নারী জাতিকে মানুষের অধিকার দিতে মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের সমাজে যতটা সহজে একজন নারী তার পাসপোর্টে পেশা হিশেবে housewife লিখতে পারে ঠিক ততটা সহজে কি একজন পুরুষ লিখতে পারে housekeeper, নাহ আমাদের সমাজের চিত্রটাই একটু ভিন্ন, বিদেশে কাপড়ের রফতানীতে ধ্বস নামলেই লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক বেকার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু সমাজের অনেক উঁচু শ্রেণির বিবাহিত মহিলারাই পাসপোর্ট বানাতে গেলেই নিঃসংকোচে পেশা হিশেবে গৃহিনী শব্দটা বসিয়ে দেবে, কারণ এ সমাজ শত বছর আগেই নারীদের অশিক্ষিত হয়ে থাকার লজ্জা থেকে মুক্তি দিয়েছে।
একটি উন্নত সমাজে প্রতিটি পরিবারেই শিক্ষিত বাবার যেমন প্রয়োজন ঠিক তদ্রূপ স্বাবলম্বী শিক্ষিতা মায়েরও প্রয়োজন সম পরিমাণ। আমাদের সমাজের একটি স্বাভাবিক চিত্র হচ্ছে, একজন অশিক্ষিতা নারীর যখন একজন উচ্চ শিক্ষিত প্রচুর উপার্জনক্ষম পুরুষের সাথে বিয়ের পর নারীর অবস্থানটা অলিখিত ভাবেই housewife থেকে housemaid হয়ে যায়, আত্মসম্মান বোধে আঘাত লাগলেও কিছু করার থাকে না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাসত্ব গ্রহণ করে নেয়াই তো এ সমাজের শত শত বছরের নিয়ম।
আমাদের উপমহাদেশে আধুনিক সমাজ গঠনে রাজা রাম মোহনের নাম হয়তো অনেকেই জানি কিন্তু সাংবাদিক হরিশ চন্দ্র মিত্র এই ঢাকাতেই সমাজ-সংস্কারের লক্ষ্যে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের পক্ষে এবং বহুবিবাহ, পণপ্রথা ও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে ছিলেন তা হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছি। তিনি তাঁর লেখায়, নাটকে, কবিতায় সামাজিক অগ্রগতির দিক-চিহ্ন নির্দেশ করে গেছেন। উপমহাদেশে সামাজিক চিত্রটা যে এখন পর্যন্ত কুসংস্কার পূর্ণ ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে মুক্ত হতে পারে নি তা অনুধাবন করতে আমাদের আমাদের রকেট সাইন্টিস্ট হবার প্রয়োজন পড়ে না। বাঙালি হিন্দুদের বিবাহ-সংক্রান্ত নিজস্ব প্রথা ও রীতিনীতি, উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের বিবাহে প্রধানত দুইটি আচার-গত বিভাগ পরিলক্ষিত হয়, যথা, বৈদিক ও লৌকিক। এই প্রথাগুলো যে কতটা ধর্মীয় কুসংস্কার পূর্ণ তা বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করার প্রয়োজন হয় কি? ঠিক তদ্রূপ ইসলামে নারী পুরুষ মিলিত হওয়ার একটি ইসলামিক পারিভাষিক অর্থে নিকা বা বিবাহ বলা হয়। ইসলামী শরীয়াহ আইন অনুযায়ী, বিবাহ হলো একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি, আধুনিক সমাজে এই প্রথাগুলো যে কতটা কুসংস্কার পূর্ণ সেটার বিশদ ব্যাখ্যা দিতে গেলে আলোচনা অন্য দিকে ধাবিত হবে।
একজন সুযোগ্য পাত্রের হাতে কন্যা দান, বহুল প্রচলিত কথাটি আমাদের সমাজে শত বছর আগে থেকেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে এসেছে, এক্ষেত্রে দ্বিমত করার কোনোই সুযোগ নেই যে যোগ্য পাত্র হিশেবে আর্থিক ভাবে সচ্ছল পাত্রটি হচ্ছে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা মাতার জন্যে আকাশের চাঁদ, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাত্রের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানটি আসছে দ্বিতীয় ধাপে| পাত্রীর প্রাথমিক যোগ্যতা সে ভালো রাঁধে, সংসারী, নম্র ভদ্র ও ধার্মিক, যে বিষয়টি খুব সতর্কতার সাথে পাত্র পক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়, সেটা হচ্ছে পাত্রী কুমারী, সতী বা অক্ষতযোনির অধিকারিণী|
পাত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়টি আসে তৃতীয় ধাপে যেমন পাত্রী যদি পড়তে জানে ও কিঞ্চিত সাক্ষর জ্ঞানের অধিকারিণী হয়ে থাকে তবে সেটাকে অতিরিক্ত গুণ হিসাবেই ধরা হয়ে থাকে। বাঙালি মুসলিম পরিবারে বিবাহের আয়োজন মুসলিম আচার কানুনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে আর তাই কাবিননামা বা বিবাহের নথি ভূক্তকরণ ও দেন মোহর ধার্যকরণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এ আচার-রীতি খানিক ভিন্ন হলেও আমাদের উপমহাদেশে প্রতিটি বিবাহেই ঘটক শব্দটির গুরুত্ব অনেক, এই ঘটকদের কাজ হচ্ছে যোগ্য পাত্রের জন্যে একজন সুনয়না সুন্দরী লতাময়ী শারীরিক গঠনের পাত্রী খুঁজে বের করা, এক্ষেত্রে ঘটক পরিবারের বাইরের কেউ হলে নির্দিষ্ট সম্মানীর বিনিময়ে উক্ত কর্মটি সম্পাদন করে সমাজের মহতী কর্মে আয় রোজগার ভালোই করেন।
ঘটকদের কাছে জমিদার বাড়ির মদ্যপ বড় ছেলেটি বা গ্রামের চেয়ারম্যানের লম্পট ছোট ছেলেটি কন্যা দায়গ্রস্ত মফিজের বাবার জন্যে সব চাইতে সুযোগ্য পাত্র, বড় বাড়ির সুযোগ্য পাত্রদের একটু আধটু পেয়াজ খাবার প্রবণতা থাকলেই বা দোষ কোথায়! বর্তমান কালে গুলশান ও বনানীতে আর্থিক ভাবে সচ্ছল এইসব বড়লোকদের সুসন্তানদের অনেক ধর্ষণ নামক কুকর্মের সংবাদ বিভিন্ন সময়ে পত্র পত্রিকাতে আমরা পড়ে থাকি, টাকার জোরে আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে তারা বেড়িয়ে গেলেও কন্যা দায়গ্রস্ত মফিজের বাবাদের কোনোই মুক্তি নাই।
পরবর্তীতে আমাদের উপমহাদেশে অনেকেই এই ঘটকালি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। বর্তমান ডিজিটাল যুগে অন লাইন জগতে প্রচুর পরিমাণে ঘটকালির ওয়েব সাইটের সন্ধান পাওয়া যাবে।
ইদানীং কালে শহর ভিত্তিক আর্থিক সচ্ছল ও সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত বা সচ্ছল ও শিক্ষিত সমাজে ছেলে মেয়েরা তাদের নিজেদের পছন্দমত সঙ্গী বেছে নিলেও বিবাহের প্রাক্কালে দুই পরিবারের সমঝোতার মাধ্যমেই সামাজিক গ্রহণ যোগ্যতার খাতিরে বিবাহের কার্যক্রম সম্পাদিত হয়, যদি এ ধরনের বিবাহ এখন পর্যন্ত একটি সীমিত পরিসরেই সীমাবদ্ধ, তাই স্বল্প পরিসরের চিত্রটাকে সার্বজনীন হিসাবে স্বীকৃতি দেবার কোনোই প্রয়োজন নেই যেখানে আশি ভাগ মানুষ সেই শত বছরের বিবাহের নিয়মের মাঝেই আটকে আছে।
বৈবাহিক সনদ হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার প্রমাণ স্বরুপ একটি দাপ্তরিক দলিল। অধিকাংশ আইন ব্যবস্থায়, স্থানীয় সরকার কর্তৃক বৈবাহিক সনদ প্রদান করা হয়, বিবাহের দেওয়ানী চুক্তিপত্র নিবন্ধনের পর কিন্তু অলিখিত যে চুক্তিপত্রটি সরকারী পর্যায়ে নিবন্ধিত হয় না সেটা হচ্ছে যৌতুকের চুক্তি ও দেনমোহরের চুক্তিনামা, আর এই চুক্তিটাই হলো আমাদের সমাজে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার গলার কাঁটা, যেখানে একজন মেয়ে কর্ম ক্ষেত্রে, শিক্ষা দীক্ষায় ও আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী নয় সেখানে লোভী পাত্র বা তার পরিবারের একটি স্বীকৃত চাহিদার নাম হচ্ছে যৌতুকের টাকা পরিশোধ বা সেটার সমতুল্য কিছু।
আজ পর্যন্ত কুসংস্কার পূর্ণ অন্ধকারের এই বিবাহ প্রথা থেকে সমাজের অনেক মেয়ে মুক্তির রাস্তা খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এখনি এই বিবাহ নামক শতবছরি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা থেকে খুব সহজে নারী জাতির এই মুহূর্তে বেরিয়ে আসার সুযোগ নাই, সমাজে নারী জাতিকে মুক্তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পথ দেখাতে চাই নারীদের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষার সুযোগ ও কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা, একটি কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে বাস্তবমুখী চিন্তা ভাবনা ও সরকারী সদিচ্ছা, সেই সাথে বিবাহ বিষয়ক আইনের বিশদ পরিবর্তন আর এতেই নারী জাতির অধিকার, কর্ম সংস্থান ও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা গঠিত হবার সুযোগ থাকবে। নেপোলিয়ানের একটি বিখ্যাত উক্তি "তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিতা মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।"