বল। ভালোলাগা আর ভালোবাসা দুটি পবিত্র শব্দ, সেটা যেই সম্পর্কের মধ্যেই গড়াক না কেনো, তা সত্য, সুন্দর, পবিত্র হয়ে রক্ষা পাক। পৃথিবীতে সত্যিকারের প্রেম সবসময় কালজয়ী হয়েছে আর সেই প্রেমই পরকীয়ার হাত ধরে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। পরকীয়া নিষিদ্ধ সম্পর্ক হলেও এর আবহ চিরকাল থাকবে। তাই প্রেম শব্দটিকে যদি নেতিবাচক বা নিষিদ্ধ অর্থে পরকীয়া নামে ব্যাবহার করা হয় তবে, 'পরকীয়া' শব্দটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।